ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

জিনেধরা

আরিফ মজুমদার

প্রকাশিত: ২২:৩২, ১৬ মে ২০২৪

জিনেধরা

জিনেধরা

নয়া কবরে লাল কাপড়ের নিশানা কেউ তো আর নিষ্প্রয়োজনে লাগিয়ে দেয়নি! রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে সকাল-সন্ধ্যায় গুজবও রটছে, কতজনই নাকি শুনেছে- নয়া কবরটি থেকে ভেসে আসছে একটা তীব্র আর্তনাদ! রাতদুপুরে তো বটেই, দিনেদুপুরেও কেউ কেউ ভয়ে দ্রুত পায়ে পেরিয়ে যায় কবরের পাশের পথটুকু।

আঁকাবাঁকা রাস্তাটির দুই পাশে হরেক প্রকার বাঁশ-ঝোপঝাড় আর গাছ-গাছালিতে আচ্ছাদিত গ্রামটির কাঁচা রাস্তাটির পাশেই নয়া কবরটিতে সদ্য প্রয়াত কোকিলার লাশ। ক’দিন ধরেই কবরটি নিয়ে নানা রকম গুঞ্জনে আতঙ্গের অন্ত নেই! 
হতদরিদ্র রিকশাচালক হেদায়াত মিয়ার স্ত্রী কোকিলা। ক’মাস ধরেই নিঃসন্তান কোকিলা কল্পিত-সন্তানকে নিয়ে যখন-তখন একা একা কথা বলছে, কখনো কখনো অট্টহাসিতেও ভেঙে পড়ছে। ‘জিনেধরা’ রোগী সন্দেহে পাশের গ্রামের জিনের বাদশাখ্যাত খবির দরবেশের (কেউ কেউ ডাকে ‘খবিশ দরবেশ’) কাছে এক দুপুরবেলা স্ত্রীকে নিয়ে আসে হেদায়াত মিয়া।

ভরাযৌবনা কোকিলাকে দেখেই কেমন কামতাড়িত হয়ে পড়েন অকৃতদার খবির দরবেশ। কোকিলার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভারি গলায় বললেন, ‘সহোদর দুইটা বদ জিন তাকে আছর করেছে। জিন দখল করেছে তার সারা শরীর-মন। জলদি জিন তাড়াইতে দুইটা মোরগ জবাই কইরা রাইতের বেলায় আসর বাসাইতে হইবে। এই জিনের কারণেই তো তার সন্তানাদিও হইতাছে না...।’ 
খবির দরবেশের কথায় আপ্লুত হয়ে কয়েক বাড়ি ঘুরে দুটি মোরগ জোগাড় করে সন্ধ্যার দিকে বউকে নিয়ে আসে হেদায়াত মিয়া। খবির দরবেশের ছুটা খাদেম জব্বরকে খবর পাঠিয়ে আনা হয়েছে। সন্ধ্যায় পর, মোরগ দুটি জবাই দিয়ে কয়েকটি রুটি বানিয়ে নেয় জব্বর। তারপর একটা মোরগের পুরো গোশত রুটি দিয়ে ভূরিভোজ সেরে এশার পর অন্ধকার ঘরে আসর পেতে বসেন খবির দরবেশ।

আসর ঘরের চার কোনায় চারটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয় জব্বর। দুই জিনকে খুশি করাতে দুই বাঁটি মোরগের গোশতও পাশে রাখা হয়েছে! মোমবাতির মৃদু আলোতে যখন একটা ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হলো তখন কোকিলাকে ধরে নিয়ে খবির দরবেশের সামনে বসিয়ে দেয় খাদেম জব্বর। চোখ বন্ধ রেখেই জিন বশের মন্ত্র পড়তে পড়তে খাদেমকে চলে যেতে হাতে ইশারা দেন খবির দরবেশ।
পাশের ঘরে হেদায়াত মিয়াকে নিয়ে বসে আছে খাদেম জব্বর। ফিসফিস করে হেদায়াত মিয়াকে ধমকাচ্ছে জব্বর, ‘চুপ করো মিয়া! অহন জোরে কথা বলা নিষেধ আছে। খাবারের লোভে কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই জিন চইলা আসবে। কেহ ভয় পাইলে তো জিনের উৎপাত দমানো বড় কঠিন! ভয় যে পাইবে তারও ক্ষতি হইবে।

জিন তার ওপরে আছর করবে! আর কেউ ভয় না পাইলে জিন নিজেই ভয় পাইবে। তহন ভদ্র-আসনে দুই বাঁটি মোরগের গোশত খেয়ে চিরদিনের জন্য তোমার বাড়ি-ছাড়া হইবে জিন...!’
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হেদায়াত মিয়া ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘কহন আইবো জিন?’ জব্বর বিরক্ত গলায় জবাব দেয়, ‘ধৈর্য ধরো, মিয়া! জিন তো আর অবসর বইসা নাই। তাদেরও তো কাজকর্ম থাহে। কাজ সাইরা চইলা আসবে। তয়, রাত বারটার আগেই আসবে। ক্ষুধা পাইলে আর দেড়ি করবে না। উইড়া চইলা আসতে জিনের কতক্ষণ! জিনের বাদশার দায়াত তো দেওয়া আছে...!’ 
হেদায়াত মিয়া কৌতূহল নিয়ে ফের বলল, ‘হেতনরা আইলে আমরা বুঝমু কেমনে?’ জব্বর ভারি গলায় বলল, ‘জিনরা আইলেই ঘরের মোমবাতিগুলা দপ কইরা নিইভা যাইবে। তহন তোমার বউর হাত-পা থরথর কইরা কাঁপতে থাকবে। হেতি অজ্ঞান হইয়া মেঝের পাটিতে শুইয়া পড়বে হয়তো! দুষ্ট জিন তাড়াতে গিয়া রোগীর সঙ্গে মেলা ধস্তাধস্তিও হয় জিনের বাদশার।

দুষ্ট জিনরা গায়ে কঠিন আঘাত না পাইলে তো রোগীকে ছাড়তেই চায় না, মিয়া!’ আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর খবির দরবেশ আসর ঘর থেকে থমথমে গলায় আওয়াজ করলেন, ‘চইলা আইছে-রে! জিন চইলা আইছে! দুই জিন একসঙ্গেই আইছে-রে, জব্বর! সাবধান! তোমরা কেউ ভয় পাইবে না, জব্বর! তুমি উনাকে নিয়া আসর ঘরের বাইরে পাহারা বসাও। অক্ষণ কাউরে আমার আসর ঘরে ঢুকতে দিবা না। জলদি যাও! দুই জিনের সঙ্গে আমার একান্তে জেরা চলছে। জিন তোমরারে জলদি একশ’ হাত দূরে যাইতে কইছে...!’ 
হেদায়াত মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের বাইরে, বাড়ি ঢোকার সরু পথের মুখে গিয়ে দাঁড়ায় খাদেম জব্বর। এদিকে কু-কর্ম সারতে গিয়ে কোকিলার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হচ্ছে খবির দরবেশের। কোকিলার নিতম্বের কাপড়ে..., অপকর্মের কথা থানা-পুলিশকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় কোকিলা।

মহিলা লোকের হুমকিতে অত্যধিক ক্ষেপে যান যৌনতাড়িত খবির দরবেশ। জেদি গলায় চিৎকার করে, ‘মাগিরে..., পাশে রাখা বোতল থেকে কেরোসিন কোকিলার নিতম্বে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন খবির দরবেশ। তারপর কিছুক্ষণ শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরেন কোকিলাকে। ডাক-চিৎকারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে কোকিলা। জিন চলে গেছে জানিয়ে খাদেমকে জোর গলায় ডেকে পানি নিয়ে আসতে বলেন খবির দরবেশ।

কোকিলার গায়ে পানি ঢেলে আগুন নিভানো হয়। জ্ঞান ফেরার পর কোকিলাকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে আসে হেদায়াত মিয়া। এরপর, পোড়া শরীর নিয়ে দুদিন বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থায় এক সন্ধ্যায় মারা যায় কোকিলা। জিনের বাদশা বলে দিয়েছেন, ‘ঘটনা লোক জানাজনি হলে বদ জিন রেগে যাবে। বদ জিন রেগে গেলে তখন কিন্তু...!’

বদ জিনের ভয়ে রাতের আঁধারে তড়িঘড়ি করে বাল্যবন্ধু হাসনাতকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার পাশেই কোকিলার দাফন সেরেছে হেদায়াত মিয়া। কোকিলা মারা যাওয়ার আগে অনেকবার অনুরোধ করেছে হেদায়াত মিয়াকে, ‘তাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে। পোড়া শরীরে তার চিকিৎসা দরকার। বদ জিন তাকে ধরেনি। খবির দরবেশ তার সর্বনাশ করেছে...।’

কিন্তু জিনের বাদশার কথা অমান্য করে কোকিলাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে সাহস করতে পারেনি হেদায়াত মিয়া। জিনের বাদশা সেদিন তাকে কঠিনভাবে সতর্ক করেছিল- ‘ঘটনা অন্য লোকজন জানলে দুই বদ জিন ভীষণ রেগে যাবে। হেদায়েত মিয়ার বাড়িতে তখন বদ জিন দলবেঁধে হামলা চালাবে। কেয়ামত পর্যন্ত সেই হামলা কেউ তো দমাতে পারবে না! যাকে সামনে পাবে তাকেই মাটিতে আছড়ে মারবে! হেদায়েত মিয়াও বদ জিনের হাতে মারা পড়বে...!’ 
‘বদ জিনের অত্যাচারে’ কোকিলা মরেছে, মেয়ের অপমৃত্যুর খবরটা পাশের জেলা থেকে জানলেন বৃদ্ধা হালুফা বেগম! নিকটস্থ থানায় গিয়ে বাদী হয়ে হত্যা মামলা করলেন তিনি। আদালতের নির্দেশে কবর থেকে তোলা হলো কোকিলার লাশ। দীর্ঘ সময় ধরে মামলার বিচার শেষে, খবির দরবেশের ফাঁসি আর খাদেম জব্বরের যাবজ্জীবন হলো আদালতের রায়ে; গ্রামে বিষয়টি জানাজানি হলে কথিত ‘জিনেধরা’ সন্দেহে বউ-মেয়েকে ঝাড়-ফুঁকের জন্য ফকির-দরবেশের কাছে যেতে আগ্রহ কমে লোকজনের।

কোনো কোনো নিঃসন্তান নারীর মানসিক অস্থিরতাও যে একটা অসুখ, সেটা বুঝতে পারছে কী প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন! তদুপরি বৃদ্ধা হালুফা বেগমের যে বুকফাটা আর্তনাদ, গ্রামে-গঞ্জে সেটা আদৌ পৌঁছছে কী চতুর্দিকে! কারাগারের কনডেম সেলে খবির দরবেশ ফাঁসির অপেক্ষায় থাকলেও তার ‘জিনেধরা’ গল্পগুলো কিন্তু ওই গ্রামজুড়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে এখনো।

×