ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

চরম ভোগান্তিতে যাত্রীরা

ঢাকামুখী সব ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:২৩, ৫ মে ২০২৪

ঢাকামুখী সব ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়

গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনায় সিডিউল বিপর্যয়ে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন আসতে দেরি

গাজীপুরের জয়দেবপুরের ট্রেন দুর্ঘটনায় ঢাকাগামী সব ট্রেনের সিডিউল ভেঙে পড়েছে। যমুনা সেতু হয়ে পশ্চিমাঞ্চলের যেসব আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে শনিবার প্রতিটি ট্রেন ৫-৬ ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। অন্য রুটের ট্রেন ১-২ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে গেছে। গরমের মধ্যে দীর্ঘ সময় ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বলে যাত্রীরা জানান। ট্রেনের সিডিউল ঠিক হতে দুদিন সময় লাগবে বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গাজীপুরের জয়দেবপুরে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে ঢাকাগামী যেসব ট্রেন যমুনা সেতু হয়ে চলাচল করছে, সেসবের সিডিউল ভেঙে গেছে। প্রতিটি ট্রেন ছাড়তে ৪-৫ ঘণ্টা দেরি হচ্ছে। এটা ঠিক হতে আরও দুদিন সময় লাগবে। কারণ ট্রেনের অফ-ডে পাওয়া না গেলে সিডিউল সমন্বয় করা যাবে না। একটি ট্রেন দেরি হলে পেছনের সব ট্রেন দেরি হয়ে যায়। তাই ট্রেনের বন্ধের দিন এই সিডিউল সমন্বয় করা হবে। এজন্য আরও দুদিন সময় লাগবে।’
সরেজমিন কমলাপুর রেলস্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, শনিবার সকাল থেকে রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরসহ পশ্চিমাঞ্চলের সব ট্রেনই ৫-৬ ঘন্টা বিলম্বে ছেড়ে গেছে। এর মধ্যে রংপুরগামী ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ ট্রেনটির শনিবার ছাড়ার সময় ছিল সকাল ৯টা ১০ মিনিট। সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি দেরিতে বেলা আড়াইটাতেও সেটি কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাতে পারেনি। একই অবস্থা অন্যান্য ট্রেনেও।

ঢাকা থেকে জামালপুরের তারাকান্দি গন্তব্যের ‘অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস’ ট্রেনের কমলাপুর থেকে ছাড়ার কথা ছিল বেলা সাড়ে ১১টায়। দুই ঘণ্টা দেরিতে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছায়। পরে বেলা একটা ৪০ মিনিটে ট্রেনটি কমলাপুর ছেড়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ট্রেনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখা গেছে। ট্রেন দেরি হওয়ায় অনেককেই ট্রেনের টিকিট ফেরত দিতে দেখা গেছে। 
কমলাপুর স্টেশনে শাহজাহান নামে রংপুরের এক যাত্রী জানান, রংপুরে যেতে গত বৃহস্পতিবার রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কেটেছিলাম। শনিবার সকাল নয়টায় ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। ট্রেনটি কোথায় আছে, আসতে কতক্ষণ লাগবে, কিছুই জানতে পারছি না। একবার এলইডি বোর্ডে দেখাল ট্রেন ১২টা ৪০ মিনিটে ছাড়বে। আবার এখন দেখাচ্ছে একটা ২০ মিনিটে ছাড়বে। ট্রেন আদৌ আসবে কি না, সেটাই কেউ বলতে পারছে না। গরমের মধ্যে পরিবার নিয়ে দীর্ঘ সময় ট্রেনের অপেক্ষায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
একই অবস্থা অন্য যাত্রীদেরও। যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল থেকেই ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। কমলাপুর স্টেশনে বেলা পৌনে দুটার দিকে ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রেনটি ছাড়ার কথা ছিল বেলা সোয়া একটায়। কখন ছাড়বে, সেই সময় স্টেশনের এলইডি বোর্ডে দেখা যায়নি।
কমলাপুর থেকে প্রতিদিন ৫৩টি ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। শনিবার মাত্র চারটি ট্রেন সঠিক সময়ে ছেড়ে গেছে। বাকি ট্রেনের অধিকাংশ দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে গেছে। তবে লাইন ক্লিয়ার না হওয়ার কারণে জয়দেবপুর হয়ে যে ট্রেনগুলো যাতায়াত করে সেগুলোর বিলম্বে ছেড়ে গেছে। গত শুক্রবার থেকেই এসব ট্রেন বিলম্ব হচ্ছে বলে রেল কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার জানান, উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব ট্রেনই দুই থেকে তিন ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ছে। শনিবার সকাল থেকে এ রুটে আটটি ট্রেন ছেড়ে গেছে আর সবগুলোই বিলম্ব হয়েছে।
শনিবার সকাল ছয়টার রাজশাহীগামী ‘ধূমকেতু এক্সপ্রেস’ সকাল আটটায়, ছয়টা ১৫ মিনিটের কক্সবাজারগামী ‘পর্যটন এক্সপ্রেস’ সকাল সাড়ে আটটায়, ছয়টা ৪৫ মিনিটের চিলাহাটিগামী ‘চিলাহাটি এক্সপ্রেস’ নয়টায়, সাতটা ১৫ মিনিটের নীলফামারিগামী ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’ সাড়ে নয়টায়, চট্টগ্রামগামী সাতটা ৪৫ মিনিটের ‘মহানগর প্রভাতী’ ১০টার দিকে ছেড়ে গেছে বলে কমলাপুর স্টেশনের কর্মকর্তারা জানান।

রাজশাহীতেও চরম দুর্ভোগ ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই রাজশাহী থেকে ঢাকামুখি ‘সিল্ক সিটি এক্সপ্রেস’ ট্রেন দেরিতে যাত্রা করায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। শনিবার সকাল সাতটা ৪০ মিনিটে ট্রেনটি ছাড়ার কথা থাকলেও ছয় ঘণ্টা বিলম্বে ঢাকার উদ্দেশে রাজশাহী ছাড়ে।
এ ট্রেনের যাত্রীরা জানান, শনিবার সকালে যাত্রা শুরুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে জানানো হয় ট্রেনটি কিছুটা বিলম্বে রাজশাহী ছেড়ে যাবে। কিন্তু ছয় ঘণ্টা বিলম্বে সাতটা ৪০ মিনিটের ট্রেন ছেড়ে গেছে দুপুর একটা ৪৫ মিনিটে।
ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ এমন বিলম্ব হওয়ায় ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা। বিশেষ করে জরুরি কাজে যাওয়া যাত্রীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। এ ছাড়া রোগী বা শিশুসহ ভ্রমণকারীদের পোহাতে হয়েছে নানা দুর্ভোগ।
রফিকুল ইসলাম নামের এক যাত্রী বলেন, এ ট্রেন প্রায়ই ছেড়ে যেতে ৫-১০ মিনিট দেরি হয়। তবে আজকে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আরেক যাত্রী শাহাদাত হোসেন বলেন, ট্রেন ভ্রমণ নিরাপদ হলেও মাঝে মাঝে চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার আব্দুল করিম বলেন, গাজীপুরের দুর্ঘটনার কারণেই সিডিউল বিপর্যয়ে পড়েছে। সাতটা ৪০ মিনিটের ট্রেন একটা ৪৫ মিনিটে ছেড়েছে। এ ছাড়া বনলতা এক্সপ্রেস পৌনে দুই ঘণ্টা বিলম্বে গেছে, পদ্মা এক্সপ্রেসও তিন ঘণ্টা বিলম্ব হতে পারে, আর ধূমকেতু এক্সপ্রেসের কথা বলা যাচ্ছে না এখনো।

৩২ ঘণ্টা পর ফের চালু ॥ স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, যাত্রীবাহী টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের সঙ্গে তেলের কন্টেনারবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের প্রায় ৩২ ঘণ্টা পর শনিবার সন্ধ্যায় চালু হয়েছে ঢাকা-জয়দেবপুর রেলরুটের আপ লাইনটি। বগিসহ দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন দুটি লাইনের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে রেললাইনের মেরামত কাজ শেষে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিট থেকে ওই লাইন চালু করা হয় বলে জানিয়েছেন জয়দেবপুর জংশন স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ মিয়া।

এদিকে এ ঘটনায় ঢাকা-জয়দেবপুর ডাবল রেললাইনের একটি লাইন (আপ) বন্ধ থাকায় ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহসহ উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সবকটি ট্রেন চলাচল সিডিউলের বিপর্যয় ঘটেছে। একাধিক ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন যাত্রীরা। 
জয়দেবপুর জংশন স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ মিয়া জানান, এ দুর্ঘটনার পর ট্রেন দুটিকে উদ্ধার করতে বিকেলে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে আসে। পরে আখাউড়া থেকে অপর একটি ক্রেনও ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। তারা টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত বগিগুলো রেখে অন্য বগিগুলো পেছনের দিকে টেনে জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন এলাকায় নিয়ে রাখে। উদ্ধারকারীরা টানা প্রায় ৩১ ঘণ্টা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে শনিবার বিকেল ৬টা পর্যন্ত তেলবাহী ট্রেনের একটি বগি বাদে বাকি বগিগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে লাইনের ওপর তুলে পেছনে ধীরাশ্রম রেলস্টেশনে নিয়ে রাখে।

দুর্ঘটনা কবলিত লাইনের দুপাশে ব্লক করে কাজ করা হয়। পরে তেলবাহী ট্রেনের অবশিষ্ট বগিসহ দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন দুটির ইঞ্জিন ও সবকয়টি বগি লাইনের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে লাইন মেরামত শেষে দুর্ঘটনার প্রায় ৩২ ঘণ্টা পর ওই লাইনে ট্রেন চলাচলের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়। এরপর শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল চালু করা হয়। 
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনা কবলিত দুটি ট্রেনের একটি ট্রেনের বগিতে দাহ্য পদার্থ রয়েছে। তাই তেলের কন্টেনারবাহী ওই ট্রেনের প্রতিটি বগিকে সতর্কতার সঙ্গে লাইনের ওপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এজন্য একটু বেশি সময় লেগেছে। তবে বিকেল পর্যন্ত ওই ট্রেনের একটি ওয়াগন ব্যতীত অন্যগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে যে ওয়াগনটি লাইনের ওপর ছিল সেটিকেও সরিয়ে নেওয়া হয়। বগিগুলো সরিয়ে নেওয়ার পর লাইন মেরামত শেষে রেল কর্তৃপক্ষের ক্লিয়ারেন্সের প্রেক্ষিতে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

×