ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আঞ্চলিক সাহিত্য সংগঠন ও সাহিত্যচর্চা

গাজী গিয়াস উদ্দিন

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ২১ মার্চ ২০২৪

আঞ্চলিক সাহিত্য সংগঠন ও সাহিত্যচর্চা

আঞ্চলিক সাহিত্য সংগঠন ও সাহিত্যচর্চা

বলা হয়, লেখা শুরু হয় গ্রামে আর লেখক পরিচিত হন শহরে। নজরুল, বঙ্কিম প্রমুখ তাই। মফস্বলে সাহিত্যের উৎসাহদাতা, পৃষ্ঠপোষক নেই, আছে উদাসীনতার বাঁকা চোখ। মূল্যায়ন ছাড়াই তাই পল্লীর কবি লেখকরা মসীযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন আপন গতিতে, আপন উৎসাহে। সামাজিক ও পারিবারিক পাঠাগার গড়ে উঠলে সাহিত্য প্রতিভা বেরিয়ে আসে। 
বিধাতা নিজেই নাকি একজন কবি। তাই কাব্য প্রতিভা সবার মাঝেই কম বেশি বিদ্যমান। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের কীর্তিমান কবি জসীমউদ্দীন মফস্বলের কবি, গ্রামীণ চিন্তাধারার কবি। আরেকটি ‘কবর’ কবিতা আজও আমরা দ্বিতীয়টি পেয়েছি কি? লোকসাহিত্য কি এখন রচিত হয়? নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ এবং ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে/ এলো খুশীর ঈদ’। রবীন্দ্রের ‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ/আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। কাব্যকথাগুলো কি গ্রামীণ না শহুরে? 
নজরুলের একটি কাব্যবক্তব্য আমার খুবই প্রিয়! ‘উষার দুয়ারে হানি আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত/ আমরা টুটাব তিমির রাত/ বাধার বিন্ধ্যাচল।’
রবীন্দ্রের একটি বাণী ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ তবে একলা চলো রে।’ এসব বাণী বুকে ধারণ করে পথ চলছি। আমার মতো একজন সাধারণ সাহিত্য শ্রমিকের জীবনে না হোক, বিগত ২৫ বছরের সাহিত্য আন্দোলন লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষর অলংকৃত করবেই।
লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ নিয়মিত মাসিক সাহিত্য সভার পাশাপাশি, বাংলা আওয়াজ সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে কবি লেখক সৃষ্টির এবং চর্চার উর্বর ভূমি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সাহিত্য সম্মেলনগুলোতে দেশের প্রথিতযশা বরেণ্য কবি লেখক সংস্কৃতি সেবীদের আমন্ত্রণ করে এনে সাহিত্যের আইকন ও রোল মডেলদের উপস্থাপন করছি। সারা বছরই আমরা জেলার সাহিত্য প্রেমিরা এ অনুষ্ঠানের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি। 
সমাজ হিতৈষী মহৎ ব্যক্তিদের অনুপ্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো মহৎ কর্ম বা সৃষ্টি জন্মায় না। লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর স্থানীয়ভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে সরব কর্মসূচি বাস্তবায়নে সক্ষমতা লাভ করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নজরুল শতবার্ষিকী পালন। সাহিত্য সংসদের মুখপত্র মাসিক বাংলা আওয়াজ এবং তৎকালীন স্থানীয় পত্রপত্রিকা সাক্ষী, পুরো জেলাব্যাপী সাহিত্য সংসদ কতটুকু সাড়া জাগিয়েছিল। ১/১১ এর সেনাশাসন আমলেও নিস্তব্ধ শহরে প্রকাশ্যে মাইক বাজিয়ে সাহিত্য সংসদ অনুষ্ঠান করেছে।
মনে পড়ে, নারী নেত্রী মাজেদা শাহাবুদ্দিন, সাংবাদিক লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম রহমান, সংগ্রামী শিক্ষক নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রফিকুল হায়দার চৌধুরী, কবি-বাগ্মী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাখন লাল ভৌমিক, সাংবাদিক এম এ মালেক, সাংবাদিক আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, অধ্যাপক মাইন উদ্দিন পাঠান প্রমুখ সাহিত্য সংসদের পাশে ছিলেন। পাশে ছিলেন অধ্যাপক চৌধুরী খুরশিদ আলম ও অধ্যাপক খলিলুর রহমান চৌধুরী।
সাহিত্য সংসদ যখন মধ্য-গগণে উঁকি মারছিল। তখন গোলাম রহমানের সহায়তায় সান্নিধ্য পেলাম দেশের সাংস্কৃতিক অভিভাবক শ্রদ্ধেয় রামেন্দু মজুমদার মহাশয়ের এবং মুক্তিযোদ্ধা ও সুসাহিত্যিক সালেহা আনোয়ারের। সাহিত্য সংসদ এই পর্যায়ে পৌঁছানোর পেছনে যার অবদানের কাছে আমরা চিরঋণী হতে পারি, তিনি হচ্ছেন রামেন্দু মজুমদার। 

২০০৫ সালে ডা. মো. সালাহউদ্দিন শরীফ এর মতো বিদগ্ধ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব এবং সাহিত্য সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ মহৎ মর্যাদা সম্পন্ন কবি ও লেখক সাহিত্য সংসদের আলংকারিক প্রধান পদে অভিষিক্ত হওয়া- এটাও সাহিত্য সংসদের ইতিহাসে নব-দিক রচনার সূচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল মহোদয়, প্রাক্তন বিমান মন্ত্রী এ কে এম শাহাজাহান কামাল, এডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি, শিক্ষাসেবী ও সমাজসেবী ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া, শিশু সাহিত্যিক ও সঙ্গীত শিল্পী সালমা কিবরিয়া, প্রফেসর খন্দকার ইউসুফ হোসেন, বাবু শংকর মজুমদার, নারী নেত্রী ফরিদা ইয়াসমিন লিকা, সাংবাদিক হোসাইন আহমদ হেলাল, সাংবাদিক কামাল হোসেন প্রমুখ এর অনুপ্রেরণা সাহিত্য সংসদকে নানা ভাবে উজ্জীবিত করেছে। 
প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল ও কলেজে শুদ্ধ উচ্চারণ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে আসছে সাহিত্য সংসদ। পাঠাগার ভিত্তিক লেখক সৃষ্টি প্রকল্প সাহিত্য সংসদের একটি নতুন পরিকল্পনা। এই পথে আমরা এগুতে চাই। সাহিত্য কে কিভাবে গণমুখী করা যায়, সে পলিসি নিয়ে নিরীক্ষাও চলছে। সাহিত্যচর্চা, সংগঠন পরিচালনা এবং লেখালেখিসহ প্রকাশনা উদ্যোগে অর্থ সংকট বাধা কি বাধা নয়- তা পর্যালোচনা বিষয়। নজরুল যেভাবে অর্থের পংকে নিচে নামতে রাজি হননি, আমরাও সে মত পোষণ করি। এখানেই আদর্শের সংঘাত অনিবার্য।
মফস্বল সাহিত্য বা গ্রামীণ সাহিত্যের ঐতিহ্য বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিমূল। মৈমনসিংহ গীতিকা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আরও দূরে চর্যাপদ সাহিত্যের পল্লী সম্পদ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং মঙ্গলকাব্যগুলোও। 
বিশ্ব কবিতায় আজ উত্তরাধুনিক ভাবধারায় ও অনুষঙ্গে যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট, মানবাধিকার, লিঙ্গ বৈষম্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অস্তিত্বের আশংকা এবং বিভিন্ন তত্ত্বের চাপে বহুবিধ বাঁক সৃষ্টির বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতের আভাস মিলছে। সেখানে আমরা মফস্বল সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনা করছি। যদিও আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই আজও গ্রামীণ সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা চলছে। ঘড়ঃ ধৎঃ ভড়ৎ ধৎঃ ংধশব, নঁঃ ধৎঃ ভড়ৎ যঁসধহরঃু আন্দোলনও পুরনো হয়েও অব্যাহত আছে, থাকবে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সনাতনী ধর্মাদর্শের যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, সেখানেও নব্য স্বাতন্ত্র্যধর্মী সাচ্চা চর্চা মফস্বল সাহিত্য চর্চায় কতটুকু চলছে, এ প্রশ্ন আজ সামনে উপস্থিত।
মফস্বলের সংবাদপত্রে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত করতে হবে। এখানে প্রকাশনা শিল্প গড়ে তুলতে হবে। বাংলা একাডেমিসহ সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়, গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, সরকারি রেডিও টিভিতে সাহিত্যচর্চার সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধায় মফস্বল কোটা থাকা বাঞ্ছনীয়। বাংলা একাডেমির সদস্য মনোনয়নের এবং গ্রন্থ প্রকাশের, প্রকাশনায় লেখা মুদ্রণে মফস্বল কোটা সংরক্ষণ করা সময়ের ন্যায্য দাবি ও অধিকার বলে মনে করি। তবে মফস্বল সাহিত্য প্রতিভা স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন পাবে। আশার বিষয়, বর্তমান সরকারের আমলে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় এবং শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন পর্যায়ে আর্থিক অনুদান প্রদান করায় সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অনেকটা প্রাণ খুঁজে পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জেলায় জেলায় লেখক তালিকা তৈরি, জেলায় জেলায় সাহিত্য মেলা ইতিবাচক উদ্যোগ। জেলায় জেলায় বাংলা একাডেমির শাখা স্থাপিত হলে মফস্বলের কবি লেখকরা বেশ উপকৃত হতো, উজ্জীবিত হতো। লক্ষ্মীপুর জেলা সাহিত্য সংসদ বিগত ২৫ বছরে আজকের অনুষ্ঠানসহ ২৮২টি সাহিত্য সভা বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে প্রবীণ ও নবীন কবি লেখকদের সম্মানিত করার উদ্যোগ অব্যাহত আছে। স্থানীয় কবি লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশ ও প্রচারে সহযোগিতা করছে। এ সংগঠনকে কিভাবে নতুন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে আরও বৈশিষ্ট্যম-িত করা যায়, সার্বিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্য ও সংগঠন হিতৈষীদের মূল্যবান উপদেশ, পরামর্শ ও মূল্যায়ন প্রত্যাশা করছি।

×