ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

ওপেনিংয়ে আশার আলো তানজিদ-ইমন

ফয়সাল আহমেদ

প্রকাশিত: ০০:৫৮, ২৩ জুলাই ২০২৫

ওপেনিংয়ে আশার আলো তানজিদ-ইমন

বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক নতুন ভোরের উন্মেষ। একসময় যেখানে টপ অর্ডারে নির্ভরতার অভাব ছিল অন্যতম দুর্বলতা, এখন সেই জায়গাটি দখল করে নিচ্ছেন দুই তরুণ ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন ও তানজিদ হাসান তামিম। টাইগার দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালকে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ওপেনার হলেও। সময়ের স্রোতে এসে এই দুজন নিজেদের গড়ে তুলেছেন জাতীয় দলের আস্থার প্রতীক হিসেবে।

সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বলছে, শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, তারা ইতোমধ্যেই হয়ে উঠেছেন দলের ম্যাচ উইনার। একটিতে আগ্রাসন, অন্যটিতে সংযম এই দুই রূপেই ফুটে উঠছে বাংলাদেশের সম্ভাবনার নতুন রূপ। দুই ওপেনারের দারুণ ছন্দে পূরণ করছে সাবেক তামিমের অভাব।
আগুনে শুরু, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ইমন। গত কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচেই ২৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের ব্যাট কথা বলেছে জোরেশোরেই। পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচ টি২০ সিরিজের প্রথম ম্যাচে মাত্র ৩৯ বল খরচায় ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংসটি ছিল চোখ ধাঁধানো। ৫টি ছক্কা ও ৩টি চারে সাজানো সেই ইনিংসটি শুধু স্কোরবোর্ডে সংখ্যা বাড়ায়নি, বরং দলের আত্মবিশ্বাসও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। বাঁহাতি এই ব্যাটারের ব্যাটিংয়ে যে আত্মবিশ্বাসের ঝলক দেখা যায়, সেটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চমক জাগানো এই ব্যাটার সময়ের সঙ্গে আরও শাণিত হয়েছেন। দ্রুত রান তোলার যে সক্ষমতা তার আছে, তা পাওয়ার প্লেতে দলকে বরাবরই এগিয়ে দেয়। একমাত্র ওপেনার হিসেবে তিনি জানেন কীভাবে প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হয়।
ইমন এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচ খেলেছেন ১৬টি, যেখানে একটি শতক ও ২টি অর্ধশতকসহ সংগ্রহ করেছেন ৩৬০ রান। তার স্ট্রাইক রেট ও ইনটেন্ট দুটোই বলছে তিনি এমন একজন ব্যাটার যিনি ম্যাচের রং বদলে দিতে পারেন মুহূর্তেই। আন্তর্জাতিক টি২০ ইতিহাসে এতদিন বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান ছিলেন তামিম ইকবাল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি২০তে ৫৪ বলে ১০০ রানের ইনিংস খেলেন ইমন। বাংলাদেশিদের পক্ষে সংক্ষিপ্ত সংস্করণে এটি দ্বিতীয় এবং অন্যতম দ্রুত সেঞ্চুরি । ৯ বছর আগে ২০১৬ সালের বিশ্বকাপে ওমানের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিটি হাঁকিয়েছিলেন সাবেক অধিনায়ক তামিম। তবে শুধু টি২০ নয়, ইমনের সম্ভাবনা রয়েছে ওয়ানডেতেও। হাতে সময় পেলে তিনি ইনিংস বড় করতে জানেন। তাঁর শরীরী ভাষা ও স্ট্রোক প্লে বলে দেয়, বড় মঞ্চের জন্য তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত।
এদিকে ধারাবাহিকতায় নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি আরেক ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম। তবে তামিমের গল্পটা একটু আলাদা। তিনি মাঠে নামেন ধীর স্থিরতা নিয়ে, চোখে থাকে আত্মবিশ্বাস। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার মাটিতে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবার লঙ্কানদের বিরুদ্ধে ২-১ ব্যবধানে টি২০ সিরিজ জিতে নিয়েছে টাইগাররা। এই সাফল্যের অন্যতম নায়ক ছিলেন তামিম। সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে তিনি খেলেছেন ক্যারিয়ারসেরা ৭৩ রানের অপরাজিত ইনিংস। ৪৭ বলের সেই ইনিংসে ছিল ৬টি চারের মার। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ছিল তার ইনিংস নির্মাণের কৌশল। পাওয়ার প্লেতে দেখে শুনে শুরু করে মিডল ওভারগুলোতে গতি বাড়িয়ে ইনিংসকে দৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করান তিনি। এর ফলে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতে ইতিহাস গড়ে।
তামিমের খেলা দেখলে বোঝা যায়, তিনি বুঝেশুনে খেলেন। যেখানে ইমন এগিয়ে যান আগ্রাসনে, সেখানে তামিম মনোযোগ দেন উইকেট ধরে রাখায়। এই ভারসাম্যটাই এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বড় শক্তি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে তানজিদ ২৮ টি২০ ম্যাচে করেছেন ৬৫৫ রান, রয়েছে ৫টি হাফসেঞ্চুরি। তার ব্যাটিং গড় প্রায় ২৭, যা নতুন একজন ওপেনারের জন্য আশাব্যঞ্জক।

তানজিদের আরও একটি বড় গুণ হলো টেম্পারামেন্ট। চাপের মুখে ভেঙে পড়ার বদলে, তিনি হয়ে উঠেছেন ঠান্ডা মাথার ফিনিশার। তার খেলা ইনিংসগুলোতে যেন থাকে একটি পরিকল্পনার ছাপ, যা তাকে আগামী দিনের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রমাণ করছে।
তবে পারফরম্যান্সের বিচারে দেখা যাচ্ছে, ইমন ও তামিম একে অপরের সম্পূরক। একজন শুরুতে তা ব চালিয়ে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে দেন, অন্যজন ইনিংস গড়েন ধৈর্য ও পরিকল্পনায়। এই যুগলবন্দিই এখন বাংলাদেশের ওপেনিংয়ে এক নতুন ছন্দ এনেছে। এই দুই ব্যাটার যখন একসঙ্গে মাঠে নামেন, তখন দলের ডাগআউটে যেন একটা নিশ্চিন্ত শ্বাস ফেলা যায়। তারা ব্যাট হাতে শুধু রানই আনছেন না, সঙ্গে আনছেন স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস।

বাংলাদেশ দলে এমন যুগল আগে খুব কমই দেখা গেছে যাদের কাঁধে তুলে দেওয়া যায় পুরো ইনিংসের ভিত। তাদের মধ্যে বয়স ও অভিজ্ঞতার যে ফারাক, সেটিও তাদের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করে। একদিকে ইমনের দুর্দান্ত ফর্ম, অন্যদিকে তামিমের পরিণত ব্যাটিং। ভবিষ্যতে এই যুগল আরও পরিণত হলে, তারা বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবেন নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশ দলের টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকরা ইতোমধ্যেই এই দুই ওপেনারের ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেছেন।
সমর্থকরাও এই দুই তরুণের ওপর চোখ রেখেছেন। স্টেডিয়ামে প্রতিটি বাউন্ডারির পর চিৎকারে যেন ভেসে আসে একটাই বার্তা ‘এই তো আমাদের ভবিষ্যৎ।’
পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ জেতার পর ইমনের দাবি, তাঁর নজর শুধুই বর্তমানে। এছাড়া তানজিদ হাসান তামিমের সঙ্গে ওপেনিং জুটি নিয়েও কথা বলেছেন এই বাঁ-হাতি ব্যাটার। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে ইমন বলেন, আমি আসলে বর্তমানে থাকার চেষ্টা করছি।

প্যানেল মজি

×