
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মেয়েদের জয়জয়কার। সব ধরনের টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকভাবে চোখ ধাঁধানো সাফল্য পাচ্ছে বাংলার বাঘিনীরা
দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের আসর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু ১৯৯৩ সালে। ২০২৩ পর্যন্ত ১৪ আসরে মাত্র একবারই শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। ২০০৩ সালের পঞ্চম আসরে। সেখানে ২০১০-এ প্রবর্তিত নারী সাফে সর্বশেষ ২০২২ ও ২০২৪Ñ টানা দুইবারের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা। সাতবারে মধ্যে রানার্সআপ আরও একবার, সেমিতে উঠেছে আরও তিনবার।
এছাড়া মেয়েদের বয়সভিত্তিক সাফে রীতিমতো উড়ছে বাংলাদেশ। ঢাকার বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফে এবার অঘোষিত ফাইনালে রূপ নেওয়া ম্যাচে মোসাম্মৎ সাগরিকার ম্যাজিকে প্রবল প্রতিপক্ষ নেপালকে ৪-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আফঈদা খন্দকারের দল।
এর মাধ্য দিয়ে বয়সভিত্তিক সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে হ্যাটট্রিক শিরোপা জিতল লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। অনূর্ধ্ব-১৮, অনূর্ধ্ব-১৯ এবং অনূর্ধ্ব-২০ সবগুলোর শিরোপা এখন বাংলাদেশের দখলে। এছাড়া টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শিরোপার মালিকও বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে ভুটানের আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৮ দিয়ে শুরু হওয়া সাফের বয়সভিত্তিক আসরের শিরোপা উঠেছিল বাংলাদেশের মেয়েদের হাতে। প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ২০২২ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ এর দ্বিতীয় আসরের শিরোপা ভারতের কাছে হাতছাড়া হয়েছিল। ওই আসরের আয়োজক ছিল ভারত।
২০২১ সালে ভারতকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ আসরে আবারও চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সাফের ওই আসরের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ। তারপরের বছর ২০২৪ সালে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ আসরে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আসরে ম্যাচে ১-১ ড্রয়ের পর ১১-১১ পেনাল্টিতেও মীমাংসা না হওয়ায় যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয় দুদলকে। ২০২৩ সালে প্রথমবার অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের আসরের আয়োজন করে বাংলাদেশ। ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-২০ আসরের প্রথম শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ। এবার দ্বিতীয় আসরেও শিরোপা ঘরে তুলল আফঈদা খন্দকারের দল। ২০১৮ আসরের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন আঁখি খাতুন। সবচেয়ে বেশি ৮ গোল দিয়েছিলেন সিরাত জাহান স্বপ্না। ২০২১ সালের সেরা খেলোয়াড় শাহেদা আক্তার রিপা, সর্বোচ্চ ৫ গোলও দিয়েছিলেন ওই রিপা।
এরপর ২০২২ সালের সেরা খেলোয়াড় ভারতের লিন্ডা কম, সর্বোচ্চ ৫টি গোল দিয়েছিলেন ওই লিন্ডা। ২০২৩ সালের সেরা খেলোয়াড় শামসুন্নাহার জুনিয়র। সর্বোচ্চ গোল ৪টি করে যৌথভাবে গোলদাতা শামসুন্নাহার জুনিয়র ও আমিশা কার্কি। ২০২৪ সালে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেয়া হয়নি। তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ থাকার পরও এবার ঘরের মাঠে তিন ম্যাচেই দুই হ্যাটট্রিকে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ৮ গোল করেছেন সাগরিকা। ছয় ম্যাচে ১০ গোল করে শীর্ষে নেপালের পুর্ণিমা রানী।
২০২৩ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম সংস্করণে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। শামসুন্নাহার জুনিয়রদের দারুণ পারফরম্যান্সের সৌজন্যে নেপালকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা মুকুট পরে তারা। তবে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় এবার বাংলাদেশে খেলতে আসেনি ভারত। ফলে বাংলাদেশই ছিল হট-ফেভারিট।
টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ শুরুটা করেছিল শ্রীলঙ্কাকে ৯-১ গোলে হারিয়ে। এরপর প্রবল প্রতিপক্ষ নেপালের বিপক্ষে ৩-২ গোলের ঘাম ঝরানো জয়ের পর ভুটানকে ৪-১ গোলে হারায় আফঈদারা। পরের ম্যাচেই ভুটানের বিপক্ষে ফিরতি দেখায় জয় ৩-০ গোলে। আর ফিরতি ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারায় ৫-০ গোলে। ১৫ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে থাকলেও হেরে গেলে গোল গড়ে স্বপ্নভঙ্গ হতো মেয়েদের। কারণ প্রতিপক্ষ গোল ব্যবধানে বেশ এগিয়ে ছিল। ভুটানকে ৮-০ গোলে হারানোয় নেপালের মোট গোল ৩০টি। আসরে ৪ গোল হজম করার দলটির গোল পার্থক্য ছিল প্লাস ২৬।
একই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ৫-০ গোলে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। এ জয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ ১৫ পয়েন্ট ও নেপালের ১২। তবে গোলে বড় ব্যবধানে এগিয়ে নেপাল। পাঁচ ম্যাচে বাংলাদেশ গোল দিয়েছে ২৪টি ও খেয়েছে প্রতিপক্ষের সমান ৪টি। সব মিলিয়ে পার্থক্য প্লাস ২০। অর্থাৎ বাংলাদেশ পয়েন্টে সুবিধাজনক স্থানে থাকলেও ৬ গোলে পিছিয়ে ছিল। সেক্ষেত্রে ট্রফি ধরে রাখতে ড্র ছাড়া বিকল্প ছিল না।
না কোনো সমীকরণ নয়, ‘অঘোষিত ফাইনালে’ রূপ নেওয়া ম্যাচে প্রবল প্রতিপক্ষ নেপালকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলার বাঘিনীরা। তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফয়সালার মঞ্চে জ্বলে উঠেছেন সাগরিকা। আসরে কেবল নিজের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকই নয়, একে একে চারবার প্রতিপক্ষের জাল কাঁপিয়ে দিয়েছেন ঠাকুরগাঁও থেকে উঠে আসা ১৭ বছর বয়সী তুখোড় এ উইঙ্গার।
প্রথম দেখায় জয় পাওয়ায় শুধু ড্র করলেই চলবে, ঢাকার বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় এমন সমীরণের ম্যাচে অষ্টম মিনিটে দলকে এগিয়ে নেন সাগরিকা। দ্বিতীয়ার্ধে হয়ে ওঠেন আরও বিধ্বংসী। ৫২ মিনিটে দ্বিতীয় গোলের পর ৫৮ মিনিটে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন; এরপর ৭২ মিনিটে আরও একটি। আরও একবার শিরোপার উৎসবে অব্যাহত থাকল মেয়েদের সাফল্যের যাত্রা। রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতির আসরে নেপালের সঙ্গে প্রথম দেখায় লাল কার্ডে তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিলেন সাগরিকা। সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তিনি ফিরলেন দারুণভাবে। গোটা ম্যাচেই নেপালকে তটস্থ রেখেছিলেন এই ফরোয়ার্ড। গুরুত্ব বিবেচনায় শক্তিশালী একাদশ নিয়ে খেলছে পিটার বাটলারের দল।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার শোকে মুহ্যমান গোটা দেশ। ক্রীড়াঙ্গনকেও যা নাড়িয়ে দিয়েছে, বিদীর্ণ করেছ ক্রীড়াবিদদের বুক। সোমবার দুপুরে ঘটে যাওয়া দুঃসহ সেই শোককে রাতে শক্তিতে রূপান্তর করেছে মেয়েরা। ‘আমি প্রথমে যে গোলটা করেছি তাদের (বিমান দুর্ঘটনায় নিহত) নামে উৎসর্গ করেছি। প্লেন দুর্ঘটনায় অনেক জন মারা গেছে অনেক জন আহত হয়েছে খুবই দুঃখজনক। খুব কষ্ট লাগছে যে বাংলাদেশে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, আমরা সবাই খুব ব্যথিত।’ বলেন সাগরিকা।
আফঈদার নেতৃত্বে সম্প্রতি প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ইতিহাস গড়েছে জাতীয় নারী ফুটবল দল। ফুটবল নিয়ে দিন দিন দেশের মানুষের উম্মাদনা আরও বাড়ছে, ‘ভালো লাগছে ফুটবলে সবাই মনোযোগ দিচ্ছে সবাই দেখতেছে। ফুটবলে সবাই ফোকাস করছে। সবাই যদি এভাবে সাপোর্ট দেয় আমরা ফুটবল আরও আগায় নিতে পারব।’ সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে না পারলেও জিতেছেন টুর্নামেন্টের মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ারের পুরস্কার, ‘আমি যদি তিনটি ম্যাচ খেলতে পারতাম তবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে পারতাম।
তবে তিনটা ম্যাচ না খেলেও বেস্ট প্লেয়ার হয়েছে এতে খুশি।’ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফে আলো কেড়েছিলেন মোসাম্মৎ সাগরিকা। ওই টুর্নামেন্টে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ। সেবার টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের কিশোরী। ওই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গত বছরের মাঝামাঝি জাতীয় দলেও অভিষেক। ২৪ জুলাই ভুটানের বিপক্ষে প্রথম প্রীতি ম্যাচে মঠে নেমেই নিজেকে চিনিয়েছিলেন এই স্ট্রাইকার।
অভিষেকে হ্যাটট্রিক করা সাগরিকা এবার অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফে প্রথম ম্যাচেই পান হ্যাট্রিকের স্বাদ! টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯-১ গোলের জয়ে ৩৮, ৫২ ও ৫৭ মিনিটে গোল করেন। নেপালের বিপক্ষে অঘোষিত ফাইনালে আরেকটি হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল। জাতীয় জার্সিতে ১৪ ম্যাচে তার গোল ১৩টি। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ৪ ম্যাচে ৪ এবং অনূর্ধ্ব-১৭ দলে আছে ২ গোল।
প্যানেল মজি