ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারী ফুটবলে অশনি সংকেত ॥ অত্যধিক পরিশ্রম-চাপকে দায়িত্ব ছাড়ার কারণ বলছেন এই সাফজয়ী কোচ

পদত্যাগ করছেন ছোটন!

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:০৫, ২৭ মে ২০২৩

পদত্যাগ করছেন ছোটন!

নারী ফুটবলের অনেক সাফল্যের সঙ্গী গোলাম রব্বানী ছোটন

বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবলের অবস্থা যাচ্ছেতাই হলেও এর বিপরীত চিত্র ছিল নারী ফুটবলে। গত নয় বছর ধরে বয়সভিত্তিক এবং গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ঈর্ষণীয় এবং আশা জাগানিয়া অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলার বাঘিনীরা। আর এর সাফল্যের রূপকার ছিলেন এক দ্রোণাচার্য। শুক্রবার হঠাৎ দেশের নারী ফুটবলে দেখা দিয়েছে ঘোর অমানিশা। একই দিনে মাত্র ঘণ্টা তিনেকের ব্যবধানে দু’-দুটি দুঃসংবাদে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের ফুটবলাঙ্গন। কেননা বাংলাদেশের নারী ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি, সফল কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন জানান, তিনি চলতি মাসের শেষেই পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন।

তারও কয়েক ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের তারকা ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান স্বপ্না নিজের ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাস দিয়ে জানান, তিনি ইতোমধ্যেই বাফুফের আবাসিক ক্যাম্প ছেড়েছেন এবং জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন। ছোটন এবং স্বপ্নার এই ঘোষণা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ক্রীড়াঙ্গনে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করেন ছোটন-স্বপ্নার এই চলে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো বিষয় আছে। 
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সঙ্গে আছেন ছোটন। নারী দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু নীরবে সব সহ্য করে নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে কঠোর-নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। অসীম ধৈর্য নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন বাংলার বাঘিনীদের। একটার পর একটা সাফল্য পেয়ে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন সমালোচক-নিন্দুকদের। পরে তারাই ছোটনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন।

কেন দায়িত্ব ছাড়লেন ছোটন? জনকণ্ঠকে ছোটন বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই নারী ফুটবল দলের দায়িত্বে আছি। তবে শেষ আট-নয় বছরে কাজের পরিধি-ব্যস্ততা-পরিশ্রম বেড়েছে। সেই সঙ্গে একের পর এক সাফল্যের কারণে প্রত্যাশার চাপও বেড়েছে অনেকগুণ। এগুলো আর নিতে পারছিলাম না। অনেক মানসিক অশান্তিতে ছিলাম। তাই স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করেছি নারী ফুটবল দলের কোচ হিসেবে আর দায়িত্ব পালন করব না। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত আছি।’ ছোটন আরও জানান, ‘ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতে করতে আমি ক্লান্ত। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন কাউকে সময় দিতে পারি না। ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই।’
নিজের এই সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই বাফুফের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার এবং বাফুফের নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারপারসন মাহফুজা আক্তার কিরণকে জানিয়েছেন ছোটন (সহকারী কোচ লিটুর মাধ্যমে)। তবে এখনো পদত্যাগপত্র জমা দেননি তিনি। 
এ পর্যন্ত নারী ফুটবল দল যত সাফল্য পেয়েছে, তার সবই এসেছে ছোটনের হাত ধরে। জাতীয় দল এবং বয়সভিত্তিক মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৮টি শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। রানার্সআপ ট্রফি আছে ৫টি। সবচেয়ে বড় সাফল্য ২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়।
গুঞ্জন ছড়িয়েছে- বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই নাকি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছোটন। তবে ছোটন বিষয়টি অস্বীকার করেন। ‘না পলের কারণে দায়িত্ব ছাড়ছি না। তবে তাকে সব সময় জবাবদিহি করতে হতো।’ ছোটনের শেষ বাক্যটি থেকেই আন্দাজ করা যায় অনেক কিছু। কয়েক বছর আগে পলের খবরদারি-দুর্ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে ছোটন এবং সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু ক্যাম্প ছেড়েছিলেন। পরে অবশ্য তারা বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন।  একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, পল নাকি নারী দলের কোচ হতে আগ্রহী বহু আগে থেকেই। কিন্তু সাফল্যের কারণে ছোটনকে সরাতে পারছিলেন না।

ফলে এমন ‘বিষাক্ত পরিবেশ’ সৃষ্টি করেন, যাতে ছোটন চলে যেতে বাধ্য হন। আর হচ্ছেও তাই। মেয়েদের দলের কোচ হতে না পেরে কিছুদিন আগে ‘দুধের ঘোলে স্বাদ মেটাতে’ পল ছেলেদের একটি বয়সভিত্তিক দলের কোচ হয়ে দুটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েও কোনো শিরোপা জিততে পারেননি। এখন ছোটন চলে যাওয়াতে পলের রাস্তা পরিষ্কার। কাজেই কিছুদিনের মধ্যে যদি পলকে নারী দলের হেড কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
আরও জানা গেছে- এত সাফল্যের পরও এবং এত পরিশ্রমের পরও প্রায় প্রতিদিনই পল নানা কথা শোনাতেন ছোটনকে! তা ছাড়া কোচ হিসেবে এত সফলতার পরও বাফুফে ছোটনের বেতন তেমন বাড়ায়নি, অথচ দফায় দফায় বেতন বাড়িয়েছে পলের। নিজের মূল্যায়ন না হওয়াটাও ছোটনের সরে যাওয়ার প্রধান কারণ হতে পারে।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? ছোটন জানান, ‘আগামী দুই-তিন মাস টানা বিশ্রাম নেব। এরপর হয়তো কোনো ক্লাবের কোচ হিসেবে কাজ করব।’ গুজব রটেছে, কিছু দিনের মধ্যেই ছোটনকে বসুন্ধরা কিংস নারী ফুটবল দলের কোচ হিসেবে দেখা যেতে পারে, তিনি নাকি ইতোমধ্যেই এ রকম প্রস্তাব পেয়েছেন। যদিও বিষয়টি স্বীকার করেননি।

×