
ফাইনাল শেষে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সান্ত¡না এমবাপেকে
একটা ধাপ বাকি ছিল কেবল। কাতার বিশ্বকাপ জিতে সেই ধাপ সম্পন্ন করে অমরত্বে পৌঁছে গেলেন লিওনেল মেসি। এ জায়গায় এলএম টেনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর গল্পটা থেকে গেল আক্ষেপ হয়েই। বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের দুই মহাতারকা লিওনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর শাসনকাল প্রায় শেষ।
কিন্তু ফুটবল বিশ্ব তো আর সম্রাট ছাড়া থাকতে পারে না! অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, এই দুই তারকা অবসর নিলেই ফুটবল সাম্রাজ্যে হয়তো নেমে আসবে অসীম শূন্যতা। সংশয় ছিল মেসি-রোনাল্ডোর মতো মহাতারকার অবসরের পর ফুটবল কী পাবে তাদের যোগ্য উত্তরসূরি!
কিন্তু কাতার বিশ্বকাপ জানিয়ে দিয়ে গেল, ফুটবল বিশ্বের নতুন সম্রাট নিজের রাজ্যপাট বুঝে নিতে প্রস্তুত। আর তিনি হলেন কিলিয়ান এমবাপে। প্যারিস সেইন্ট জার্মেইর ফরাসি তারকা কেএম টেন। এই ইঙ্গিত চার বছর আগেই দিয়ে রেখেছিলেন ফ্রেঞ্চ সুপারস্টার। ২০১৮ সালে ফ্রান্সকে দ্বিতীয় বিশ্বকাপের শিরোপা উপহার দিয়ে। সেই রাশিয়া বিশ্বকাপেই উল্কার গতিতে উত্থান ঘটেছিল ১৯ বছর বয়সী এক তরুণের। কোয়ার্টার ফাইনালে জোড়া গোল করে লিওনেল মেসির স্বপ্নও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন কিলিয়ান এমবাপে।
চার বছর পর আবারও ফাইনালের টিকিট কেটেছিল এমবাপের ফ্রান্স। এবার শিরোপার লড়াইয়েও ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ সেই লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে রবিবার ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা। তবে একটা সময় আর্জেন্টিনার জয়ের পথে একাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এমবাপে।
যদিওবা এদিন ম্যাচের শুরু থেকেই খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল মেসির আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৭০ মিনিটের আগে যেন মাঠে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না এমবাপেকে। সেই সুযোগ ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল আলবিসেলেস্তারা। একপেশে ম্যাচ জয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। কিন্তু এরপরই ৯৭ সেকেন্ডের এক ঝড়ে ম্যাচের রং বদলে দেন এমবাপে। ৮০ এবং ৮১ মিনিটে পরপর দুই গোল করে গোটা ফুটবল দুনিয়াকে জানিয়ে দেন কেন তিনি এমবাপে? তার প্রথম গোলটি এসেছিল পেনাল্টি থেকে। সেই গোলের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ফের আরেকটি দুর্দান্ত ভলিতে গোল করে ম্যাচে সমতা ফেরান তিনি।
ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। মেসির গোলে আবারও এগিয়ে যায় ম্যারাডোনার উত্তরসূরিরা। ১১৮ মিনিটে আবারও গোল করে ফ্রান্সকে টানা দুইবার শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে রাখেন এমবাপে। এই গোলটিও আসে পেনাল্টি থেকে। সেইসঙ্গে হ্যাটট্রিক করার নজিরও গড়েন তিনি। দীর্ঘ ৫৬ বছরের মধ্যে প্রথম ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে তিন গোল করার অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েন এই ফরাসি তরুণ।
আর বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে হ্যাটট্রিকের নজির। তার আগে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এই রেকর্ড গড়েছিলেন ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্ট। ১৯৬৬ সালে জিওফ হার্স্টের হ্যাটট্রিকের সৌজন্যেই প্রথম এবং একমাত্র বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিল থ্রি-লায়ন্সরা।
কিন্তু এমবাপে হয়ে রইলেন ট্র্যাজিক হিরো! কাতার বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করেও শিরোপায় চুমো আকতে পারলেন না তিনি। কেননা টাইব্রেকারে জিতে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর তৃতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে কেএম টেন। তবে পেনাল্টি শুটআউটেও গোল করে প্রথম ফ্রান্সকে লিড এনে দিয়েছিলেন এমবাপে। তাতেই প্রমাণিত হয় যে, চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না তার। নিংড়ে দেন নিজের সামর্থ্যরে সবটুকু।
ফ্রান্সকে তিন দফা ম্যাচে ফেরান তিনি। তারপরও তাকে হতাশায় ডুবিয়ে সব আলো কেড়ে নেন মেসি। পূরণ হয় আর্জেন্টিনা অধিনায়কের পরম আকাক্সিক্ষত বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন। দলীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার জিততে না পারলেও একটি ব্যক্তিগত অর্জনের লড়াইয়ে ক্লাব সতীর্থ মেসিকে পেছনে ফেলেন এমবাপে। ৮ গোল করে কাতার বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুট জেতেন তিনি। স্বপ্নের বিশ্বকাপজয়ী লিওনেল মেসির গোলসংখ্যা ৭টি। যদিওবা সেমিফাইনাল পর্যন্ত মেসি-এমবাপের দুজনেরই গোল ছিল সমান ৫টি করে। আরও এক কীর্তিতে ভাগ বসালেন ফরাসি ফরোয়ার্ড।
২০০২ সালের পর এই প্রথম ৮ গোল করলেন কোনো ফুটবলার। সেবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া ব্রাজিলের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার রোনাল্ডোর গোলও ছিল সমান ৮টি। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে তার গোলসংখ্যা বেড়ে হলো ১২। যার চারটি ছিল ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে। সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপে ১০ গোল করার রেকর্ডও এখন ফরাসি তারকার। এর আগে জার্মানির গার্ড মুলার ২৪ বছর ২২৬ দিনে ১০ গোল করেছিলেন। এমবাপে ১০ গোল করার রেকর্ড গড়েন ২৩ বছর ৩৬৩ দিনে।
কিলিয়ান এমবাপের আজ ২৪তম জন্মদিন। রবিবার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনাল জিতলেই দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে পরপর দুইবার বিশ্বকাপ জয়ের অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়তেন তিনি। তার আগে ১৯৬২ সালে ২১ বছর বয়সী পেলে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জেতার পর থেকে আর কারোরই নেই এই অর্জন। সেই অর্জন নিজের নামের পাশে যোগ করতে পারলে নিঃসন্দেহেই আজ মহানায়কের ট্যাগ যোগ হয়ে যেত এমবাপের পাশে। তারপরও সোনার বুটের পাশাপাশি দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার সিলভার বল জয় করে জানিয়ে দিলেন তিনিই আগামীর মহাতারকা।