
জিম্বাবুইয়ে সফরেও বাংলাদেশ দল
ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর জিম্বাবুইয়ে সফরেও বাংলাদেশ দল দুই সংস্করণেই সিরিজ হারের তেতো স্বাদ পেয়েছে। নখ-দন্তহীন টাইগারদের এটি প্রাপ্য ছিল। এটি সত্যিকার অর্থেই ব্যর্থতার জন্যই বাংলাদেশ সিরিজ হেরেছে। প্রতিপক্ষ দুই দেশের দল যেখানে ইতিবাচক মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে ভয়ডরহীন সাহসী ও স্বাধীন ক্রিকেট খেলেছে-সেখানে বাংলাদেশ দলের পারফর্মেন্স ছিল অস্বাভাবিক। খাপছাড়া এবং দলের পরিকল্পনার পরিপন্থী।
দেশের জন্য খেলায় যেভাবে যখন যে চাহিদা অনুযায়ী খেলা উচিত খেলোয়াড়রা সেভাবে খেলেননি, তারা খেলেছেন নিজের জন্য। দলে নিজেদের স্থান ধরে রাখার জন্য। নিজের নামের পাশে অর্ধশত রান নিশ্চিত করার জন্য। আর তাই ভুরি ভুরি ডট বল। উইকেটে থিতু হয়েও ইনিংস বড় করা এবং দলের রান বৃদ্ধির সুযোগ তারা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন যেটি প্রতিপক্ষ জিম্বাবুইয়ে পর পর দুইটি ওয়ানডেতে রান তাড়া করে দুইটি দুইটি করে চারটি সেঞ্চুরি করে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে দলের জয় নিশ্চিতের জন্য দায়িত্বশীল ক্রিকেট খেলতে হয়।
বাংলাদেশ দল সুযোগ হাতছাড়া করেছে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অনিশ্চয়তা আর ভয় নিয়ে তো সাহসী বা অগ্রাসী ক্রিকেট খেলা যায় না। তাছাড়া বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়রা তো তাদের সামর্থ্যরে শতভাগ দিতে পারেননি। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পর পর দুইটি ম্যাচে ৬০ রানে ৩ উইকেট এবং ৪০ রানে ৪ উইকেট নেয়ার পরও চাপ সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। ‘লুজ’ বল করা হয়েছে, পাশাপাশি জঘন্য ফিল্ডিং। আর কখন খেলোয়াড়রা বারবার একই ভুলের সংশোধন করবেন? দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন? কবে মাঠের লড়াইয়ে ভুল ‘অবসন’ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ দল। দেখতে দেখতে তো অনেক বছর পার হয়ে গেছে।
উন্নতির সুযোগ আছে এ কথা তো সব সময় শুনছি, বাস্তবে তো লক্ষণীয় হচ্ছে না। সব সময় বলি বাংলাদেশ ওয়ানডেতে শক্তিশালী দল। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে পিছিয়ে আছে। এই দুই সংস্করণে অভ্যস্ত হতে আরও সময় লাগবে। কথা হলো এই দুই সংস্করণ কিভাবে খেলতে হবে ধারাবাহিকতার সঙ্গে এটি এখনও বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ শেষ ওয়ানডে ছিল ৪০০তম। বাংলাদেশ শেষ ম্যাচে জিতেছে। বলা হয়েছে এটি স্বস্তির জয়। একদম শূন্য হাতে ফিরে আসা থেকে কিছু তো পাওয়া গেছে। শেষ ম্যাচে কিন্তু জিম্বাবুইয়ের প্রথম দুইটি ম্যাচে যারা খেলেছেন সেই দলের কয়েকজনকে মাঠে না নামিয়ে নতুন খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠন করা হয়েছিল, এটি একটি কাগজে পড়েছি।
বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না জিম্বাবুইয়ের পাইপ লাইনও ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সার্বিক অবস্থান কারও অজানা নয়। খেলোয়াড় নেই, তাই কেউ কেউ বেজায় খুশি। তাদের ছাড়া উপায় নেই। জোড়াতালি দিয়ে সব সময় দল গঠন। বাধ্য হয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা। টিম ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত বিতর্কিত এবং হাস্যকর। আন্তর্জাতিক ম্যাচে তো দল মাঠে নামাতে হবে। কাউকে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। ক্রিকেটে দৈন্যর জন্য তো সর্বমহল দায়ী। কেউ কেউ সব সময় সবকিছুতে বোর্ডের বিরোধিতা করেন এরাই আবার স্ববিরোধিতার মিছিলে সবার আগে আছেন।
সব সময় বলা হয় দুর্বলতাগুলো এবং সমস্যার সমাধানের জন্য কাজ করা হবে, কাজ করাও হয়। এরপরও ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ধৈর্য ধরা হচ্ছে। ধৈর্যেরও শেষ আছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ক্রিকেট নিয়ে কিন্তু সব সময় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে খেলা চলছে। মানুষ দূর থেকে সবই বুঝে। আবার কেউ কেউ নিজস্ব মতলবে খেলোয়াড় বন্দনা করেন। এদের কথা হলো সব ব্যর্থতা বোর্ডের। অদ্ভুত অবস্থা। লিখতে হলে অনেক কথাই লিখতে হবে। লিখে লাভ নেই। খারাপ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার এখনই সময়, দেশের ক্রিকেট নড়বড়ে অবস্থায় আছে।
ক্রিকেট আঁকড়ে ধরে মানুষ স্বস্তিতে নেই। ক্রিকেটে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেটে শক্তিশালী দল। বলা হয় অনেক ভাল খেলে। ১৯৮৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত খেলেছে ৪০০টি ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে জিতেছে ১৪৪টি ম্যাচে। হেরেছে ২৪৯ এবং পন্ড হয়েছে ৭টি ম্যাচ। জয়ের হার ৩৬.৬৪। পরিসংখ্যান কী বলে বাংলাদেশ শক্তিশালী দল ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে? খেলা হচ্ছে দেশের জন্য। মাঠে খেলোয়াড়দের চরিত্র দেখার পাশাপাশি মানুষ তাদের মধ্যে দেশকে খুঁজেন। বল নষ্ট করে (ডট বল) পঞ্চাশ রান না হয় হলো, কিন্তু খেলায় যদি দেশ না জেতে তাহলে তো এই পঞ্চাশ-ষাট রান অর্থহীন। প্রয়োজন খেলোয়াড়দের দায়িত্বশীলতা এবং শৃঙ্খলিত আচরণ। মনে রাখতে হবে সবার দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা আছে।
ক্রিকেটের জন্য প্রয়োজন মানসিক শক্তি এবং ইতিবাচক মানসিকতা। ক্রিকেট ব্যক্তির খেলা নয়, দলগত খেলা। এখানে সম্মিলিত প্রচেষ্টাই শেষ কথা। ধারাবাহিকতা বড় বেশি জরুরী। একদিন খাওয়া জুটল এরপর চার পাঁচ দিন উপোস, তারপর হঠাৎ করে আবার খাবার জোটা। এটি সুস্থতা নয়। ক্রিকেটের প্রয়োজন মানসিকতা এবং চিন্তাভাবনার পরিবর্তন। ক্রিকেট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। টি-টোয়েন্টির প্রভাব এখন ওয়ানডে এবং টেস্টে ক্রিকেটে ভীষণভাবে ভর করেছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন ৩০০-৩২০ স্বাভাবিক রান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চ্যালেঞ্জে জিততে হলে মানসিকতার পরিবর্তন সাধন করে মাইন্ড সেটের মাধ্যমে জয়ের জন্য খেলা। ক্রিকেটে স্থিতিশীলতা ছাড়া উপায় নেই। গ্রাফটাকে যতদূর সম্ভব সহনীয় অবস্থায় রেখে এগিয়ে চলাটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত।
গ্রাফটা যতদূর সম্ভব সহনীয় অবস্থায় ধরে রেখে এগিয়ে চলাটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ক্রিকেটে ভুল স্বীকার করার সংস্কৃতি নেই। এতে করে ক্রিকেট বারবার বিতর্কিত হচ্ছে। বাড়ছে অস্থিরতা। দেশ ক্রিকেট বোর্ড, ক্রিকেট অপারেশন্স এবং টিম ম্যানেজমেন্ট কি বার্তা দিচ্ছে এটা কি খেলোয়াড়রা বুঝতে পারছেন, কিংবা বুঝতে চাইছেন না। অবজ্ঞা, উদাসীনতা এবং শৃঙ্খলাহীন আচরণ বারবার ক্রিকেট চেতনাকে জখম করছে। ক্রিকেটকে নিচের দিকে টেনে চলেছে। নীতি নির্ধারণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হওয়া দরকার আছে।
সার্বিক বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া উচিত। আমরা আমাদের ক্রিকেট নিয়ে যতই চোঙ্গা ফুকি না কেন, অন্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে ঠিকই আমাদেরকে তাদের থেকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। ক্রিকেট অপারেশন্স এবং টিম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে প্রয়োজন আরও গভীর সমন্বয়। ক্রিকেট অপারেশন্স একটি লক্ষ্য নিয়েই কাজ শুরু করেছে। ক্রিকেট অপারেশন্স এর চিন্তার মধ্যে শুধু যে নতুন রক্তের সঞ্চালনই সমস্যার সমাধান তা কিন্তু নয়।
জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ থেকে বাংলাদেশ কতটুকু উপকৃত হয়েছে জানি না। তবে গত কয়েকটি বছর জিম্বাবুইয়ে ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের শক্তি পরীক্ষার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ। এবার দেখা গেল প্রেক্ষাপট পাল্টাতে শুরু করেছে। দেশ, ক্রিকেট বোর্ড এবং বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বে¡ও গত দুই তিন বছরে জিম্বাবুইয়ের ক্রিকেট অনেক পাল্টে গেছে। এরা দেশের ক্রিকেটের ‘থার্ড’ জেনারেশন। আর এই জেনারেশন ক্রিকেট খেলছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ চলতি মাসের ২৭ তারিখ থেকে শুরু হওয়া টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ। মধ্যপ্রাচ্যে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে অনেক বেশি শক্ত। বাংলাদেশের প্রথম খেলা আফগানিস্তানের বিপক্ষে। বাংলাদেশ খর্ব শক্তি এবং নড়বড়ে দল নিয়েই মাঠে নামবে এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশ দল এখনও টি-টোয়েন্টি রপ্ত করতে পারেনি। লক্ষ্য হওয়া উচিত দৃঢ় মানসিক বলের সঙ্গে ইতিবাচক ক্রিকেট খেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। খেলাটা উপভোগ করা।
সাকিব আল হাসান মঞ্চায়িত নতুন নাটকের সমাপ্তি ঘটেছে। অতীতের মতো আবার তিনি তার কৃতকর্মের ভুল স্বীকার করে দেশের ক্রিকেটে নিজকে উজাড় করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ক্রিকেট বোর্ডকে। সাকিবকে এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়ক করা হয়েছে। শুধু তাই নয় নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ত্রি-দেশীয় সিরিজ এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও নেতৃত্ব দেবেন সাকিব। ‘বেটউইনারের’ সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছেন সাকিব। এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে।
ক্রিকেট মহলে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রূপ সচেতন মহল দেখেছেন। একটি কথা না বললে অন্যায় হবে সাকিবের চরম অনৈতিক কাজটির বিরুদ্ধে নীতি, আদর্শ সুশাসন এবং জবাবদিহিতার প্রশ্নে বোর্ড প্রেসিডেন্ট প্রথম থেকেই ছিলেন অনড়। তার এক কথা চুক্তি বাতিল না করলে অন্য সিদ্ধান্ত। বোর্ড প্রেসিডেন্ট সব সময়ই কিন্তু খেলোয়াড়দের পাশে থাকেন। এমন কি খেলোয়াড়দের পরিবারের পাশেও প্রয়োজনে দাঁড়িয়েছেন। সাকিব বাধ্য হয়েছেন অনৈতিক কাজ থেকে নিজকে সরিয়ে আনতে। তিনি চুক্তি বাতিল করেছেন। ভুল স্বীকার করেছেন।
আগামীতে এ ধরনের কোন কাজে জড়িত হবেন না। সে আশ্বাসও দিয়েছেন। এরপর তাকে অধিনায়ক করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোর্ড। দুঃখের বিষয়ে সাকিবের এই অনৈতিক কাজকে ঢাকতে চেয়েছেন মিডিয়াতে কেউ কেউ, শুধু তাই বিভিন্নভাবে এরা বোর্ডকে দোষারোপ করতে চেয়েছেন ঠুনকো যুক্তি উত্থাপন করে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক