বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
বাংলাদেশের বছর শুরু করেছিল মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট জিতে। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের সেরা সাফল্য তুলে গোটা ক্রিকেট বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল টাইগাররা। ২০১৭-এ কলম্বোয় শততম টেস্টে উড়েছিল লাল-সবুজের পতাকা। ঘরের মাঠে স্পিন সহায়ক পিচে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড বধের রোমাঞ্চ....। আসলেই সেসব কেবলই রোমাঞ্চ, টেস্ট নয়! টেস্ট আভিজাত্য, স্থিতিশীলতার খেলা।
ক্রিকেটের শতবর্ষীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অংশ। বছরের পর বছর, ম্যাচের পর ম্যাচ, সিরিজের পর সিরিজ হেরে যাওয়া একটা দল আচমকা দুই-একটা টেস্ট জিতে সেই সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না! ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২-০’ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর সোজা কথার মানুষ সাকিব আল হাসান সেটাই বলেছেন ‘এদেশে টেস্টের সংস্কৃতি কখনোই ছিল না, এখনও নেই।’ এমন কথা একজন অধিনায়কের মুখ থেকে শুনতে খারাপ লাগলেও, একজন কিংবদন্তি সাকিবের বক্তব্য খোদ বোর্ড (বিসিবি) প্রেসিডেন্টও ফেলে দিতে পারেননি।
নাজমুল হাসানও সেটি স্বীকার করে নিয়েছেন। শুধু মুখে স্বীকার করলেই তো চলবে না। টেস্ট আঙিনায় দীর্ঘ ২২ বছর কাটিয়ে দেয়া দলটির সংস্কৃতি ফেরানোর দায়িত্ব ক্রিকেটার, বোর্ড, সংগঠক, সংবাদ মাধ্যমের কিন্তু দর্শকের নয়; কারণ দর্শক সাফল্য চায়, পেছনের কারণ খোঁজে না।
সাকিব-নাজমুলের বক্তব্যে যাওয়ার আগে পরিসংখ্যানে টেস্ট-ব্যর্থতার কিছুটা নমুনা তুলে ধরা যাক। ২০০০ সালে অভিষেক থেকে এই ফরম্যাটে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তা এখনও অব্যাহত। হারের ধরনগুলোও প্রায় একই রকম, হারার আগে হেরে যাওয়া! টেস্ট মানসিকতার কোন পরিবর্তনও নেই। মাঝে মধ্যে দৈবাৎ দুই-একটি জয় ছাড়া সাফল্য নেই বললেই চলে।
২২ বছরেরও বেশি সময় ধরে খেলেও পরিণতবোধ এখনও আসেনি। তাই তো এই ফরম্যাটে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন সাকিব, তামিমরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এবার ভাল কিছুর আশায় ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এ্যান্টিগা টেস্টের পর সেন্ট লুসিয়াতেও একই ফল। চতুর্থ দিনে বৃষ্টির কারণে মাত্র ৩৮ ওভার খেলা হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশের হারের জন্য এই সময়টুকুই যথেষ্ট! ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরে বাংলাদেশ অপ্রত্যাশিত, অনাকাক্সিক্ষত এক রেকর্ডে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে হারের সেঞ্চুরি করেছে বাংলাদেশ। এই ফরম্যাটে এক শ’র বেশি ম্যাচ খেলা দলগুলো মধ্যে কেবল জিম্বাবুইয়ে হারের সেঞ্চুরি পায়নি। বাংলাদেশ নবম দল হিসেবে হারের তিন অঙ্কে পৌঁছেছে। তবে একটি ‘তেতো’ রেকর্ডও হয়েছে।
টেস্ট হারের সেঞ্চুরিতে দ্রুততম পৌঁছেছে (সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে) বাংলাদেশ। ১৩৪তম টেস্ট খেলতে নেমে বাংলাদেশ শততম টেস্ট হারের দেখা পেয়েছে। এত কম সময় এবং এত কম ম্যাচ খেলে আর কোন দল এই দুঃস্বপ্নের রেকর্ডে পা রাখেনি।
বাংলাদেশের আগে এই রেকর্ড ছিল নিউজিল্যান্ডের। বাংলাদেশের চেয়ে ১০৭ ম্যাচ বেশি খেলে এমন রেকর্ড গড়েছিল কিউইরা। তাদের লেগেছিল ২৪১ ম্যাচ। সময় ৬৫ বছর। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান। শ্রীলঙ্কা সর্বশেষ ২০১৭ সালে টেস্ট হারের সেঞ্চুরি করেছিল।
এই রেকর্ডে নাম ওঠাতে তারাও খেলে ২৬৬ টেস্ট। সময় ৩৫ বছর। এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত পাকিস্তানের অবস্থানেও বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ভারত ১০০ টেস্ট হেরেছিল ৩০৩ ম্যাচে। পাকিস্তানের লেগেছিল ৩৫৭ টেস্ট। ভারতের সময় লেগেছিল ৬৪ বছর, পাকিস্তানের ৫৯ বছর। ১৮৮৯ সালে টেস্ট অভিষেক দক্ষিণ আফ্রিকার। ১১৪ বছর পর ২০০৩ সালে শততম টেস্ট হারে। এজন্য তারা ম্যাচ খেলেছিল ২৭৯টি। টেস্ট ক্রিকেট শুরু হয়েছিল ১৮৭৭ সালে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দিয়ে? শততম টেস্ট হারের পরিসংখ্যানে দুই দলের পার্থক্য ২০ বছর। ম্যাচ অনুযায়ী ব্যবধান ২৭ টেস্ট। অস্ট্রেলিয়ার দরকার হয়েছিল ৩৭৪ টেস্ট। ইংল্যান্ডের ৩৪৭ টেস্ট। এছাড়া ১৯২৮ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের লেগেছিল ৩৬৮ ম্যাচ।
শুধু ম্যাচ সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। জয়ের হিসেব ধরলে তো বাংলাদেশ কারও ধারে কাছেও নেই। ১৩৪ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় মাত্র ১৬টি। ড্র ১৮টি। অথচ এশিয়ার তিন দেশ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভারত শততম টেস্ট হারের আগে জয় পায় যথাক্রমে ১০৭, ৮৪ ও ৫৭ টেস্ট। সবচেয়ে কম নিউজিল্যান্ডেরও জয় ছিল বাংলাদেশের দ্বিগুণের বেশি ৩৩টি। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ৯০, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৩৮, ইংল্যান্ডের ১৩৯ ও অস্ট্রেলিয়ার ১৭০ জয় ছিল।
ক্রিকেটের মানদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় টেস্ট ফরম্যাটকে। অথচ ২২ বছর টেস্ট খেলেও ক্রিকেটের এই আদি ফরম্যাট রপ্তই করতে পারেনি বাংলাদেশ। তাইতো বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে প্রশ্ন উঠে, হয় তীব্র সমালোচনা। এবার আরও একবার চেনা প্রশ্ন উঠছে, টেস্ট কবে শিখবে বাংলাদেশ? উইন্ডিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর এক প্রশ্নের জবাবে অধিনায়ক সাকিব বলেন,‘ খেলোয়াড়দের এখানে খুব বেশি দোষ দেয়াটা ঠিক হবে না। আমাদের দেশের সিস্টেমটাই কিন্তু এমন। আপনি কবে দেখেছেন বাংলাদেশে ৩০ হাজার দর্শক টেস্ট ম্যাচ দেখছে বা ২৫ হাজার দর্শক মাঠে এসেছে টেস্ট দেখতে? ইংল্যান্ডে তো প্রতি ম্যাচে (টেস্টে) এ রকম দর্শক থাকে। টেস্টের সংস্কৃতিটাই আমাদের দেশে ছিল না কখনও, এখনও নেই!’ সাকিব সত্য বলেছেন।
কিন্তু দর্শকের ঘাড়ে সংস্কৃতির দায় চাপানো অর্থহীন। এখনও দেশের বেশিরভাগ মানুষই ক্রিকেটের কঠিন নিয়মকানুন না বুঝেই খেলা দেখেন প্রিয় দলকে সমর্থন দেয়ার জন্য। ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটই যেখানে শতভাগ সমর্থক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝেন না, সেখানে চার ইনিংসের টেস্ট ম্যাচের নানা মারপ্যাঁচ বুঝতে হলেও তো খেলাটির প্রতি দর্শকদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেটা সম্ভব হবে মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলা হলে।
বাংলাদেশ টেস্ট দল যেটা নিয়মিতই পারে না। গত ২২ বছরে খুব কম টেস্টেই রোমাঞ্চকর করে তুলতে পেরেছেন ক্রিকেটাররা। যেগুলোতে পেরেছেন, সেগুলো ঠিকই উপভোগ করেছেন দর্শক। শ্রীলঙ্কার মাটিতে যেদিন নিজেদের শততম টেস্ট ম্যাচে জয় পেল, সেদিন বাংলাদেশে উৎসবের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। এ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, টেস্টে ভাল করলেও জয়ধ্বনি ওঠে।
বাংলাদেশের মানুষ ওয়ানডে এবং টি২০ বেশি দেখেন। কারণ, এ দুই সংস্করণে তুলনামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলে বাংলাদেশ। টেস্ট ম্যাচও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপর্ণূ হলে দর্শক হবে কোন সন্দেহ নেই। এই সংস্কৃতি তৈরি করার দায়িত্ব বিসিবি, ক্লাব, সংগঠক এবং ক্রিকেটারদেরই নিতে হবে। টেস্ট সংস্কৃতি নিয়ে তোলা সাকিবের প্রশ্ন প্রসঙ্গে বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান বলেন, ‘সাকিব যেটা বলেছে, সেটা সাকিবের কথা। তবে আমাকে যদি বলেন, একেবারে দ্বিমত করি না আমি। টেস্ট খেলা এক ধৈর্যের খেলা। এই ধৈর্য শুধু খেলোয়াড়দের না কিন্তু, এটা সকলের।
আমি যদি নির্দিষ্ট করে বলতে চাই প্রথম ৫০ বছরে ১৯৬টা ম্যাচ খেলে ভারত মাত্র ৩৫টা ম্যাচ জিতেছে। একটু চিন্তা করে দেখেন, অন্যতম শক্তিশালী দেশ তারা। নিউজিল্যান্ড এখন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন, ২৬ বছর লেগেছে তাদের প্রথম ম্যাচ জিততে।’ সাকিব, তামিম, মুশফিকরা দীর্ঘদিন ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলছেন। টেস্ট সংস্কৃতি না গড়ে ওঠার পেছনে তাদের দায়ই বেশি কিনা? ‘কেন বললো, কি চিন্তা করে বলেছে, এসব নিয়ে না জিজ্ঞাস করে, না শুনে; একজনের ওপর আরেকটা কমেন্ট দিতে গেলে সেটা বেকায়দা।
কেন, কখন কি বলেছে, এটা সামনা সামনি শোনার আগে কমেন্ট করাটা কঠিন। তবে হ্যাঁ, সব মিলিয়ে সংস্কৃতি শুধু খেলোয়াড়দের না; আমাদের সবার। দর্শক, মিডিয়া সবারই ধৈর্য ধরতে হবে। টেস্টে কেউ রাতারাতি ভাল করতে পারেনি, এটা আমি বলব না; তবে অনেক কঠিন। অনেক দেশেরই সময় লেগেছে। বাংলাদেশেরও লাগছে এবং লাগবে। তবে আমি মনে করি প্রত্যাশিতভাবে যদি আমরা উন্নতি করতে পারি, সামনে আরেকটু ভাল হবে।’
টেস্টে যে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে, পরিসংখ্যান দিয়ে সেটা প্রমাণের চেষ্টা করে বোর্ড প্রেসিডেন্ট, ‘২০১২ থেকে ২০২২, শেষ দশ বছরে ৩৩টা টেস্ট সিরিজ খেলেছি, ৬১টি ম্যাচ। এর মধ্যে আমরা ১৩টা জিতেছি, ১১টা ড্র, ৩৭টা হেরেছি। জয়ের গড় যদি দেখতে যাই, সেটা ২১ শতাংশ।’ আগের ১২ বছরের সঙ্গে তুলনা টেনে নাজমুল হাসান আরও যোগ করেন, ‘এখন একটা ম্যাচ খারাপ হলে হতাশ হয়ে যাব, যা খুশি বলে বেড়াব, কারও দোষ খুঁজে বের করবা এটা করা ঠিক না।
আপনাদের মন খারাপ, আমার মন আরও খারাপ এই খেলা দেখে। আমি উন্নতি দেখতে পাচ্ছি। সেটা কিভাবে, আমরা সেই শুরু (২০০০ সাল) থেকে ৩৭টা টেস্ট সিরিজ খেলেছি, ৭৩টা ম্যাচ। প্রথম ১২ বছরে ৩টা মাত্র ম্যাচ জিতেছিলাম, জয়ের গড় ৪ শতাংশ। ৪ শতাংশ থেকে যদি ২১ শতাংশ হয়, এটা অবশ্যই উন্নতি!’