ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় পতাকা শিবনারায়ণ দাস থেকে সুফিয়া হাফিজ

দীপংকর গৌতম

প্রকাশিত: ০১:৪৯, ২৬ মার্চ ২০২৩

জাতীয় পতাকা শিবনারায়ণ দাস থেকে সুফিয়া হাফিজ

উনিশ শ’ একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ

উনিশ শ’ একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ থেকে ছাত্র, শিল্পী, পেশাজীবী যে যেভাবে পেরেছে পাকিস্তানি বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। দেশের আপামর জনসাধারণ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে মাত্র নয় মাসে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছে। আজ আমরা যে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে গর্ব করি, সেটা ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত। মুক্তিযুদ্ধের এই মাসে আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি ইতিহাস চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নবজাগরণ সৃষ্টি সবচেয়ে বড় বিষয়।

পাকিস্তানি শাসকরা চেয়েছিল বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনবোধÑ সব হবে পাকিস্তানি শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাকেন্দ্রিক। তা হলে টিকে থাকবে তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক রবার্ট পেইনের ‘ম্যাসাকার’ নামক গ্রন্থে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘ওদের ৩০ লাখ মেরে ফেলো। বাদবাকিরা আমাদের হাত থেকেই খেয়ে বেঁচে থাকবে (কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস)।

কিন্তু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বদলে যায় পাকিস্তানিদের স্বপ্নের সাজানো বাগান। তারপর ২৫ মার্চ বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে শুরু হয় গণহত্যা। অপারেশন সার্চলাইট নামে এই গণহত্যায় ঢাকায় এক দিনে মারা যায় ৩০ হাজার মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ৯ মাস ধরে সব রীতি-নীতি, আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বাঙালিদের হত্যা, অত্যাচার-নির্যাতন করলেও প্র্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কারারুদ্ধ করে জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অতঃপর বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে আরেকটি দেশ, যার নাম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসকে শুধু প্রভাবিতই করেনি, ইতিহাসের বাঁকবদলও ঘটিয়েছে। একটা কথা আছেÑ বিটুইন দ্য লাইনস। এর মানে হলো যা দেখেছি, পড়েছি, তার বাইরেও আরও কিছু আছে। অনেক কথার গভীরার্থ থাকে। আবার অনেক কথা অপ্রকাশিত থাকে, আড়ালে ঢেকে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও অনেক কিছু আছে, যা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক তৈরি করেছে। কিছু রক্ষণশীলতা এখনো আমাদের প্রভাবিত করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস চর্চায় এটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। ডিসেম্বর পটভূমি কেবল একাত্তরের মার্চে তৈরি হয়নি। এটা বাঙালির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিধির ভেতর থেকে ধারাবাহিক অর্জন। এ দেশের মাটি কত নাম না জানা মানুষের রক্ত-ঘামে, অশ্রু- জলে শিক্ত হয়ে আছে। তার খবর কেউ রাখে না। ক্ষমতার পালা বদলে ইতিহাস বিকৃত হয়। বিজয়ীরা নিজেদের সুবিধা মতো ইতিহাস লেখা হয়। অথচ সাধারণেরা অতি সাধারণই রয়ে যায়।

তেমনি একজন মানুষ শিবনারায়ণ দাস। শিবনারায়ণ দাস বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার অন্যতম এবং মূল ডিজাইনার। তিনি একজন ছাত্রনেতা ও স্বভাব আঁকিয়ে ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৭ (বা ১১৮) নং কক্ষে রাত এগারোটার পর পুরো পতাকার ডিজাইন সম্পন্ন করেন। এ পতাকাই পরবর্তীতে ১৯৭১ এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলিত হয়। এই পতাকা তৈরির ইতিহাসের শুরুর দিকে তাকালে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭০ সালের ৭ জুন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই অনুষ্ঠান সফল করতে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন।

এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন। সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।

কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনলেন; এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)-এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অঃষধং নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিবনারায়ণ দাস পরিশেষে তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে, এমনি করে রচিত হলো ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র পতাকা, যা কিছুদিন পর স্বীকৃত হয় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসেবে।

৭ জুন ১৯৭০ এ অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব প্রদান করেন আ স ম আবদুর রব। অল্প পেছনে পতাকা হাতে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন হাসানুল হক ইনু। রব সেই পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান সেই পতাকা ছাত্র-জনতার সামনে তুলে ধরেন। ১৯৭১ এর ২ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক বিশাল সমাবেশ হয়। এ সমাবেশে আ স ম আবদুর রব যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন নগর ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মঞ্চস্থলে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসেন। রব তখন সেই পতাকা তুলে ধরেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন এ পতাকা ছিল স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার অনন্ত উৎস। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর অর্ধশতাব্দী পার হলেও সেই শিবনারায়ণ দাস সবার শিবুদার কথা কে স্মরণ রেখেছে তা জানি না। শিবুদা অসুস্থ ছিলেন, মণিপুরীপাড়ায় অনেক সংকটে ছিলেন জানতাম। কিন্তু যারা জানলে কাজ হবে তারা জানত কিনা জানি না। একই অবস্থার সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধকালীন গোপালগঞ্জের আরেক পতাকা নির্মাতা সুফিয়া হাফিজের এ রকম একজন মহীয়সী নারীর কথা বলছি। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার সাজাইল ইউনিয়নের কুসুমদিয়া গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন চতুর্দশী।

মানে ১৪ বছর বয়সে স্কুলছাত্রী। তিনি তখন রাতৈল স্কুলে (এনএন ইনস্টিটিউশন) সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। উনিশ শ’ একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কাশিয়ানী এলাকার কমান্ডার হায়দার আলী ফকিরের নির্দেশ দিলেন মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে পতাকা রাখার। নিজের সেলাই মেশিনে তখন কাজ করেন সুফিয়া (বিয়ের পরে নাম হয় সুফিয়া হাফিজ) নামের এক চতুর্দশী বালিকা। যুদ্ধের সময় পতাকা উড়িয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখার জন্য ব্যবহƒত হতো এই পতাকা। সুফিয়ার বাবা ফকির রওশন আলী প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে নিজে সব ধরনের সাহায্য করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এমন কি নিজের লাইসেন্সধারী বন্দুকযুদ্ধের জন্য মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে দেন। তার কাছে পতাকার খবর আসতেই তিনি তার চতুর্দশী মেয়েটার কথা মনে করেন। মেয়েটাকে তিনি পতাকা বানানোর কাজে যুক্ত করে দেন। খুব গোপনে ঘরে বসে তৈরি হতো পতাকা। ফকির রওশন আলী প্রথমে নিজের হাতে শক্ত একটা কাগজে মানচিত্র এঁকে দেন। মেয়ে সুফিয়া তখন মোটা কাগজটাকে কাপড়ের উপরে রেখে কেটে সেলাই করতেন। প্রতিদিন ১০/১২টা পতাকা বানানো যেত।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন খবর এলো পাশের গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এসেছে। তখন রাতে সেলাই মেশিন পতাকা একটা কবর খুঁড়ে রাখা হতো। আবার ভোরে তা তুলে এনে চলত কাজ। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এক শ’ পঞ্চাশ থেকে দু’শ’ বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত পতাকা তৈরি করে দেন নিজ হাতে। পতাকার দুই দিকেই যেন হলুদ কাপড়ের মানচিত্র দৃশ্যমান হয়, সেদিকে ভীষণ যতœবান ছিলেন তিনি। তার তুলতুলে হাতে তৈরি হয়েছে স্বাধীন বাংলার স্বপ্নের পতাকা।

এখন এসব কথা ভাবতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে যাওয়া দুটি চোখ চিকচিক করে ওঠে। গর্ব হয় এই মায়ের জন্য। যার হাতে তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার পতাকা। মুক্তিসংগ্রামে যা ছিল প্রেরণার অনন্ত উৎস। সম্প্রতি তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানান সব ইতিহাস। তার সেই সেলাই মেশিনটাকে তিনি যতœ করে রেখেছেন। এটাকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করে যেতে চান। তবে অধিকাংশ জায়গায় দেখা যায় সাধারণ মানুষের প্রাপ্তির অংশ কারও সামান্য কারও শূন্য।

দেশ আজ বিজয়ের পঞ্চাশে অতিক্রম করেছে। অথচ স্বাধীনতার পরবর্তী ইতিহাস সবাই আমরা জানি। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল, নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন শুধুই রক্ত ঝরেছে। দেশের জাতীয় পতাকা রাজাকারের গাড়িতে উড়েছে এটা কারও অজানা নয়। অথচ সুফিয়া হাফিজ মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্বীকৃতি পাননি। কোনো সম্মাননাও না। অনেক সংকটে মুক্তিযুদ্ধের আরেক অভিযাত্রী হাফিজুর রহমানকে নিয়ে সংসার তার নানা সংকটে।

ছেলেমেয়েরা নিজের সংসার সামলাতে ব্যস্ত। এ অবস্থায় কি করবেন তিনি? সুুফিয়া হাফিজ জানান তার ইচ্ছার কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরির সেই সেলাই মেশিনটা ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে’ দিয়ে দিতে চান তিনি। তার এই অবদানের কথা লেখা থাকুক এই জাদুঘরে। কিভাবে কি করে দিতে হবে, সেটা বাতলে দেওয়া যায় কি?
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক

×