ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ড. মুহাম্মদ সামাদ

প্রকাশিত: ০১:২২, ২৬ মার্চ ২০২৩

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, সর্বোপরিÑ উনিশ শ’ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ বা বাংলার স্বাধীনতা। প্রাণের মূল্যে, রক্তের মূল্যে অর্জিত বাংলার স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর সকল ভালোবাসা দিয়ে নির্মিত এক মহৎ কবিতা। 
পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মানুষের মুক্তির আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি কবি-লেখকদের ভূমিকা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে আমাদের এ অঞ্চলে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-ত্রাসন থেকে মুক্তি পেতে তৎকালীন বৃহত্তর ভারত ভূখ-ের স্বাধীনতা আন্দোলনে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানের সঞ্জীবনী শক্তি তৎকালীন ভারতবাসীকে অকাতরে কারাবরণের পথ বেছে নিতে; কারাগারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহের গান গাইতে; এমনকি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিপুত্র-অগ্নিকন্যাদের আত্মদানে পর্যন্ত অনুপ্রাণিত করেছে।

শোষণের বিরুদ্ধে সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতিবাদী কবিতা তাঁদের মুক্তির চেতনাকে শাণিত করেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ব্রিটিশরাজ প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট’ উপাধি ফিরিয়ে দেওয়া মুক্তিকামী ভারতবাসীর বুকে অসম সাহস সঞ্চার করেছে। বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা : ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,/কে বাঁচিতে চায়?/দাসত্বশৃঙ্খল কে পরিবে পায় হে,/কে পরিবে পায়।...সার্থক জীবন আর বাহু-বল তার হে,/বাহু-বল তার।/আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে,/দেশের উদ্ধার।’- এই স্বপ্নের ধ্বনিরা কি মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনকে উৎসাহিত করেনি?

এ ছাড়া তুরস্কের বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমাতের কবিতা; চিলির মুক্তির সংগ্রামে পাবলো নেরুদার কবিতা; ফিলিস্তিনের সশস্ত্র বিপ্লবে মাহমুদ দারবিশসহ অসংখ্য কবির আগুনঝরা কবিতার কথা মানুষ অনন্তকাল স্মরণে রেখে চলেছে। এভাবে মানব ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, দেশে দেশে মানবমুক্তির সংগ্রামে কবিদের প্রদীপ্ত উচ্চারণ সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে।   
একইভাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ বলে দেশমাতৃকার বন্দনায় ও ভালোবাসায় বাঙালি জাতির জেগে ওঠা; কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল্ র্ক রে লোপাট/... লাথি র্মা, ভাঙ্রে তালা!/যত সব বন্দী-শালায়- আগুন জ্বালা,/আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি।।’- একাত্তরে কারাগার ভেঙে হাতিয়ার তুলে নিয়ে মুক্তিপাগল বাঙালির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর...’ অথবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, ...’- এসব কবিতা বাংলাদেশের অফুরান ধানের, স্নিগ্ধ নদীর জলের, হলুদ কাঁঠাল পাতার, বিচিত্র ঘাসের, ফুলের, পাখির; লাল ঘুঙুরপরা কিশোরীর হাঁসের, হরিণের-ফড়িঙের; সুনীল আকাশের আর হেমন্তের কুয়াশার গন্ধে ভরা রূপসী বাংলার কোলে মাথা ঠেকাতে অধীর করে তোলে।

কিংবা ‘...নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’Ñ ১৯৭১ সালে বাংলার স্বাধীনতার আবাহনে শামসুর রাহমানের এমন কাব্যপঙ্ক্তি আমাদের প্রবলভাবে সাহসী ও উদ্দীপিত করেছে।  
বঙ্গবন্ধুর মহিমা কীর্তনে আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করি- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু মুজিবের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস। তাই, এই জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতিকে আমরা বলি- ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’।  কারণ, আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশে^ রাজনীতির কবি অভিধায় অভিষিক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রাম, ভাষণ-বক্তৃতা আর লেখালেখিও যেন মানুষের ভালোবাসায় অভিভূত এক মহৎ কবির শিল্পসুষমাম-িত সৃষ্টিসম্ভার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন খ-ের মহাকাব্যোপম আত্মজীবনী: অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১৭), কারাগারের রোজনামচা (২০২০) এবং আমার দেখা নয়া চীন (২০২১) পাঠ করলে প্রতিটি পঙ্ক্তিতে একজন স্বপ্নচারী শক্তিমান কবির সাবলীল কণ্ঠস্বর আমাদের হৃদয়-মনকে মথিত করে। গণমানুষের অফুরন্ত অনুপ্রেরণা ও মুক্তির উৎস তাঁর ভাষণের দোলায়িত ছন্দ ও কাব্যগুণ এতই শক্তিময় যে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তো বটেই, সারা দেশের অসংখ্য শিশু-কিশোর বঙ্গবন্ধুর অমৃত ভাষণ কণ্ঠে ধারণ করে জনসমাজকে প্রতিদিনই উদ্দীপ্ত করে চলেছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের সকল সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয় ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তারিখে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর লাখ লাখ জনতার মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- যা বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা। কেউ কেউ আবার ৭ মার্চের ভাষণে সুদূরপ্রসারী আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান: ‘...আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’ উক্তিটিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য বাঙালি জাতির বুকে সাহস সঞ্চারী চিরকালীন কাব্যপঙ্ক্তি রূপে মান্য করেন।  

প্রসঙ্গত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাপ্তাহিক সাময়িকী দি নিউজউইক-এর ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ অর্থাৎ রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়। উল্লেখ্য, ‘আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’Ñ এই ধ্রুপদী পঙ্ক্তিটি তার প্রসাদগুণে আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে অগণিত মুজিব অনুসারীদের কণ্ঠে অবিরত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্র্চলাইট’-এর নামে নিরীহ-নিরপরাধ বাঙালিদের হত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি হিংস্র হানাদার বাহিনী। পৃথিবীর ইতিহাসে এই বাংলাদেশে সংঘটিত হয় বর্বরতম গণহত্যা। ২৫ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি বাহিনী। গ্রেপ্তারে আগে পূর্ব-পরিকল্পনামাফিক বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেও আরেক শ্রেষ্ঠ কবিতা : ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন।

আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাই তাঁর ডাকে ত্বরিত সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, ছাত্র-তরুণ-তরুণী, শ্রমিক-কৃষক-কৃষাণী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা অস্ত্র হাতে পাকহানাদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়ায়। নয় মাসের সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখের অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতাÑ পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। 
আপনারা জানেন ও বিশ^াস করেনÑ সকল সুন্দরের শ্রেষ্ঠ সুন্দর হলো কবিতা। তাই, তুলনা করতে গিয়ে আমরা বলিÑ গল্প বা উপন্যাসটি যেন একটি সুন্দর কবিতা;  রূপসী মেয়েটি যেন একটি নিটোল কবিতা; একটি সুন্দর বক্তৃতাকে তাৎক্ষণিক তুলনা করি অসাধারণ কবিতা বলে। ইতিহাসের প্রবল ঘটনা বা বিজয়ের কাহিনীকে তুলনা করি মহাকাব্য হিসেবে। শিল্পসুষমায় সমৃদ্ধ এই কবিতা, কাব্য বা মহাকাব্যের স্রষ্টা হলেন কবি; এই কবি সর্বশেষ্ঠ ও সার্বভৌম মানুষ।

প্রাচীনকালে কাব্যরচনা ছিল জ্ঞানচর্চার সমার্থক। আমরা তো জানি, অতীতকালের প্রায় সকল দার্শনিক, গণিতশাস্ত্রবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানীÑ এমন কি চিকিৎসাশাস্ত্রবিদদের মধ্যেও কাব্যচর্চার রেওয়াজ ছিল। তাঁদের কারও-কারোর লেখার বাহন ছিল কাব্যভাষা। যেমন, বিশ^খ্যাত আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ-বিজ্ঞানী-কবি ইবনে সিনার রচনাসম্ভারের প্রায় অর্ধেকই ছন্দোবদ্ধ কাব্য ভাষায় লিখিত। ভাষার সূক্ষ্মতম ও সুন্দরতম রূপ এই কবিতার সঙ্গে যে কোনো মহৎ সৃষ্টির তুলনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। যে কোনো অনন্য সৃজনের স্রষ্টা মাত্রই একেকজন শ্রেষ্ঠ কবি। তাই কবি উপাধিটি সমাজের কীর্তিমান মানুষদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের স্বীকৃতিজ্ঞাপক।
জীবনানন্দ দাশের দৃষ্টিতেÑ ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’ তাঁর মতেÑ ‘...কবি তারাই যাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে; ...আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করার অবসর পায়।’ জীবনানন্দের এমন ব্যাখ্যায়Ñ কল্পনায়, চিন্তায়, অভিজ্ঞতায়, আধুনিক জগতের নতুন আলোয় উদ্ভাসিত এবং নানা রকম চরাচরের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কবি-পুরুষের ছবি আমাদের মানসপটে ফুটে ওঠে, তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান্তিমান অবয়বও আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সকল কবির সৃষ্টির প্রধান পাথেয় স্বপ্ন, সাহস ও ভালোবাসা। আশৈশব নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন, অসম সাহস ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাই প্রধান পাথেয় ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবের।

তাঁর শিল্পশৈলীসমৃদ্ধ রাজনীতির সোনালি ফসল এই স¦াধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে এক অনুপম সৃষ্টি ও মহৎ কবিতা। পিতা মুজিব রচিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশÑ বাঙালির এই প্রাণের কবিতাটিকে ভালোবেসে নতুন ছন্দে, নতুন গন্ধে, নতুন রঙে ও নতুন আলোয় প্রতিদিন-প্রতি মুহূর্তে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে চলেছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। তাই, বাংলার স্বাধীনতা আমার, আপনার ও অনাগত কালের সকল বাঙালির এক প্রিয়তম কবিতা। আসুন, বাংলাদেশের ৫২তম স্বাধীনতা দিবসে বাঙালি জাতির মুক্তির মহালগ্নে সমবেতকণ্ঠে গেয়ে উঠিÑ বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা।

লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ
[লেখাটি ৩৫তম জাতীয় কবিতা উৎসব ২০২৩-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ১ ফেব্রুয়ারিপ্রদত্ত সভাপতির ভাষণ 
অবলম্বনে রচিত] 

×