গ্রামের লোকের কাজকর্মের ধরনই এই রকম- কারো গায়ে একটা কিছু সিলমোহর মেরে দিতে পারলেই যেন স্বস্তি। ঘরের দেয়ালে বা বেড়ার গায়ে গোবরের চাপড়া দেয়ার মতোই অনেকটা। মানুষের পিঠেও অবলীলায় নানান প্রকার চাপড়া সেঁটে দেয়া হয়। তখন মানুষের পিতৃদত্ত নাম-পদবী আড়ালে মুখ লুকায়, দুর্গন্ধযুক্ত চাপড়াওলা নতুন পরিচয়টা মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়, লাউডগার মতো অতি দ্রুত ফনফনিয়ে পসার লাভ করে। এ গল্পের মরম আলীর হয়েছে তাই। কোনো এক মহররম মাসে জন্মসূত্রে তার নামকরণ হয় মহরম আলী। গ্রাম্য উচ্চারণে মহরমের অপভ্রংশ হয়েছে মরম আলী; কিন্তু এই লোকটির পরিচয় মরম পাগল হলো কবে কীভাবে! এতদিন পর কে বলবে সেই ইতিহাস! পাগলামির কিইবা এমন লক্ষণকে দেখেছে! অথচ পিঠে চাপড়ামারা এই নামটি তাকে বহন করতে হচ্ছে অনেক দিন থেকে। স্বেচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, দূর থেকে কেউ মরম পাগল বলে ডাকলে তাকে সাড়া দিতে হয়। এক সময় এই সম্বোধনে রাগ হতো, গায়ে ঘামাচি ফোটার মতো চিটপিট করত, ধীরে ধীরে এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। শুধু গা-সওয়া বলে তো কথা নয়, মাঝে মধ্যে গালভর্তি হাসি ছড়িয়ে সে যেন বা সমর্থনও জানায়। ছোট বড় নির্বিশেষে চারপাশের মানুষজনও তাকে পাগল ডেকে আরাম পায়। বারো মাস তো সে গ্রামে থাকে না, দু’তিন মাস পর গ্রামে এলে সে আর ওই আরাম নষ্ট করতে চায় না কারো। ঘাড় মাথা দুলিয়ে মেনেই নেয় এই অসত্য নামকরণ।
হ্যাঁ, অসত্য বই কি! মরম আলী কখনো পরনের লুঙ্গি খুলে রাস্তায় উলঙ্গ নৃত্য নাচেনি, থালা উল্টিয়ে মাটিতে ভাত মেখেও খায়নি, কারো পাকা ধানে মই দেবার মতো অঘটনও কখনো ঘটায়নি। তাহলে তার গায়ে পাগল সিলমোহর সেঁটে দেবার কী এমন যুক্তি থাকতে পারে! কিন্তু মরম পাগল বলে যারা, সেই সব গ্রাম্য লোকজন কি যুক্তির ধার ধারে! তারা সোজাসাপ্টা নাম ধরে সম্বোধন করার চেয়ে যে কোনো নামের গায়ে অলঙ্কার পরিয়ে স্বস্তি পায়, আনন্দ পায়। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে মরম আলীর আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জীবনযাপনের জন্যে সে কখনো প্রচলিত সাধারণ পেশা গ্রহণে আগ্রহী নয়। এ দিগরে কেউ কখনো যা করেনি, সেই রকম বিচিত্র তার পেশা। কখন যে সে গ্রামে থাকে আর কখন থাকে না, তার নেই ঠিক-ঠিকানা; দু’চার মাস পরে যখন সে গ্রামে ফেরে তখন তাকে দেখা যায় নতুন পেশায় নতুন চেহারায়। মরম পাগলের খেয়ালের শেষ আছে। গ্রামের লোক তার এই খেয়ালি স্বভাবের জন্যেই হয়তোবা নামের শেষে পাগল জুড়ে দিয়েছে, এমনও হতে পারে।
তা সেই মরম আলী যখনই গ্রামে ফিরুক, দিনে-রাতে যখনই হোক, সবার আগে তার মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়া চাই। বাড়ির সামনে এসে গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে মা মা বলে চিৎকার শুরু করবে। সে কী আকাশ-পাতাল চিৎকার! সেই চিৎকারে মরম আলীর মা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলে ভালো, নইলে সে পাড়ায় পাড়ায় চলল মায়ের সন্ধানে। নিজের বাড়ি বলতে চাটাইয়ের বেড়ার উপরে টিনের ছাপড়া দেয়া ঘর, বিলপাড়ার শেষমাথায় তার অবস্থান, একাকী সেই বাড়িতে কতক্ষণ থাকবে মরম আলীর মা। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। বাড়ির বাইরে বেরোতেই হয়। তাই নিয়ে মধু এবং বিষ মাখানো কতরকম কথা যে হাওয়ায় ভাসে, মূলহীন আলোকলতার মতো ডালপালা ছড়ায়। সেসব কথায় কান দিতে গেলে মরমের মায়ের চলে! সে খুব ভালো করেই জানেÑ এ হচ্ছে তার কপালের ফাঁড়া, ভরা যৌবনে বিধবা হবার পর থেকে ওই সব হুল ফোটানো কথার খোঁচা ধাক্কা দিতে দিতে বার্ধক্যের সীমানায় ঠেলে দিয়েছে বললেই চলে, তবু কদাকার কথার বেলুন ওড়া যেন শেষ হতেই চায় না। আউশ ধানের পোয়ালের ধোঁয়া যেমন নিঃশেষে নির্বাপিত হতে চায় না, এ যেন অনেকটা সেই রকম। অথচ মরম আলীর বউ-বাচ্চা যতদিন এখানে ছিল, সে বাড়ির বাইরেই যায়নি, নাতির সঙ্গেই কেটেছে তার দিন-রাত্রি। এখন তারা কেউ নেই বাড়িতে, মরম আলীর খেয়ালিপনাও বেড়ে গেছে।
বাড়ির বাইরে না গিয়ে কী করবে সে! নিরেট বাস্তবতা হচ্ছে পেটের ক্ষুধার দায় তো কেউ উপেক্ষা করতে পারে না! সেই কথাটুকুও যদি মরম আলী বুঝতে না চায়, তবে আর মানুষজন তাকে পাগল না বলে কী করবে! অথচ দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে বাড়ি এসে মাকে না পেলেই তার মাথা খারাপ হয়ে যায় এবং তখন সত্যিকারের পাগলের মতো উল্টোপাল্টা আস্ফালন করতে করতে বেরিয়ে পড়ে মাতৃ অন্বেষণে। মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে তবেই তার স্বস্তি।
মরম আলী এবার বাড়ি ফেরে মাডগার্ডহীন জীর্ণশীর্ণ এক সাইকেলে চেপে। জামা-কাপড় মলিন। মাথার চুল উসকোখুসকো। দিন পনেরোর না কামানো দাড়ি সারা গালে। এসবের কোনো কিছুতেই অবাক হবার কিছু নেই। মরম আলী তো এমনই অমার্জিত বেশবাসের একজন মানুষ। গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মরম আলীর কাঁধে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে থাকা বানরটির দিকে। সেও চোখে চোখে তাকায় কৌতুহলী মানুষজনের দিকে। মরম আলীর মাথার চুল এলোমেলো করে দেয়, নখের ডগায় উকুন তুলে নিয়ে আসে, একলাফে সাইকেলের হ্যান্ডেলের উপরে এসে বসে এক হাত তুলে সালাম জানায় আবার পরক্ষণেই জিভ ভেংচি কাটে। এসব দেখে শুনে বুঝতে কারো বাকি থাকে নাÑ বানর খেলা দেখানোই মরম পাগলের বর্তমান পেশা। এটাই এখন চলবে কিছুদিন, পরবর্তী পেশা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত।
পেশা বদলে সত্যিই তার জুড়ি নেই।
কিছুদিন তাকে দেখা গেল ‘দিল্লিকা লাড্ডু’ বিক্রি করতে। সামনে স্বচ্ছ কাচ লাগানো টিনের বাক্সের ভেতরে থরে থরে সাজানো দিল্লির নাড়ু। গোলাপী রঙের তুলোট বলাকৃতির ওই বস্তুকে গ্রামের লোক দিল্লির নাড়ু নামেই ভালো চেনে। অথচ মরম আলী বিশেষ কায়দায় ঘোষণা দেয়Ñ ‘দিল্লিকা লাড্ডু, যে খাবে সেও পস্তাবে, যে না খাবে সেও পস্তাবে।’ ছোট ছেলে-মেয়েরা তো না খেয়ে পস্তাতে রাজি নয়, কাজেই সবাই হাত বাড়িয়ে কান খাড়া করে থাকে, মরমের হাতে টুনটুনি ঘণ্টা বাজলেই ছুটে যায় লাড্ডু আনতে। পাড়াজুড়ে সে কী হইচই! শিশুদের দেখাদেখি গাল তোবড়ানো বুড়োবুড়িও এগিয়ে আসে, হাত বাড়িয়ে বায়না ধরে ‘দে তো ভাই আট আনার নাড়ু দে, খাই।’ বড়ই অদ্ভুত এই খাদ্যবস্তু মুখের গহ্বরে পুরে দিলেই হলো, দাঁতের কোনো ভূমিকা নেই, নিমেষেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। দেখতে দেখতে ব্যবসাটা বেশ সচল হয়ে উঠতে না উঠতেই ছিটগ্রস্ত মরম পাগলের মতিভ্রম হয়, বলা নেই কওয়া নেই, নিজে হাতে তৈরি করা ব্যবসা ফেলে একদিন হুট করে কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায় কেউ জানে না।
বেশ ক’মাস পরে মরম আলী গ্রামে ফিরে শুরু করে আরেক নতুন পেশা। এ গ্রামের কেউ কখনো যা দেখেনি, বলতে গেলে শোনেওনি, মরম হঠাৎ একদিন শুরু করে সেই কাজ। তার আগে সে কী প্রস্তুতি! টিনের ঢপের ভেতরে লুণ্ঠন বসিয়ে বিশেষ বাতির ব্যবস্থা, বাঁশের চাটাই-খিল এবং নেট দিয়ে বেঁধে ত্রিভূজাকৃতির অস্ত্রের আয়োজন, এ সবই নাকি ব্যাঙ ধরার কাজে ব্যবহার হবে। শুনে তো সবার চোখ কপালেÑ শেষে কিনা ব্যাঙ ধরবে তুমি। কী হবে ওই ব্যাঙ, ভেজে খাবে? প্রশ্নের ধরন দেখে মরম আলী মিটমিট করে হাসে। গ্রামের লোকের মূর্খতা আরো হাসির খোরাক যোগায়। সে কেন ভেজে খেতে যাবে, এ তল্লাটের কেউ ব্যাঙ ভেজে খায়। কারো বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ খেয়েছে। তাই বলে দুনিয়ার কেউ খায় না, এমন তো নয়! কত মানুষ সাপ টিকটিকি গিরগিটি পর্যন্ত গিলে খাচ্ছে, আর জলের প্রাণী ব্যাঙতো হচ্ছে মাছেদেরই মামাতো ভাই, মানুষ খাবে না কেন! যাদের অভ্যেস আছে তারা খাবে। সেই জন্যেই তো রাতের আঁধারে কাদাপাক হাতড়ে হাতড়ে চলছে এই ব্যাঙ শিকার, সেই ব্যাঙ নিয়ে শহরে গড়ে উঠেছে রমরমা ব্যবসা। গ্রামের মানুষ খোঁজখবর জানে না, অথচ বাধা দেবার বেলায় ঠিকই আছে। ব্যাঙ ধরলে নাকি বৃষ্টি হবে না, ছেলে-মেয়ের বিয়ে হবে না, বিয়ে হলেও সন্তানাদির মুখ দেখতে পাবে নাÑ এসব সাতকাহনের গাওনা শোনায় মুখ নেড়ে নেড়ে। সে সব কথায় পাত্তা দেয় না মরম আলী। কিন্তু সহসা একদিন মসজিদের ইমাম এসে পথ আগলে দাঁড়ায়, সোজাসাপটা জানিয়ে দেয়Ñ ইসলামে নিষেধ আছে এসব কাজকর্ম। এ ঘোষণা শোনার পর কী করে মরম আলী! মহাজনের কাছে একগাদা টাকা পড়ে আছে, সে এক দুশ্চিন্তা। অবশেষে মরমের মাও যখন নিষেধ করে, তখন সবার চোখের আড়ালে আবার একদিন গ্রাম থেকে তার অন্তর্ধান ঘটে।
তখন মরম আলীর মনে মনে দগ্ধায়, ঘরের দাওয়ায় বসে একা একা গুণগুণিয়ে কাঁদে। পেটে ধরেছে বটে, ছেলেকে ঘরে ধরে রাখতে পারে না বলে গভীর দুঃখ তার। সেই দুঃখের মোম হার্দিক উত্তাপে গলে গলে পড়ে। একমাত্র ছেলে মরমের বিয়ে দিয়ে ঘরে একটা লাল টুকটুকে বউ আনবার ইচ্ছে তার অনেক দিনের। বউটা যদি মাতৃহীন হয় তাহলে খুব ভালো হয়, মাতৃত্বের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারিত করবে। দৃশ্যাতীত মায়ার শিকলে তাকে বেঁধে রাখবে। এই সব স্বপ্ন সে দিনে দিনে থরে থরে সাজিয়েছে। একা একাই সাজায়, আবার একা একাই গুণগুণিয়ে কাঁদে। এ যেন সেই ছিন্নপাতায় তরণী সাজিয়ে একা একা খেলা করার মতো। না না, মরম আলীর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সেবার অনেকটাই মন ভিজিয়ে ফেলেছিল, মনে মনে পাত্রী নির্বাচনেও সে মনোযোগী হয়ে ওঠে, কিন্তু মসজিদের ইমামের এক কথায় কেমন করে যেন সব কিছু তছনছ হয়ে গেল। আবার তার মাথার ভেতরের পুরনো পোকাগুলো কিলবিল করে ওঠে, সবার অগোচরে আবারও সে নিরুদ্দেশ।
মরম আলী তারপরের বার বাড়ি ফেরে বেশখানিক বিলম্ব করেই। কেন এই বিলম্ব, বাড়ির বাইরের এ দিনগুলো সে কোথায় কাটায়, কীভাবে কাটায়, সে কথা কখনো কারও সামনে প্রকাশ করে না। চারপাশের লোকজন কানাঘুষা যতোই করুক, প্রকৃত সত্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। মরমের মা মনে মনে নানান রকম প্রশ্ন গুছিয়ে রাখে ঠিকই, কিন্তু ছেলে বাড়ি আসার পর এমনই আগ্রাসী কণ্ঠে ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে যে সব প্রস্তুতি সব প্রশ্ন বন্যায় ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতো নিমেষে হারিয়ে যায়। মরমের মা আঁচলে গিট দিয়ে আটকাতে চায় পুত্রধনকে।
বহু বছর পর মরম আলী সেবার মক্কা-মদিনার খেলা নিয়ে আসে গ্রামে। টিভি-ভিসিআর-ডিভিডির এই আধুনিক যুগে গোলাকার টিনের ফোঁকরে চোখ লাগিয়ে ওসব খেলা কে দেখতে যাবে! খুঁটির মাথায় তার টেনে টেনে পল্লী বিদ্যুত সমিতি গাঁ-গঞ্জের দোকানপাট পর্যন্ত ফকফকা করে দিয়েছে। টেলিভিশনে হিন্দি ড্যান্স সেখানে লেগেই আছে। তার ওপরে কেউ কেউ বুক তোলপাড় করা রঙিন ছবি এনে ডিভিডিতে লাগিয়ে দিনরাত খদ্দের আটকে রাখে। অনেকের ভাবনা হয়- এর মধ্যে মান্ধাতার আমলের মক্কা-মদিনার খেলা দিয়ে কী হবে! অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এ নিয়ে মরম আলীর চোখেমুখে মোটেই উদ্বেগের ছায়া দেখা যায় না। দিব্যি দু’হাতের আঙুলে তুড়ি মেরে ডুগডুগি বাজিয়ে সে মাকে জাপটে ধরে বলেÑ
মা, তুই মক্কা-মদিনার খেলা দেখবি?
জিজ্ঞাসা করে বটে, উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা না করেই সে উঠোনের মাঝখানে এই খেলার প্রধান সরঞ্জাম গোল গোল হাফডজন চোখওয়ালা টিনের বাক্সটি ফিট করে ফেলে এবং আঙুলের ডগায় ঝমঝুমি এঁটে আহ্বান জানায়Ñ হায়রে মজা লেগে গেল, আসেন সবাই দ্যাখেন ভালো, একাত্তরে যুদ্ধ হলো, লাখে লাখে মানুষ ম’লো...
যে দু’চারজন ছেলে-ছোকরা টিনের বাক্সে চোখ লাগিয়েছিল, তারা সহসা মাথা তুলে সকৌতুলে জানতে চায়Ñ নায়িকার ছবি নাই...?
আছে আছে। সব আছে। পরথমে দেশ বন্দনা... তারপরেতে... হঠাৎ হাতের ঝুমঝুমি বন্ধ করে মাথা পেঁচিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে নাটকীয়ভাবে বলে, তারপরেতে মায়ের বন্দনা। না না, মা আর দেশ তো একই কথা।
মরম আলী দু’হাত তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তারপর বলে, তোমরা একটু সবুর কর দিনি! আমি সবাইকে দ্যাখাব খেলা। আগে আমার মা, তারপর সবাই। এ প্রস্তাবে মরমের মা খুবই অস্বস্তি এবং কুণ্ঠিত বোধ করে। উঠোনভর্তি ছেলে-ছোকরার মধ্যে সে কেমন করে ওই টিনের বাক্সে চোখ লাগাতে যাবে! এসব কি ময়মুরুব্বির দেখার জিনিস! মরম আলীর আঙুলের ডগায় সাঁটা ঝুমঝুমি বেজে উঠতেই পাড়ার যত ছেলে-ছোকরা এসে উঠোন ভরিয়ে তুলেছে, এসব ঝক্মারি নাচন কুর্দন দেখবে ওরাই। ছেলে নাছোড় হয়ে কাঁধ জড়িয়ে ধরলে তখন মরমের মা কী করে! অগত্য টিনের বাক্সের গোলাকার ফোঁকরে চোখ লাগিয়ে মক্কা-মদিনার খেলা দেখতে শুরু করে। না, ধিতিং ধিতিং ড্যান্স-ট্যান্স নয়, রিল ঘুরিয়ে মরম আলী মুক্তিযুদ্ধের নানান ছবি প্রদর্শন করতে থাকে। সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, অসহযোগ আন্দোলন, মওলানা ভাসানীর লালটুপির মিছিল, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, অতপর পঁচিশে মার্চের ভয়াবহ গণহত্যা, মুজিবনগরে সরকার গঠনÑ এসব ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ গায়কী ঢংয়ে মরম আলী আপন মনে নেচে নেচে অগ্নিক্ষরা সেসব দিনরাত্রির বিবরণও শোনাতে থাকে। সেই বিবরণ শুনে উপস্থিত বয়স্ক দু’চারজন মানুষ ভীষণ অবাক হয়Ñ মরম পাগল মুক্তিযুদ্ধের এতসব কথা জানল কোথায়! একাত্তরে তার বয়স কত, বড়জোড় দেড়-দু’বছরের শিশু বই তো নয়! কিন্তু এ কী! মরমের মায়ের হঠাৎ কী হলো! মাথা ঘুরে পড়ে গেল নাকি! এ যে একেবারে দাঁতে কপাটি লেগে অচৈতন্য দশা!
সেবারের সেই দফায় চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে অনেক সেবাযতেœ মরমের মায়ের জ্ঞান ফিরে এলে কেমন যেন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকায়, মানুষের চোখে মুখে কী যেন খুঁজে ফেরে। তারপর ছেলেকে বুকের কাছে ডেকে নিয়ে নিম্নকণ্ঠে অনুযোগ করেÑ মেয়ি মান্ষির বেইজ্জতির ছবি আর দ্যাখাবা না বাপ। গুনাহ হবে।
চম্কে ওঠে মরম আলী।
মেয়ে মানুষের বেইজ্জতির ছবি আছে নাকি তার এই রিলের মধ্যে, মনে করতে চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুদ্ধ হয়েছে, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন-ধর্ষণ-হত্যা- নির্যাতনও হয়েছে বেপরোয়াভাবে; এসব কিছু মিলিয়েই তো মুক্তিযুদ্ধের ছবি। এতসব অপকর্ম যারা নির্বিচারে নয় মাস ধরে করেছে তাদের গুনাহ হবে না, মূর্খ মায়ের যুক্তি শোনো- সেই অপকর্মের ছবি দেখালেই গুনাহ। সে জিজ্ঞেস করেই বসেÑ
গুনাহ ক্যানে মা?
হাঁটুর উপরে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মরমের মা। খসে পড়া শাড়ির আঁচল ঠিকমতো গোছাতে গোছাতে এক খাবলা থুতু ফেলে উঠোনে, তারপর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে গজর গজর করে একজনমে কবার বেইজ্জতি হয় মানুষ! সেই জানোয়ারের পাল তো ইচ্ছিমতো বেইজ্জতি কইরিছে, এ্যাদ্দিন পর সেই ছবি দ্যাখালি আবার বেইজ্জতি হয় না!
কী জবাব দেবে মরম আলী! তার বিমূঢ় হাতের আঙুলে অচঞ্চল মুদ্রায় দাঁড়িয়ে থাকে ঝুমঝুমি। নতুন করে আর মক্কা-মদিনার খেলা শুরু করার উদ্যম খুঁজে পায় না সে। কোনো রকমে উপস্থিত জনতাকে আশ্বস্ত করেÑ আজ আর নয়, আগামীকাল সে সবাইকে দেখাবে মক্কা-মদিনার খেলা।
কে একজন ঘোষণা করে- কাল তাহলি ইসকুল মাঠে হবে কিন্তু!
পেশা-বদল মরম আলীর এক প্রকার নেশা হলেও মক্কা-মদিনার খেলা নিয়ে সে মজে থাকে দীর্ঘদিন। রঙিন টেলিভিশনের ঝলমলে পর্দার সচল সবাক নৃত্যকলার সঙ্গে লড়াই করা কঠিন জেনেও মরম কখনো হতাশ হয়নি। কোথায় কোন শহরে গিয়ে মহাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আধুনিক ছবি নিয়ে আসে, নতুন উদ্যমে বেরিয়ে পড়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে, সব বয়সের সব শ্রেণীর দর্শক-শ্রোতাকে আহ্বান জানায়- ‘আসেন আসেন দেখেন সবাই মজার মজার ছবি/ রাজা-রানি ফুলকুমারী আছে দেখেন সবই...। আসেন ভাই-বেরাদার আসেন বুবু ভাবী ইচ্ছে হলে পয়সা দেবেন, করব না কো দাবি।’ মরম আলীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ অনেকেই ছুটে আসে; মক্কা-মদিনার খেলা দেখে; টাকা-পয়সার দাবি করুক বা না-ই করুক। সবাই পয়সা দেয়। সামান্য সেই উপার্জনে মায়ে পুতের সংসার দিব্যি চলে যায়। কিন্তু এই খেলার সূত্র ধরেই একদিন তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে সংসারে। বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে খেয়ালি বালক যেন বা টুপ করে ছিঁড়ে আনে পছন্দের ফুলটি। হোক বুনোফুল, কী যে তার রূপের বাহার! মরমের মা আনন্দে আপ্লুত হয়, খুশিতে চোখের কোনা ভিজে ওঠে, আবার বুকের ভেতরে নিশিন্দার ডালে থেকে এক কালোপাখি ‘কু’ গেয়ে ওঠেÑ বুনোপাখি ঘরমানবে তো! গরিবের মেয়ের গা-ভরা রূপ থাকতে নেই, এ কথা সে খুব ভালো জানে!
তবে হ্যাঁ, সংসার জীবনে পা রাখার পর মরম আলীর বুকের ভেতরে ভয়ানক তোলপাড় হয়, নিকষ কালো আঁধার থেকে যেনবা তীব্র আলোর জগতে এসে দু’চোখ ঝল্সে যায়, এদিকে পায়ের তলে নদী ভাঙ্গনের টানে ফাটল মাটির হা-মুখ। বালিকাবধূ ময়নাপাখির রূপে মুগ্ধ প্রণয়ে দগ্ধ মরমের যেন তৃষ্ণা মেটে না কিছুতেই, স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ, মাথাভর্তি এক আকাশ কেশদাম দুলিয়ে সে একটুখানি চোখের আড়াল হলেই ডেকে ওঠেÑ ময়নাপাখি! মেয়েটির প্রকৃত নাম ঢাকা পড়ে যায় এই ময়নাপাখির পাখার আড়ালে। মরমের মা একান্তে ছেলেকে ডেকে বলেÑ ‘তোমার ময়না আমার বুকির উপরে থাকুক, ময়নাপাখির জন্যি দানাপানি যোগাড় করো বাপ, আয়-রোজগার বাড়াও!’
মরম আলী চোখ গোল করে তাকায়, ক্যানে মা, আমার যে মক্কা-মদিনার খেলা আছে!
ওসব খেলা দিয়ি আর কদ্দিন চলবে? ইবার কাজকম্ম দ্যাখো!
খেলা! মরম আলীর কানে ধাক্কা লাগে, এই খেলাই তো তার পেশা। আর কী এমন আয়-উপার্জনের পথই বা চেনে সে! তার বৈচিত্র্যপূর্ণ নানান পেশা নিয়ে চারপাশের মানুষজনের হাসাহাসির উত্তাপ যে গায়ে লাগে না এমন নয়, তাই বলে ময়নাপাখির মাথার দিঘল কেশদাম নিয়েও কেউ নির্মম মন্তব্য করতে পারে, তা কখনো ভাবেনি। একদা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মরম আলী মেয়েমানুষের মাথার পরিত্যক্ত লম্বা চুল কুড়িয়ে বা নামমাত্র মূল্যে কিনে শহরের মহাজনের কাছে বিক্রি করেছে। বেশিদিন টেকেনি সে পেশা। তবু এতদিন পরে কেউ যদি কটাক্ষ করে বলে মরম পাগল সেই সব চুল জোড়া দিয়ে বউয়ের মাথার লম্বা চুল বানিয়েছে, তখন সারা গায়ে বিজুতি-জ্বলুনি না ধরে পারে! মাথার চাঁদি পর্যন্ত জ্বলে যায়। কিন্তু সে মুখ বুজে তা সহ্য করে। এখন গর্ভধারিণী মাকে সে কী বলবে! পয়সা উপার্জন নয়, সে কি তবে শুধুই খেলা করে চলেছে! সংসারে আয়-ইনকাম বাড়ানোর জন্য মক্কা-মদিনার খেলা ছেড়ে তাকে অন্য পেশা ধরতে হবে! এরপর তাদের মাঝে নতুন মুখও আসবে, সেই সঙ্গে খরচও নিশ্চয় বাড়বে। তাহলে মরম আলী কী করবে! কোথায় যাবে, কোন পেশায়?
ভয়ানক গোলক ধাঁধায় পড়ে যায় মরম পাগল। গাঁও-গ্রামের মানুষ হলেও সে কখনো ক্ষেতখামারের কাজ শেখেনি। সত্যি বলতে কি কৃষিকাজে কোনোদিনই তার মন বসেনি। পিতৃহীন এতিম হিসেবে শৈশব-কৈশোর পর্যন্ত দশজনের দয়াদাক্ষিণ্যে করুণায় অবহেলায় কাটলেও এক সময় আয়-রোজগারের কথা ভেবেই গ্রাম ছেড়ে যায়। প্রথমে মাথায় আসে পিতৃপেশা দর্জিগিরির কথা। বাপের কোনো স্মৃতি তার সঞ্চয়ে নেই, লোকে তবু মুন্তাজ খলিফার ছেলে বলেই জানে তাকে; হুবহু বাপের মুখের আদল পেয়েছে। বাপের বন্ধু থানা শহরের ছাত্তার দর্জি শিক্ষানবিস হিসেবে বেশ কাছে টেনে নেয়। ঘনঘন তার মায়ের খবর জিজ্ঞেস করে, খোঁজখবর নেয়। কি বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কী এক দুর্বোধ্য কারণে তার মা সেই লোকটার নামই শুনতে পারে না। রে রে করে ওঠে, তার নামে থুতু ছিটায়। মরম তখন কী করে? বেশ ক’দিন কামাই দিয়ে বাড়িতে বসে থাকে। মায়ের মন বোঝার জন্যে শুধায়।
তালি পরে দর্জিগিরি শিখার দরকার নি মা?
মানা কচ্চে কিডা! যা না তোর বাপের দোস্তর কাছে যা!
ছাত্তার চাচা তো যাবার জন্যি খবর পাঠিয়েচে।
খবর পাঠিয়িচি! ইরপর দ্যাখপা সেই লোক নিজেই আসবে ডাকতি! আমি তাকে হাড়ে হাড়ে চিনি; হ্যাঁ।
মরম আলীর মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যায়। ছাত্তার দর্জি তো একবারও বদনাম করে না তার মায়ের কিংবা বাপের। বরং সে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেমন সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেÑ তোমার মা হচ্চে সোনার মানুষ। খাঁটি মানুষ। দুমড়ায় তো মচকায় না। ইস্পাত। বোতামঘাট বাঁধার ফাঁকে ফাঁকে কানখাড়া করে শোনে মরম। ছাত্তার দর্জি জানায়Ñ একাত্তরে তো কম ঝড় যায়নি। তার উপর দিয়ি! মুখ বুইজি সুহ্য কইরিছে সব। পাকসেনাদের হাতে স্বামী হারিয়িচি, নিজির ইজ্জত হারিয়িচে, তবু মাথা নোয়ন নি কারও কাছে!
বড় হতে হতে মরম আলী মায়ের এসব বৃত্তান্ত নানাজনের টুকরো মন্তব্য থেকে জেনেছে, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে, কখনো বা চোখ সরিয়ে নিয়েছে। সাত্তার দর্জি জানিয়েছে আরেক তথ্য- তোমার জন্যিই তার বাঁইচি থাকা। আর্মি ক্যাম্প থিকি উদ্ধার পাবার পর কেউ বাঁচে! তোমার মা বাঁইচিছে তোমাকে কোলে নিয়ি। ভালো জাগায় বিয়ির কতাও আমি বুইলিছি। সে হচ্ছে কাঠে কোপ মারা মানুষ! শোনে কারো কতা!
থানা শহরে গিয়ে পিতৃপেশার তালিম নেয়া আর হয় না মরম আলীর। ছাত্তার দর্জির টেলারিং শপে না ঢুকে আরও মাসখানেক পরে হাজির হয় সুলতান মেকারের সাইকেল সারাইয়ের দোকানে। সাইকেল মাটিতে উল্টিয়ে বনবন করে চাকা ঘুরানোর দৃশ্য খুবই ভালো লাগে। মেকানিক্সের কাজ শেখার চেয়ে চাকা ঘুরানোর খেলাতে অধিক আনন্দ তার। প্যাডেলে চাপ দিয়ে সাইকেলের চাকা ঘুরায় মরম, চাকা ঘোরে সাঁই সাঁই। সে দু’চোখ ভরে এই ঘূর্ণনের দৃশ্য দেখে। দৃশ্যের আড়ালে জীবনের চাকা যে আরও কত দ্রুত বেগে ঘুরে চলে, সেদিকে মোটেই ভ্রƒক্ষেপ নেই তার। ময়নাপাখি একটি পুত্রসন্তান উপহার দিলে মরমের চোখের ঘোর কাটতে শুরু করে। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। শিশুপুত্র খেলাচ্ছলে কোমল দুটি হাত বাড়ালে মরম আলীর বুকের মধ্যে অচেনা শিহরণ সৃষ্টি হয়, মনের মধ্যে অজানা ভীতির সঞ্চার হয়, সে যেন ভেবেই পায় নাÑ ওই দুটি কচি হাতের দাবি মেটাবে কী করে! গভীর রাতে ক্ষুৎপিপাসায় শিশুপুত্র ট্যাঁ করে উঠলে ময়নাপাখির ঘুম ভাঙার আগেই টের পেয়ে যায় মরম আলী। বিছানার উপরে উঠে বসে। ময়নার মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু তার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করে না। ক্রন্দনরত শিশুর দিকে তাকিয়ে অন্তরে মায়া জাগে, আবার ভীতিও জাগে; নিজের হাত বাড়াতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নেয়। পিতার আদল কি শিশুটিও ভয়ংকর কোনো ছায়া দুলে উঠতে দেখে! নইলে অমন তার স্বরে চিৎকার করে উঠবে কেন? সেই চিৎকারে ধসমস করে জেগে ওঠে ময়না; অবাক চোখে তাকায় ছেলে এবং ছেলের বাপের দিকে।
ছেলের ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনে স্বামীকে প্রশ্ন করেÑ
তুমি কী করছ বোলো দিনি!
মরম আলী ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো থতমত গলায় বলে,
কই, কিছু না তো!
ময়নার যেন বিশ্বাস হয় না। কচি শিশুকে কোলে তুলে নিতে নিতে সে গজ গজ করে ছেইলিডা কি তুমি গলা টিপি মাইরি ফ্যালবা?
মাতৃদুগ্ধের আস্বাদ পেয়ে শিশুকণ্ঠ থেমে গেছে। কিন্তু স্ত্রীর কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক মরম আলী। ধসনামা কণ্ঠে সে বলে,
এ কী বুলছিস তুই! আমি ওই ছেইলির বাপ না?
হুঁ! পাগলের আবার বাপ হওয়া!
আমি পাগল?
লোকে তো তাই বোলে!
এবার সত্যি আর কথা সরে না মরমের মুখে। স্তন্যপানে মগ্ন শিশুর দিক থেকেও সহসা মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথার চুল সজারু কাঁটার মতো খাড়া হয়ে যায়। শরীরের ভেতরে কী যেন গুলিয়ে উঠে। স্ত্রী এবং পুত্রের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠেÑ আমি পাগল!
সেই মধ্যরাতেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে মরম আলী। উঠোনের এ মাথা ও মাথা দৌড়ে বেড়ায়, লাফালাফি করে, অতপর সত্যিকারের পাগলের মতো গর্জন করে মাকে ডাকেÑ এই মা, আমি পাগল?
আকুল এই প্রশ্ন হাওয়াশূন্য স্তব্ধ রাতে দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলামের মতো বিরামহীন দোল খায়, কোথাও স্থির দাঁড়ায় না, প্রশ্নের উত্তরও মেলে না কিছুতেই। চাটাইয়ের ঝাপ সরিয়ে মরমের মা যখন উঠোনে নেমে আসে, ততক্ষণে উঠোন ফাঁকা; মরম পাগল যথার্থই নিরুদেশ যাত্রা করেছে। মরমের মা কোনো কিছু স্পষ্ট না বুঝেই বুকচাপড়ে মাতম শুরু করে ছেলের নামে। কয়েক মিনিট পর ময়নাপাখি এসে পাখা ঝাপটায় আহাজারি করে। কিন্তু এসবে কিছুই যায় আসে না মরম পাগলের।
অন্যান্যবারের পেশাবদল এবং বাড়ি ছেড়ে যাবার সাথে মরম পাগলের এবারের রহস্যময় অন্তর্ধানের মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে তার স্ত্রী-পুত্রের উপস্থিতির কারণে। অনেক সাধের ময়নাপাখিকে ছেড়ে কতদিন থাকবে সে! মরমের মায়েরও খুব মনের জোরÑ শুধু ময়না বলে তো নয়, ময়নাপাখির ছাও যে আছে সঙ্গে! মধ্যরাতের রাগঝাল হচ্ছে কচুপাতার পানি, গড়িয়ে পড়তে কতক্ষণ!
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এবারই মরম আলীর খবর নেই। অনেক দিন যাবত কোথায় আছে, কেমন আছে, কী করছেÑ কেউ জানে না। হাটে বাজারে কিংবা পথে-ঘাটে কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে। এমনও কথাও শোনা যায়নি। তাহলে লোকটা দিল্লির লাড্ডু হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! মায়ের জন্যে যার জান পোড়ে, ময়নাপাখি বউয়ের চোখ থেকে যে চোখ সরাতে পারেনা। পিতা হবার আনন্দে যে তারা ভরা আকাশে ডিগবাজি দিতে চায়; সেই লোকটা ঠুনকো এক কথায় ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেছে বলে ছ’মাস ন’মাসেও আর বাড়ি ফিরবে নাÑ তাই কিছুতেই হয়। চোখের সামনে ট্যাঁ করে কাঁদে নাতি। আছাড়ি পিছাড়ি আর্তনাদ করে বউমা; মরমের মা নিজের পেটের খিধে ভুলে থাকতে চায় কিন্তু পারে না ওদের দু’জনের জন্যে। দু’জনকেই অবুঝ শিশু মনে হয়। ক্ষুধার্ত শিশুকে আগলে রাখার কী ক্ষমতা আছে তার! ফলে মাস দুয়েক পরে ময়নার বাপ এসে একদিন ওদের দু’জনকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেলে সে কিছুই বলতে পারে না; আঁচলের কোনে চোখ মোছে আর ওদের চলে যাবার দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখে, নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে পথের দিকে।
অবশেষে আরও কয়েক মাস পর মরম পাগল বাড়ি ফেরে কাঁধে বানর নিয়ে। বাড়ি ফিরে অন্যান্যবারের মতো মাকেই খোঁজে সবার আগে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বিশেষ কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। তাদের কথা জিজ্ঞেসই করে না। মা ঘরের বাইরে এসে ছেলের কাঁধে বানর দেখে মুখের উপরে আঁচল টেনে ফ্যাঁচ করে কেঁদে ওঠে। বানরটা তখন সাইকেল বেয়ে মাটিতে নেমে মরমের মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে। তাই দেখে পাড়ার ছেলে ছোকরার দল হি হি করে হেসে ওঠে। মরম আলী তাদের ধমক দিয়ে থামাতে চায়। মায়ের সামনে এগিয়ে এসে শুধায়Ñ
কাঁদছিস ক্যানে মা?
কান্নার ভাঁজ খুলে মা বলে,
ঘরের মানুষির খরব নি। আর তুই কিনা বাঁদর নিয়ি নাইচি ব্যাড়াচ্চিস?
এক চিলতে শুকনো হাসি ফোটে মরম পাগলের ঠোঁটে। সে জানায়, মানুষির চায়ি বাঁদরই তো ভালো মা। ঐ যি তোমাকে সালাম করলু। আরও কত কী করবে, দেখতি পাবা।
ছেলে ছোকরার মধ্যে কে যেন প্রশ্ন করেÑ
অ মরম ভাই, তোমার বাঁদর কি টেনিং দিয়া বাঁদর?
মরম পাগল আজব কথা শুনিয়ে দেয়Ñ
ওকে টেনিং দেবে কিডা! আমিই ওর কাছে টেনিং নিই।
একথা শুনে সবাই হেসে ওঠে হো হো করে। দু’একজন প্রস্তাবও জানিয়ে রাখে। তাহলে তারাও বানরের কাছে ট্রেনিং নেবে। মরম আলী তাদের আশ্বস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বানর-দর্শনের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস এবং কৌতূহলী ভিড় কমে যাবার পরপরই মোটরসাইকেল ভটভটিয়ে হাজির হয় বরকত মেম্বর। না, মরম পাগলের বাড়ি ফেরার সংবাদ পেয়ে সে এসেছে এমন নয়। গ্রাম-সুবাদে মরমের মাকে সে নানি বলে ডাকে। এই নানির অভাব-অভিযোগে পাশে দাঁড়াতে না পারার জন্যে তার অন্তরেও গভীর দুঃখ আছে। বিশেষত গতবারের বিধবা ভাতা বিতরণের তালিকায় এই নানির নাম অন্তর্ভুক্ত করার পরও চেয়ারম্যানের গোয়ার্তুমির কারণে ফাইনাল লিস্ট থেকে নাম বাদ পড়ায় সে খুবই লজ্জিত। এইবার সে আটঘাট বেঁধেই নামতে চায়। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সঙ্গেও আলাপ করে রেখেছে। সেই শুভ উদ্যোগের কথা জানাতেই এই অবেলায় তার এখানে আসা। কিন্তু বহুদিন পর মরম পাগলকে এবং তার সঙ্গে একটা গেছে বানর দেখে হঠাৎ মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। গার্জেনগিরি ফলিয়ে বেশ বকাঝকাও করেÑ
এ সব পাগলামি আর কদ্দিন করবি বোল দিনি মামু!
মরম আর কী জবাব দেবে! ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এমন সোন্দর বউডা-ছেউলিডা কুতায় ফেললি, এ্যাঁ! প্যাটের দায়ে মেয়ি মানুষ কী না করে- তুই তার খবর রাখিস?
মরম আলী চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে বরকত মেম্বরের দিকে। কী যেন বলতে চায়, ঠোঁট বিড়বিড় করে, কিন্তু কিছুই বলা হয় না। বরকত মেম্বর স্মরণ করিয়ে দেয়, তুই যে একজন বীরাঙ্গনার ছেইলি, সেডা জানিস?
কান খাড়া করে মরম পাগল, বীরাঙ্গনা শব্দটি ভারি খটমটে মনে হয়। আগে দু’একবার কোথাও শুনলেও তার মানে জানে না। সে ভাবে, যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবিরা তার বাপকে গুলি করে হত্যা করছে বলেই সে শুনে এসেছে। বরকত মেম্বর কি সেই কথাই মনে করিয়ে দিতে চাইছে? এই সুবাদে শহীদ শব্দটির সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, ছাত্তার দর্জির মুখেও দু’একদিন শুনেছে; কিন্তু বীরাঙ্গনা মানে কী? বরকত মেম্বরের মুখের দিকে সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। দায়িত্বশীল মেম্বর ব্যাখ্যা করে শোনায়Ñ
তোর মার একখান ফটো তোলা লাগবে। দরখাস্তের সঙ্গে ছবি দিতি হবে, বুঝিছিস?
এতক্ষণে মুখ খোলে মরম পাগলÑ
মার ছবি ক্যানে মামু?
বরকত মেম্বর একগাল হেসে জানায়Ñ
সরকার ইবার বীরাঙ্গনাদেরও ভাতা দেচ্চে, শুনিস নি?
তার মানে?
চেষ্টা-তদবির করলি তোর মাও এই ভাতা পাবে। যুদ্ধের সময় তো কম নির্যাতন হয়নি তার ওপরে! তার ইজ্জতের কি দাম নি?
এক লহমায় মরম পাগল দুর্বোধ্য শব্দটির পূর্ণ মানে বুঝে যায়। সারা শরীর তার রি রি করে ওঠে। বরকত মেম্বরের মুখে এক খাবলা থুতু ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা না করে সে মেম্বরকে জানিয়ে দেয়, তার মায়ের জন্যে কোনোরকম ভাতা দরকার নেই। এখন থেকে মাকে ফেলে কোথাও যাবে না সে। তার মায়ের সব দায়িত্ব সে-ই পালন করবে। তার স্ত্রী-পুত্রকেও সেই দেখবে। কারও দয়া দেখানোর দরকার নেই।
বরকত মেম্বরের চোখের দিকে তাকিয়ে মরম পাগলের বানরটি এতক্ষণে মুখ ভ্যাংচানি দিয়ে ওঠে।