ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

শিশু-কিশোরদের মন সরল, কোমল ও পবিত্র, বলেছেন বিশ্বনবী

হাবিবুর রহমান সুজন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সাজেক, রাঙামাটি

প্রকাশিত: ১৪:৪৬, ১১ জুলাই ২০২৫

শিশু-কিশোরদের মন সরল, কোমল ও পবিত্র, বলেছেন বিশ্বনবী

ছবি: প্রতীকী

শিশুরা মানবসমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, সম্ভাবনার উৎস। জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ হয়ে তারাও পৃথিবীকে আলোকিত ও সমৃদ্ধ করবে। ঘুণেধরা সমাজের সব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সুন্দর সুশৃঙ্খল আর আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তারাও ভূমিকা পালন করবে।

শৈশবের নিবিড় পরিচর্যা ও সুন্দর প্রতিপালনই একটা শিশুকে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য করে তোলে। এজন্য আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) বলেছেন, শিশুদের প্রতি যত্নশীল হতে। শিশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আচরণ ছিল অনুকরণীয়। আমরা শিশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব? তাদের সঙ্গে পরিবারের বা কাছের মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত? শিশুর মেধা বিকাশে, চরিত্র গঠনে পরিবারের কী প্রভাব- এসব বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাজে, কথায় ও আচরণে।

প্রিয় নবী (সা.) শিশুদের খুব আদর-স্নেহ করতেন। অন্যদের তাদের প্রতি কোমল আচরণের নির্দেশ দিতেন। তাদের সঙ্গে দয়া ও সহানুভূতির আচরণের উপদেশ দিতেন। যারা শিশুদের সঙ্গে দয়ার আচরণ করে না, তাদের ভর্ৎসনা করতেন।

তিনি বলেছেন, ‘যে আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না এবং আমাদের বড়দের অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৪৩; জামে তিরমিজি, হাদিস : ২০৩২)

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার নবী করিম (সা.) তাঁর নাতি হাসান (রা.)-কে চুমু খেলেন। আকরা ইবনে হাবিস (রা.) পাশে বসা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ১০ জন সন্তান। একজনকেও আমি কখনো চুমু দিইনি।’ নবী করিম (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই যে দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৯৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩১৮)

শিশুদের অনুরাগ-অনুভূতির মূল্যায়ন করা

নবী করিম (সা.) শিশুদের চাহিদা ও অনুরাগ-অনুভূতির মূল্যায়ন করতেন। আদর-সোহাগ করে তাদের কাঁধে ওঠাতেন এবং তাদের শিশুসুলভ আচরণকে সহাস্যবদনে বরণ করে নিতেন।

শাদ্দাদ ইবনুল হাদ (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসুলে করিম (সা.) হাসান বা হুসাইনকে কোলে নিয়ে মাগরিব বা ইশার নামাজের উদ্দেশ্যে বের হলেন। তাকে পাশে রেখে তিনি সামনে অগ্রসর হলেন এবং তাকবির বলে নামাজ শুরু করলেন। নামাজের মাঝখানে একটি সিজদা খুব লম্বা করলেন। আমি মাথা ওঠালাম। দেখি, তিনি সিজদায়, আর শিশুটি তার পিঠে! আমি আবার সিজদায় চলে গেলাম।

নামাজ শেষ হলে সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজের মধ্যে একটি সিজদা অনেক দীর্ঘ করলেন! আমাদের তো আশঙ্কা হচ্ছিল, কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না তো! বা ভাবছিলাম, আপনার প্রতি কোনো ওহি নাজিল হলো! নবী করিম (সা.) বলেন, এগুলোর কোনোটিই ঘটেনি, বরং আমার এই ছেলে (নাতি) আমার ওপর সওয়ার হয়েছে। আমার পছন্দ হলো নাতার (শিশু মনের) ইচ্ছাটুকু পূরণ হওয়ার আগে তাকে সরিয়ে দিই। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১১৪১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৩২৮৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৬০৩৩)

আনন্দদানের জন্য শিশুদের কাঁধে ওঠানো

নবী করিম (সা.) শিশুদের আনন্দ দিতেন, কাঁধে চড়িয়ে তাদের আহ্লাদ-আবদার পূরণ করতেন। আবু কাতাদা (রা.) বলেন, একদিন আমরা মসজিদে বসা। নবীজি তাঁর কন্যা জয়নব (রা.)-এর মেয়ে উমামাকে কাঁধে করে আমাদের সামনে এলেন। (তিনি বলেন), এরপর নামাজের ইমামতি শুরু করলেন। উমামা তখনো নবীজির কাঁধে। রুকু করার সময় তাকে নামিয়ে রাখেন। সিজদা থেকে উঠে আবার উঠিয়ে নেন। পুরো নামাজ তিনি এভাবেই আদায় করলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৯৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৪৩)

শিশুদের সঙ্গে হাসি-আনন্দ

নবী করিম (সা.) কখনো কখনো শিশুদের সঙ্গে রসিকতা করতেন। হাসি-আনন্দ করতেন। আনাস (রা.) নবীজির খেদমত করতেন। তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল। নবীজি রসিকতা করে তাকে দুই কানওয়ালা বলে ডাকতেন। আনাস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) তাকে ‘হে দুই কানওয়ালা’ বলে ডেকেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজি তার সঙ্গে রসিকতা করে এভাবে ডেকেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫০০২; জামে তিরমিজি, হাদিস : ২১০৯)

উম্মে সুলাইম (রা.)-এর এক সন্তানের নাম ছিল আবু উমাইর। ছোট্ট শিশু। তার একটা ‘নুগাইর’ পাখি ছিল। সে এটা দিয়ে খেলা করত। আনাস (রা.) বলেন, উম্মে সুলাইম (রা.)-এর এক ছোট্ট ছেলে ছিল। নাম আবু উমাইর। তার একটা ‘নুগাইর পাখি ছিল। নবী করিম (সা.) যখনই উম্মে সুলাইম (রা.)-এর ঘরে আসতেন আবু উমাইরের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতেন। একদিন তার কাছে এসে দেখেন, তার মন খারাপ। বলেন, কী হলো আবু উমাইরের, মন খারাপ কেন? লোকেরা বলল, সে যে নুগাইর পাখিটা দিয়ে খেলা করত সেটা মারা গেছে। এর পর থেকে যখনই নবী করিম (সা.) তাকে দেখতেন, বলতেন, আবু উমাইর! তোমার নুগাইরটার কী হলো! (দেখছি না যে!) (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২০৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৫০)

শিশুর ভুলভ্রান্তি হলে বিরক্তি প্রকাশ না করা

শিশুদের কথা, কাজ, চলাফেরাসব কিছুতেই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তাদের ভুলভ্রান্তির জন্য ধমক দেওয়া, তিরস্কার করা বা বিরক্তি প্রকাশ করা ঠিক না। হ্যাঁ, কোমল শাসন তো করতেই হবে, যাতে সে সচেতন হয়। তবে তা হতে হবে সস্নেহ শাসন। সায়্যিদুনা আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি ১০ (বা নয়) বছর নবী করিম (সা.)-এর খিদমত করেছি, আল্লাহর কসম! কোনো দিন আমাকে ‘উফ’ বলেননি। আমি (অযাচিত) কোনো কিছু করে ফেললে বলেননিএটা কেন করলে? তেমনি কোনো কাজ না করলে বলেননিএটা কেন করলে না? (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭৩)

শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া

শিশুদের মন চঞ্চল। তারা খেলাধুলা করতে ভালোবাসে। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে আনন্দ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ। আয়েশা (রা.)-এর যখন বিবাহ হয় তখন তিনি ছোট ছিলেন। ফলে তিনি বান্ধবীদের সঙ্গে খেলতেন। তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-এর ঘরে পুতুল দিয়ে খেলা করতাম। আমার কয়েকজন বান্ধবী আমার সঙ্গে খেলত। নবীজি ঘরে এলে তারা লজ্জায় লুকিয়ে যেত। তখন তিনি একজন একজন করে তাদের আমার কাছে পাঠাতেন। তারা আবার আমার সঙ্গে খেলতে শুরু করত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৩০; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৪০)

শিশুদের ভীত ও আতঙ্কিত না করা

আবু লায়লা (রা.) বলেন, আমি রাসুলে করিম (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। হাসান বা হুসাইন নবীজির বুকে বসা। হঠাৎ দেখি সে ফিনকি দিয়ে প্রস্রাব করছে। (তাকে সরানোর জন্য) আমরা উঠলাম। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে (নাতিকে) প্রস্রাব শেষ করতে দাও। তাকে আতঙ্কিত কোরো না; প্রস্রাব শেষ করতে দাও। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৯০৫৯) একটু ভাবুন, শিশুদের প্রতি নবীজির দিল-মন কত প্রশস্ত ছিল!

শিশুদের জন্য বদদোয়া না করা

সন্তান মাতা-পিতার মেজাজ-বিরুদ্ধ কিছু করলে তারা যদি রাগ করে তার জন্য বদদোয়া করেন, আর আল্লাহ না করুনতাদের দোয়া কবুল হয়ে যায়, তাহলে লাভের কী হলো! সন্তান, মাতা-পিতা সবার জন্যই তো ক্ষতি ও কষ্টের কারণ হলো! রাসুলে করিম (সা.) ফরমান‘তোমরা নিজেদের জন্য বদদোয়া করো না। সন্তানদের জন্য বদদোয়া করো না। সম্পদের ওপর বদদোয়া করো না। (কারণ) এমন হতে পারে যে আল্লাহর কাছে দোয়া কবুল হওয়ার সময় তোমরা বদদোয়া করলে আর আল্লাহ তা কবুল করে নিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৩০০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৩২)

শিশুদের জন্য নেকদোয়া করা

শিশুদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর মায়া-মমতা ছিল বর্ণনাতীত। তাদের কল্যাণ কামনা করতেন। তাদের জন্য উন্নতি ও বরকতের দোয়া করতেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে মদিনার শিশুদের নিয়ে আসা হতো। নবীজি তাদের জন্য বরকতের দোয়া করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩৫৫)

শিশুর প্রতিপালনে আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

রাকিব

×