
পৃথিবী যতবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে যুদ্ধের বর্শাবিদ্ধ ঘায়ে, ততবার মানুষ শান্তির আর্তনাদে ডেকেছে আকাশের পানে। আর তখনই ভোরের বাতাসে ভেসে এসেছে এক শাশ্বত বাণী—ইসলাম। শব্দতাত্ত্বিক নয়, আত্মিক উচ্চারণে ‘ইসলাম’ মানে শান্তি, সমর্পণ, নিরাপত্তা—এ এমন এক ধ্রুপদী ধর্ম, যা কেবল বিশ্বাস নয়, একেবারে জীবনযাপনের একটি কাব্যিক দর্শন।
যখন মক্কার প্রান্তরজুড়ে ছড়িয়ে ছিল অজ্ঞতার অন্ধকার, নিষ্ঠুরতার দাবানল, তখন ইতিহাসের পটে আবির্ভূত হন এক মহামানব। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। একে একে উচ্চারিত হতে থাকে করুণাময় প্রভুর বাণী—
“আর আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি সমস্ত সৃষ্টির প্রতি রহমতস্বরূপ।”
(সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)
এই রহমত কোনো ধর্মীয় একচেটিয়াতা নয়; বরং তা ছুঁয়ে গেছে শিশুর চোখের কৌতূহলে, বেদনার্ত বিধবার দীর্ঘশ্বাসে, ক্ষুধার্ত পথচারীর জীর্ণ শরীরে। ইসলাম বলেছে—একজন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকলে, তুমি পরিপূর্ণ তৃপ্ত হতে পারো না। ইসলাম বলেছে—পৃথিবীর বুকে একটি গাছ রোপণ করাও ইবাদত, এবং একজন প্রতিবেশীর মুখে হাসি ফোটানোও জান্নাতের সোপান।
শান্তির এই মহাবাণী শুধু একক উদ্দেশ্যে নয়, এটি এক সার্বজনীন প্রার্থনা। মুসলমানের প্রতিটি সালাতের অন্তিম উচ্চারণ—“আসসালামু আলাইকম ওয়া রাহমাতুল্লাহ”—শান্তি তোমার ওপর বর্ষিত হোক—শুধু সাথের মানুষের জন্য নয়, গোটা সৃষ্টির প্রতি এই শান্তির শুভেচ্ছা।
রাসূল (সা.) বলেছিলেন,
“তোমরা প্রকৃত মুমিন তখনই হবে, যখন তোমাদের হাত ও মুখ থেকে অন্যরা নিরাপদে থাকবে।”
(সহিহ বুখারি)
এ এক সাহসী এবং স্নিগ্ধ আহ্বান। যখন প্রতিহিংসার ইতিহাস লেখা হচ্ছিল তলোয়ারের ডগায়, তখন ইসলামের ইতিহাস রচিত হচ্ছিল ক্ষমা আর সহানুভূতির কালিতে। তায়েফে রাসূলের ওপর যখন বর্ষিত হয় পাথরের বৃষ্টি, ফেরেশতা এসে বলেছিলেন—‘আপনি বলুন, আমি এই দুই পাহাড় একত্র করে শহরটিকে ধ্বংস করে দিই।’ রাসূল (সা.) এর উত্তরে বলেন, “না, আমি আশা করি, তাদের উত্তরসূরিরা একদিন আল্লাহর পথে আসবে।” এই যে অনন্ত দয়ার দৃশ্য—এটিই ইসলাম।
আধুনিক সমাজের অস্থির রাজনীতিতে, প্রযুক্তির জটাজালে, ভোগের হুল্লোড়ে আমরা যে শান্তির জন্য হাহাকার করি—ইসলাম সেই শান্তির ঠিকানা। যারা ইসলামকে কেবল নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ মনে করে, তারা ভুলে যায়—ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা মসজিদের মিহরাব থেকে শুরু করে বাজারের দরদাম, শিশুর কান্না থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতেও বলে শান্তির কথা।
কুরআনের পৃষ্ঠা জুড়ে শান্তির পংক্তি।
“আল্লাহ শান্তির ঘরে তোমাদের আহ্বান করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।”
(সূরা ইউনুস, আয়াত ২৫)
এই ঘর শুধু জান্নাত নয়, এটি দুনিয়ারও এক চিরসবুজ বাগান, যদি ইসলামকে তার প্রকৃত রূপে ধারণ করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ভুল ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বিদ্বেষের আগুনে আজ ইসলামকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়েছে এক ভ্রান্ত ভীতি। অথচ যারা কুরআনের কণ্ঠস্বর শোনেন, হাদিসের আলোয় চলেন—তারা জানেন, ইসলাম কোনো ‘বিপ্লবী আগুন’ নয়; বরং এক অনন্ত পরশ, যা অন্তরে নেমে আসে শান্তি হয়ে।
ইসলামের প্রতিটি অধ্যায় শান্তির ছন্দে বাঁধা। তার নবী ছিলেন অহিংসার এক জীবন্ত পাঠ। তার গ্রন্থ কুরআন এক অন্তর্জগতের অনুপ্রেরণা। তার মূলনীতি—ক্ষমা, করুণা ও সহানুভূতির মহাবিজ্ঞান।
এজন্যই বলা যায়, ইসলাম কেবল ধর্ম নয়—একটি সভ্যতা, একটি নৈতিক রেনেসাঁ, একটি চেতনার আলোকস্তম্ভ। আর তার কেন্দ্রবিন্দু একটিই—শান্তি।
আজকের পৃথিবী, যেখানে বিভেদ আর বিদ্বেষ বাড়ছে অবিরত, সেখানে ইসলাম এক নীরব আহ্বান—চলো, হাতে রাখো হাত, চোখে আনো করুণা, হৃদয়ে বপন করো ভালোবাসা। কারণ, একমাত্র শান্তিই পারে মানুষকে মানুষ করতে, সমাজকে সভ্য করে তুলতে, আর আত্মাকে পৌঁছে দিতে তার স্রষ্টার সান্নিধ্যে।
Jahan