
ছবি: জনকণ্ঠ
জুলাই পরবর্তী সময়ে দেশে সমসাময়িক রাজনৈতিক বন্দোবস্তে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে এসে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের কমিটির কথা প্রকাশ্যে আনতে শুরু করে। শিবিরের সম্পর্কে বিগত সময় তৈরি হওয়া ধারণা এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন সংগঠনটির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জনকণ্ঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা লুবনা শারমিন।
জনকণ্ঠঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের বেশ আয়োজন দেখা যায় , সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বা সাড়া কেমন পাচ্ছেন?
মুজাহিদ ফয়সালঃ দীর্ঘ একটা সময় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থান ছিলো না , একটি মাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য ছিলো। আগস্ট পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই জায়গা থেকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কার্যক্রমগুলোতে সাধারন শিক্ষার্থীদের সাড়া প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পেয়েছি ।কারণ দীর্ঘ একটা সময় আমরা ক্যাম্পাসের বাহিরে ছিলাম এবং আমাদের নিয়ে অনেক আলোচনা ছিলো। আমাদের নিয়ে টেরোরিস্ট সদস্যের সংগঠন হিসেবে, রগ কাটা আরও অনেক রকমের ট্যাবু ছিলো। এ ট্যাবু গুলো ভেঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের রেস্পন্স করেছে ,আপনারা দেখবেন যে প্রকাশনা উৎসবে , ত্রাণ বিতরণ প্রোগ্রামগুলোতে তাদের উপচে পড়া ভীড় ছিলো। সব মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেশ ভালো রেস্পন্স পেয়েছি।
জনকণ্ঠঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রশিবিরের প্রভাব কেমন?
মুজাহিদঃ হলগুলোতে প্রভাব বলতে ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটুকু এসেছে হলগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বা সিট বাণিজ্যের একটা কবর রচিত হয়েছে। সুষ্ঠু একটা নিয়ম পদ্ধতিতে মেধার ভিত্তিতে সিট বন্টন হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের সংগঠনেরও যারা কোয়ালিফাই করেছে তারাই হলে সিট পেয়েছে ।
জনকণ্ঠঃ হল কমিটি দেয়ার ব্যপারে আপনারা কি ভাবছেন?
মুজাহিদঃকেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনের মাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর আমাদের কমিটি গঠিত হয়। তারপর এক সপ্তাহের মধ্যে সারাদেশে ইউনিট পর্যায় পর্যন্ত কমিটি হয়। সেই ধারাবাহিকতায় জানুয়ারিতে আবার নতুন কমিটি হবে। আমরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। আর আমাদের হল সেট আপ আছে। তা বিভিন্ন প্রোগ্রামগুলোতেই আপনারা দেখতে পাবেন।
জনকণ্ঠঃ বর্তমানে ছাত্রদল,বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রশিবিরসহ বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন রাজনীতির মাঠে আছে । পূর্বে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বা মারামারির রেকর্ড রয়েছে। এক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে কতটা সহনশীল থাকবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির ?
মুজাহিদঃ ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনৈতিক সংঘর্ষ বা ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় কিন্তু ছাত্র নিহতের মতো ঘটনাও আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই ইসলামী ছাত্রশিবিরেরই ২১ জন ভাই ভিন্ন মতাদর্শের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেছেন । আমাদের প্রত্যাশা ২৪ পরবর্তী সময়ে যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলি তাতে পেশিশক্তি কিংবা আধিপত্য নির্ভর শোডাউনের রাজনীতি আর থাকবেনা।সকল ছাত্র সংগঠনই বাংলাদেশের জনসাধারণের এই সেন্টিমেন্টটা ধরতে পারবে এবং সেই আলোকেই রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করবে। আমরা দেখছি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনও এ বিষয়গুলো লক্ষ্য রেখে আগাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ছাত্র সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটবে না বলে আশা করছি।
জনকণ্ঠঃ শিবিরের পুরনো সংস্কৃতি নিয়ে একটা আলাপ আছে যে শিবির এক সময়ে রগ কাটতো…
মুজাহিদঃ আশির দশকের শেষে ৯০ দশকের শুরুতে মূলত এ ট্যাবুটা উঠে। আমাদের প্রতিপক্ষ বন্ধু ছাত্র সংগঠনগুলো আদর্শিকভাবে ইসলামি ছাত্রশিবিরকে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন ট্যাগিং রাজনীতি করেছে। ৯০ দশকের পর থেকে এ পর্যন্ত বিচারিকভাবে প্রমাণ হয় নি যে ইসলামি ছাত্রশিবির একটা ঘটনাতেও কোনো রগ কেটেছে । এটা এক ধরনের প্রোপাগানডা । আমি উদাহরণ দিতে পারি যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৭ সালে ভূতত্ত ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. এস তাহের স্যার হত্যা মামলায় ইসলামি ছাত্রশিবিরের তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতিকে ১ নাম্বার আসামি করে মামলার এজাহার দায়ের করা হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয় । সবশেষে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আমলেই তিনি বিচারিকভাবে খালাস পান। কিন্তু তখন এত মিডিয়ায় হেনস্তা এবং হত্যার সাথে ইসলামি ছাত্রশিবিরের সভাপতি জড়িত লেখালেখি হলো । তারপর কোনো মিডিয়া কভারেজ দেখেছেন যে ইসলামী ছাত্রশিবির এর সাথে জড়িত নয়? এমন অনেক ঘটনা আছে। এটা প্রতিপক্ষ সংগঠনের প্রোপাগান্ডার শিকার। যেমন আমাদের বন্ধু সংগঠন ছাত্রদল, তাদেরকে বলা হচ্ছে যে ট্যাম্পু স্ট্যান্ড বা বাম সংগঠনের বনধুদের বলা হচ্ছে যে শাহবাগী গোসল কর। আমরা চাই এ ধরনের সকল অপপ্রচারের রাজনীতিও বন্ধ হোক।
জনকণ্ঠঃ প্রতিপক্ষ মিডিয়ার পক্ষপাতমূলক অপপ্রচার হলে আপনাদের মিডিয়ায় সঠিক তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা নেন নি কেন?
মুজাহিদঃ ৯০ দশক বা ২০০৬ পর্যন্ত আমাদের মিডিয়া ছিলোই না। প্রিন্ট পত্রিকা হয়তো দু একটা ছিলো আর যদি ডানপন্থী মতাদর্শের হয় তাও প্রায় ২০০৯/১০ এর দিকে এসেছে। মিডিয়া যারা নিয়ন্ত্রন করে তার অধিকাংশই একই রাজনৈতিক মতাদর্শের। তার বিপরীতে ডানপন্থী মিডিয়ার এখনো ততটা স্ট্যাব্লিশমেন্ট নাই। যেমন আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্রদল অথবা ছাত্রশিবির বড় ছাত্রবান্ধব প্রোগ্রাম করছে, সে অনুযায়ী মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় নিউজ দেখা যায় না। কিন্তু অনেক সংগঠন যাদের ৫/৭ সংগঠন মিলে লোকবল ১০ জন হবে তা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় ভালো কাভারেজ পাচ্ছে।
জনকণ্ঠঃ কমিউনিকেশন গ্যাপের কারনে এমন হতে পারে কি ?
মুজাহিদঃ আমরা অনেক প্রোগ্রামেই অনেক মিডিয়াকে ইনভাইট করেছি, তাদের প্রতিনিধিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে হয়তো হাউস পলিসির কারণে কাভারেজ পায় নি। ।
জনকণ্ঠঃ জুলাই অভ্যুথান নিয়ে শোনা যায় যে সমন্বয়ক প্যানেলের একাংশ ছাত্রশিবিরের ……
মুজাহিদঃ তৎকালীন পরিস্থিতিতে সামর্থ্যের আলোকে আমরা ইসলামি ছাত্রশিবির সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এখানে ইসলামি ছাত্র শিবিরের বড় একটা ভুমিকা ছিলো। সমন্বয়ক পরিষদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশই ইসলামি ছাত্রশিবিরের।
জনকণ্ঠঃ একটা অংশ আত্মপ্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতেও কোনো আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা আছে ?
মুজাহিদঃ তা সময় বলে দেবে।
জনকণ্ঠঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীসংখ্যা কি তালিকাভুক্ত কিনা? এ তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে না কেনো ?
মুজাহিদঃ ছাত্রশিবিরকে স্তরভিত্তিক সংগঠন বলা হয়। আমাদের জনশক্তির মেম্বার,এসোসিয়েট, ওয়ার্কার, সাপোর্টার চারটি স্তর আছে। তালিকা প্রকাশ বলতে আমাদের অফিশিয়াল মিটিংগুলো প্রকাশ্যেই হচ্ছে। ব্যাসিক্যালি তালিকা বলতে বোঝায় হয়তো একটা কমিটির বড় তালিকা গণমাধ্যমে আসবে , কমিটিটা হবে একটা কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে, সেই কাউন্সিলের আগে ২/৩ মাস ধরে শোডাউন হবে ,বিভিন্ন হল থেকে ভাইদের নামে মিছিল আসবে, ব্যনার ফেস্টুনে ক্যাম্পাস ছেয়ে যাবে। নিজেদের এভাবে প্রদর্শনের প্রাকটিস ইসলামি ছাত্রশিবির করে না। আমরা প্রতিটা হলেই প্রায় ৯৫-৮৫% স্টুডেন্টদের রিচ করেছি। সেই হলের সদস্য , এসোসিয়েটরা প্রকাশ্যেই কাজ করেছে। যেহেতু আমরা ইসলামী ছাত্র সংগঠন ,ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নিজেকে প্রদর্শন করা যায় না। আমরা সবাই কার্যক্রমের দিক থেকে প্রকাশ্যে ।
জনকণ্ঠঃ রাকসু বিষয়ে পরিকল্পনা কি?
মুজাহিদঃ সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি রাকসু।ইসলামি ছাত্রশিবির দ্বায়িত্বশীল ছাত্র সংগঠন হিসেবে সবসময়ই রাক্সু চেয়েছে। আমাদের প্রত্যাশ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সঠিক সময়ে ইলেকশন সম্ভব হবে এবং দ্বায়িত্বশীল জায়গা থেকে ইসলামি ছাত্রশিবির এই নির্বাচনে অংশ নিবে।
জনকণ্ঠঃ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন নারীদের নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচী করলেও আপনারা করেন না।
মুজাহিদঃ কর্মসূচিতে মেয়েরা অংশগ্রহণ করে, তবে সংগঠনের মূল জায়গায় নাই। আমরা শুধুই ছাত্র সংগঠন ,এখানে ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করা হয় না। একই আদর্শের আলোকেই আরেকটা স্বতন্ত্র সংগঠন ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করে। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রমের কোনো যোগসূত্র নাই।
জনকণ্ঠঃ শরিয়ত অনুযায়ী নারীদের পর্দার বিষয় ইসলামে কিছু বিধান আছে। সেক্ষেত্রে নারীদের পোশাক কি রাষ্ট্র থেকে নির্ধারণ করে দেয়া ঠিক হবে?
মুজাহিদঃ মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া শরিয়তের স্পিরিচুয়াল জায়গা না। ইসলামের মূল জায়গা হচ্ছে প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবে। তবে কোনটা ইসলাম আর কোনটা ইসলাম নয় আল্লাহ তা বলে দিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ প্রতিটা মানুষকে নিজস্ব জ্ঞান দিয়েছেন এবং মানুষ তার নিজস্ব চিন্তাধারার আলোকেই সিদ্বান্ত নিবে। যেহেতু আল্লাহ নিজেই বিষয়টা ঐচ্ছিক করে দিয়েছেন কোনো সংগঠন মানুষের উপর জোর করে তা চাপিয়ে দিতে পারে না।
শিহাব