ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১

পুরান ঢাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে বড় দুই দলে সম্ভাব্য প্রার্থীর ছড়া

​​​​​​​শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পুরান ঢাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে  বড় দুই দলে সম্ভাব্য প্রার্থীর ছড়া

.

রাজধানীর পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এলাকা লালবাগ, চকবাজার, বংশাল কোতোয়ালি থানার একাংশ নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ঢাকা- আসন।  আসন থেকে যিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, পুরান ঢাকায় তারই বেশি আধিপত্য থাকে। তাই প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এলাকায় বিজয়ী হতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থাকে তীব্র প্রতিযোগিতা। এবারও আসনটি ধরে রাখতে আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই দলেই সম্ভাব্য প্রার্থীর ছড়াছড়ি। অন্যান্য দলের প্রার্থীরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র তিন মাস বাকি। তাই নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। ঢাকা- আসনও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ। নিজ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তারা।

জাতীয় সংসদের ১৮০ (ঢাকা-) আসনের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের বড় বড় ছবি সংবলিত ব্যানার, পোস্টার প্ল্যাকার্ড সাঁটিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। আর তাদের কর্মী-সমর্থকরা এলাকায় বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকান্ড  সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রার্থী সম্পর্কে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এলাকায় মাঠে সক্রিয় রয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা। এর মধ্যে বেশিরভাগই নৌকা ধানের শীষের টিকিট প্রত্যাশী। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা চান আসনটি ধরে রাখতে আর বিএনপির প্রার্থীরা চান দেড় দশক পর আসনটি পুনরুদ্ধার করতে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা জোরেশোরে নির্বাচনী গণসংযোগ করলেও বিএনপিসহ কয়েকটি দল নীরবে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না তা নিয়ে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেও বিএনপি ভিন্ন কৌশলে গণসংযোগ করছে। এই এলাকার সর্বস্তরের মানুষ অধিকতর রাজনৈতিক সচেতন। তাই তারা আগেভাগেই চিন্তা-ভাবনা করছেন কোন দলের প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে এলাকাবাসী বেশি উপকৃত হবেন।

ঢাকা- আসনটি বর্তমানে আওয়ামী লীগের দখলে থাকায় আবারও আসনে জয়লাভ করতে চান দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। সেভাবেই নির্বাচনী প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তবে এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যায়। এদিকে প্রায় ১৫ বছর আসনটি বিএনপির হাতছাড়া হওয়ায় এবার তা ফিরে পেতে চায় দলটির নেতাকর্মীরা। তাই স্থানীয় বিএনপি নেতারা চুপে চুপে ব্যাপক গণসংযোগ চালাচ্ছেন বলে জানা যায়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে ঢাকা- আসনটি ওই দলের বেদখলে। এরপর টানা তিনবার অর্থাৎ নবম, দশম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনে বিজয়ী হয়। প্রায় ১৫ বছর  আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকা- আসন এলাকায়ও ব্যাপক উন্নয়ন হয়। কারণে, আওয়ামী লীগের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে সক্রিয় থাকায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আপাতত কিছুটা অনৈক্য থাকলেও ভোটের আগে সবাই নৌকার পক্ষেই কাজ করবেন বলে জানা যায়। 

ঢাকা- আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। এর আগেও তিনি দুইবার এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ এবং কণ্ঠনালীর সমস্যার কারণে স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন না। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরাও করতে পারেন না। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মামলাও চলমান আছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার প্রার্থিতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে হাজী সেলিম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে হারিয়ে চমক দেখান তিনি। তবে তিনি আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা হওয়ায় আসনটি আওয়ামী লীগেরই থেকে যায়। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। আগে তিনি পুরান ঢাকার সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সকল কর্মকান্ডে শরিক থাকলেও এখন বিভিন্ন কারণে তার সঙ্গে কারও কারও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যায়। এলাকার মানুষের সুখে-দুখে থাকা হাজী সেলিম এখন আর সেভাবে সক্রিয় না থাকায় আওয়ামী লীগের একটা অংশ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী পরিবর্তন চায়। তবে হাজী সেলিম তার বিকল্প মনে করছেন বড় ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমকে। কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই হাজী সেলিমের ছেলেকে যোগ্য প্রার্থী মনে করছেন না।

ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার এই এলাকা থেকে এবার আওয়ামী লীগের অন্যতম মনোনয়ন প্রত্যাশী দলের সভাপতিম-লীর সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি বর্তমানে চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি। ২০০৮ সালে তিনি বিএনপির প্রার্থী নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি স্যার সলিমউল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায়ই এলাকার মানুষের কাছে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ব্যাপক জনপ্রিয়। তাই তিনি এবার ঢাকা- আসন থেকে নৌকার টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। সেইসঙ্গে এলাকাবাসীর সঙ্গে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন।

এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে আরও দৌড়ঝাঁপ করছেন কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শরফুদ্দিন আহমেদ সেন্টু সাংগঠনিক সম্পাদক আক্তার হোসেন, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকসহ বেশ কয়েকজন। তারাও বিভিন্নভাবে এলাকাবাসীর সঙ্গে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকা- আসন থেকে এবার বিএনপির মনোনয়ন পেতে যারা দৌড়ঝাঁপ করছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন দলীয় প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোশাররফ হোসেন খোকন, দলের কেন্দ্রীয় নেতা মীর নেওয়াজ আলী, হামিদুর রহমান হামিদ যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার। বিএনপি হাইকমান্ড দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলায় অন্যান্য সংসদীয় এলাকার মতো ঢাকা- আসনেও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে নির্বাচনী গণসংযোগ না চালিয়ে গোপনে যাবতীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা যায়।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা- আসন থেকে নির্বাচন করেন গণফোরামের বর্তমান সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু। তার দল গণফোরাম এবারও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে আছে। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে এবং মন্টুর গণফোরাম বিএনপির সঙ্গে থাকলে আসনটি এবার তাকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন দলের আরও কয়েকজন নেতা এই আসন থেকে নির্বাচন করতে চান বলে এলাকাবাসী জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন কর্মী জানান, এলাকা আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি। তাই দল থেকে নৌকা প্রতীক যাকে দেওয়া হবে, তিনিই ভোটের লড়াইয়ে ভালো অবস্থানে থাকবেন। তবে ভোটাররা দেখবেন এলাকার মানুষের সঙ্গে কার সম্পর্ক বেশি। কাকে সুখে-দুখে সবসময় কাছে পাওয়া যায়। এলাকায় কার জনপ্রিয়তা বেশি সেটি যাচাই করে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থী দেওয়া হলে ভাল করবে আওয়ামী লীগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই এলাকার একজন বিএনপি কর্মী জানান, প্রকাশ্যে দলের কার্যক্রম চোখে না পড়লেও এলাকায় বিএনপির অনেক ভোট আছে। আর দলের বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত যাকে প্রার্থী করা হবে, তার পক্ষেই সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।

ঢাকা- আসনটি রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী লালবাগ, চকবাজার থানা, বংশাল, কোতোয়ালিহাজারীবাগ ধানমন্ডি থানার একাংশ নিয়ে গঠিত। এর সীমানা হচ্ছে পূর্বে নাজিরাবাজার, পশ্চিমে হাজারীবাগ, উত্তরে পলাশী দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কেেপারেশনের ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৫ এবং ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড আসনে পড়েছে। ঢাকা- আসনে ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ২৮ হাজার ২৬৯ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৭৫ হাজার ২৫০ জন আর নারী ভোটার ছিলেন এক লাখ ৫৩ হাজার ১৯ জন।

বর্তমানে ঢাকা- আসনটি যে এলাকা নিয়ে গঠিত সেই এলাকা থেকে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেএম শামসুল হুদা। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন বিএনপির আব্দুল হাই। এরপর ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির হারুন অর রশিদ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন, ১৯৯১ সালে বিএনপির মীর শওকত আলী, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের হাজী সেলিম ২০০১                সালে বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু নির্বাচিত হন। আর ওয়ান-ইলেভেনের পর সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনের পর ঢাকা- আসন থেকে ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং ২০১৪ ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের হাজী সেলিম।

×