ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

আজ দেশে ফিরছেন রওশন এরশাদ

দেবর-ভাবি বিরোধ বাড়ার শঙ্কা জাতীয় পার্টিতে

বিকাশ দত্ত

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ২৬ নভেম্বর ২০২২

দেবর-ভাবি বিরোধ বাড়ার শঙ্কা জাতীয় পার্টিতে

জাতীয় পার্টি এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা

জাতীয় পার্টি এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। বর্তমানে জাপার তিনটি ধারা তিনদিকে অগ্রসর হচ্ছে। জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ আজ রবিবার দেশে আসছেন। তিনি দেশে ফিরেই নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেবেন। অন্যদিকে জাপার চেয়ারম্যান বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের দলের মধ্যে কোন্দল ও আইনগত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। অপরদিকে জাতীয় পার্টি (জাপা) পুনর্গঠনের ডাক দিয়েছেন বিদিশা সিদ্দিক। তার ডাকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। সব মিলে জাতীয় পার্টিতে এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
রওশন এরশাদের দেশে আসার খবরে নেতাকর্মীরা অনেকটাই উচ্ছ্বসিত। অন্যদিকে আদালতের আদেশ ভঙ্গের অভিযোগ এনে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করেছেন দলটির বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা। তাতে জিএম কাদেরপন্থী নেতাকর্মীরা অনেকটা হতাশ। তারা বিষয়টি আইনগতভাবেই মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলের অনেকেই আশঙ্কা করছে, রওশন এরশাদ দেশে আসার পর দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় রওশন এরশাদ বিমানযোগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামবেন। নির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভিআইপি লাউঞ্জ গেটে উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে তিনি বক্তব্য রাখবেন। বিশ্ব পরিস্থিতি, দেশীয় রাজনীতি, দলে চলমান অস্থিরতা ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছানো বিভ্রান্ত তথ্যের বিষয় তার বক্তব্য তুলে ধরবেন।

অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের দুর্নীতি ও ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে কথা বলবেন। এসব বিষয়ে তিনি নিজ দলের অবস্থান তুলে ধরবেন। এছাড়া আসন্ন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান ও লাঙ্গলের প্রার্থী ঘোষণা করবেন রওশন এরশাদ।

এয়ারপোর্টে বিরোধী দলীয় নেতাকে সংবর্ধনা জানানো হবে। এজন্য নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশ থেকে লোক সমাবেশ ঘটানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেল পর্যন্ত সড়ক দ্বীপ ও রাস্তার দু’পাশে লাগানো হবে রং বেরংয়ের ব্যানার-ফেস্টুন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে অতীতের মতো রাজনীতিতে তত ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে জাতীয় পার্টি। চলছে নানা গুঞ্জন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টির জোট হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের আগে ডিগবাজি দিয়ে আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থেকে যায় কি না সেটাও দেখার বিষয়।

এ প্রসঙ্গে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুু বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে কোনো গ্রুপিং নেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রেখে যাওয়া জাতীয় পার্টি এখন গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। বরং অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে জাতীয় পার্টি অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের নেতৃত্বে জনগণের কল্যাণে আমরা আগামীতে যেন ক্ষমতায় যেতে পারি সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

তিনশত আসনে প্রার্থী দেবো। মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে আদালত আদেশ দিয়েছে। আমরা আদালতের রায়ের প্রতি শতভাগ আস্থা রাখি। আশা করি, আমরা ন্যায়বিচার পাব। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে দলের বিরুদ্ধে দায়ের করা ষড়যন্ত্রমূলক সব মামলা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাব। হামলা-মামলা কিংবা অন্য কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র করে জাতীয় পার্টির অগ্রযাত্রাকে কেউ থামাতে পারবে না।

অন্যদিকে জাতীয় পার্টি ও বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র মো. মামুনুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, একটু ধৈর্য ধরুন। আমাদের নেত্রী রওশন এরশাদ সবকিছু বলবেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী দেশে ফিরে আসার পরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আমরা বলতে চাই, বিচারবিভাগ স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করবে এবং আমরা ন্যায়বিচার পাবো বলে আশা করছি। আমরা নির্বাচনের জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ বিষয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী সবকিছু পরিষ্কার করবেন। বিদিশা সিদ্দিকীকে কয়েকবার এই প্রতিনিধি ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

দলীয় কোন্দল, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে প্রতি নেতাকর্মীদের অবিশ্বাস ও অনাস্থা-এসবসহ নানাবিধ সংকটে ভুগছে সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি। এছাড়া দলে রয়েছে পদ নিয়ে নেতায় নেতায় কোন্দল। এই কোন্দল দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিলেও নেতাকর্মীদের ভেতরের এই কোন্দল দূর করে এক কাতারে আনতে পারেননি।

বরং বিতর্কিত ও অযোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া, তৃণমূলের মতামত ছাড়া বিভিন্ন সময় জেলা-উপজেলা ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিতর্কিত কমিটি গঠন, কমিটিতে যখন তখন পদায়ন, প্রমোশন, বহিষ্কার ইত্যাদি কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রুপিং ও আরও কোন্দল বেড়েছে। যার কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য যোগ্য প্রার্থীর সংকট  তৈরি হয়েছে দলটিতে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব কিছুটা স্তিমিত হলেও রওশন এরশাদ দেশে ফেরার পর আবার কোন্দল প্রকাশ্যে আসতে পারে। বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা এবং পার্টির কাউন্সিল নিয়ে দুই গ্রুপ সাপে নেউলে সম্পর্ক। রওশন পন্থীদের সাফ কথা, নেত্রী দেশে ফেরার পর পরই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

প্রাথমিকভাবে ১ জানুয়ারি কাউন্সিলের দিনটি ধার্য করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে জিএম কাদেরপন্থীরাও বসে নেই। তারাও রাজনৈতিকভাবেই বিষয়গুলো মোকাবিলা করবেন বলে জানা গেছে। আদালতের বিষয়টি মীমাংসার জন্য জিএম কাদের উচ্চ আদালতে যাবেন।
এদিকে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জাতীয় পার্টি।

চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে। এই বলয়টি কোনোভাবেই আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চান না। তারা ভেতরে ভেতরে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার পক্ষে। কারও কারও মতে এই যোগাযোগ বেশ জোরেশোরেই চলছে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই নির্বাচন করবে। তিনি রবিবার দেশে ফেরার পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট করবেন বলে জানা গেছে।
ফুসফুসের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছেন রওশন এরশাদ। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে থাইল্যান্ডে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
অন্যদিকে আদালতের আদেশ ভঙ্গের অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন দলটির বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা।
গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে জিয়াউল হক মৃধা বলেন, জিএম কাদেরের সমর্থক নেতা-কর্মীরা আমাদের ওপরে যে কোনো সময় হামলা করতে পারে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। নিরাপত্তার জন্য আমরা আদালত ও সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। দীর্ঘপথ চলায় এই দল থেকে অনেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল গঠন করেন। কিন্তু মূল দল হিসেবে দেশের রাজনীতিতে ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন ছিল ৩২টি, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৭টি, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩৪টি আসন পায় দলটি। আর বর্তমানে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ২৬ জন।

×