ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে বিএনপির

শরীফুল ইসলাম 

প্রকাশিত: ১২:১০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে বিএনপির

বিএনপির লগো

প্রায় দুই যুগ একজোটে রাজনীতি করার পর অবশেষে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী চাপে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে আপাতত দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে। তবে, জামায়াত যাতে বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রেখেই বিএনপি তাদের কর্মকাÐ চালিয়ে যেতে চায়। 

দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপির ওপর দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপ ছিল। কিন্তু জামায়াতের ভোটব্যাংক ও রাজপথের কর্মসূচী পালনের কথা চিন্তা করে দলটির সঙ্গ ত্যাগ করতে চায়নি বিএনপি। এবারও নির্বাচন সামনে রেখে যখন বিএনপি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লবিং জোরদার শুরু করে তখন তাদের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে থাকা জামায়াতের বিষয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসে। 

এ পরিস্থিতিতে সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে কোন কর্মসূচী পালন না করার কৌশল নেয় বিএনপি। কিন্তু বিএনপির চরম দুর্দিনের জোটসঙ্গী জামায়াত বিএনপির এই অবস্থানকে ভালভাবে নিচ্ছে না। ইদানীং মাঝেমধ্যেই বিএনপি ও জামায়াত নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। বিএনপির একটি অংশ চাচ্ছে দূরত্ব বজায় রেখে হলেও জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচী যাতে জামায়াতও নিজ অবস্থানে থেকে পালন করতে পারে সেরকম একটি সুযোগ রাখতে। তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে একমত হওয়া কিছু বাম দল তা চাচ্ছে না। 
 
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচী জোরদার করার চেষ্টা করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ২ মাসের লাগাতার সমাবেশ কর্মসূচী শেষ করে আবারও দুই মাসব্যাপী গণসমাবেশ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। অতীতে এ ধরনের আন্দোলনে বিএনপি তাদের শরিক দল জামায়াতকে সম্পৃক্ত করলেও এবার তা করেনি। এ ছাড়া সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে প্রায় দুইডজন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপি সংলাপ করলেও জামায়াতের সঙ্গে করেনি। আর এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেও দুই দলের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। ফলস্বরূপ উভয় দলের নেতারা এখন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। 

সম্প্রতি জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান দলের ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিএনপি জোটের সঙ্গে তারা আর নেই। জোটে না থাকার জন্য তিনি বিএনপিকেই দায়ী করেন। এক পর্যায়ে তার এই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এ বিষয়ে জামায়াতের অন্য নেতারা বলেন, ডাঃ শফিকুর রহমান প্রকাশ্যে এ ধরনের কথা বলেননি, তিনি নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন। 

তাই জামায়াতের ২০ দলীয় জোট ছাড়ার কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বা আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি। আর এ বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি জানান, জামায়ত ২০ দলীয় জোটে ছিল, এখনও আছে। ভবিষ্যতে জামায়াত কি করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত তারা নেবে। আর আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নেব।  

সূত্র জানায়, যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে এখনও বিএনপি সংলাপ না করলেও তারা যে নিজের অবস্থানে থেকে ওই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারবে না এমন কিছু বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়নি। বিএনপি এ বিষয়ে সরাসরি কিছু না বলায় জামায়াত মনোক্ষুণœ হয়। তাই জামায়াত নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সিনিয়র নেতা কর্নেল (অব) অলি আহমেদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে। 

এ পরিস্থিতিতে কর্নেল (অব) অলি আহমেদ সম্প্রতি তার দল এলডিপির এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের একজন সিনিয়র নেতাকে পাশে বসিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, এখন আমার সঙ্গে জামায়াত আছে, এখন বিএনপি যদি আমার পাশে আসে তাহলে আওয়ামী লীগ জান বাঁচানোর পথ খুঁজে পাবে না। তবে জামায়াতের সঙ্গে হঠাৎ করে কর্নেল অলির এ সম্পর্ককে ভালভাবে নেয়নি বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। 

রাজধানীর হাজারীবাগে ২৬ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াত সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধী দল। কিন্তু এখন জামায়াত ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পরকীয়া চলছে। তাই এখন আর বিএনপি-জামায়াত বলা যাবে না। এখন বলতে হবে আওয়ামী-জামায়াত। 

সম্প্রতি টুকুর বক্তব্যকে অশালীন উল্লেখ করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়  জামায়াতের শীর্ষ পর্যায় থেকে। এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, জামায়াত বিএনপি জোটের সঙ্গে আছে। তাই টুকুর বক্তব্য কুরুচিপূর্ণ, অশালীন ও শিষ্টাচারবহির্ভূত। তার বক্তব্য দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। এটি কোন রাজনীতিবিদের ভাষা হতে পারে না।

নানামুখী চাপ থাকার পরও বিএনপি তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী জামায়াতকে না ছাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মাঠের আন্দোলনে জামায়াত নেতাকর্মীদের সক্রিয় অবস্থান। এ ছাড়া সারাদেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে জামায়াতের একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। বিশেষ করে ৮-১০টি জেলায় রাজনৈতিকভাবে জামায়াত বিএনপির চেয়েও শক্তিশালী। এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার দাবি করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকেও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের ব্যাপারে বিএনপির ওপর চাপ আসে। কিন্তু বিএনপি তখন বিষয়টি আমলে নেয়নি। বরং জামায়াতের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার কৌশল গ্রহণ করে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রায় দুই যুগ এক সঙ্গে রাজনীতি করলেও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সম্পর্কের কোন চির ধরেনি। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক ছেদ করতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল চেষ্টা করে। এর পরও বিভিন্ন সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ বিএনপিকে জামায়াতের সম্পর্ক ত্যাগ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে বলে। কিন্তু বিএনপি সে পথে না গিয়ে জামায়াত তোষণ নীতি অব্যাহত রেখেছে। তবে সম্প্রতি বিএনপি নেতা টুকুর বক্তব্যের পর বিএনপি-জামায়াতের দূরত্বের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা হচ্ছে। এতে মনে হচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে আপাতত দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছে বিএনপি। 

এদিকে বিএনপি কৌশলে জামায়াতকে এড়িয়ে চলায় জামায়াত রাজনীতিতে টিকে থাকতে নানামুখী কৌশল নিয়ে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে তারা এখন সরকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। প্রায় একদশক আগে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তারা এখন চায় যে কোনভাবেই হোক বিএনপির সঙ্গে বিচ্ছেদের বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করে আওয়ামী লীগের সহযোগিতা নিয়ে আবার যাতে দলের নিবন্ধন নেয়া যায়।

 সে ক্ষেত্রে দলের গঠনতন্ত্রে সংস্কারসহ যে কোন শর্ত মানার বিষয়েও তাদের কোন আপত্তি থাকবে না। তবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলেও দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের দাবিÑ জামায়াত যাতে কোন অবস্থাতেই আর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন না পায়।  

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল আপীল বিভাগে  লিভ টু আপীল করেন, যা এখানও নিষ্পত্তি হয়নি। তবে হাইকোর্টের ওই রায়ের ৫ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের এক গেজেটে বলা হয়, আদালত জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন বাতিল ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণা করায় আরপিও অনুযায়ী দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হলো। 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে  ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন দল জাতীয় পার্টি,  গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন দল জামায়াত ও আল্লামা শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট  গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। পরবর্তীতে এই জোট সম্প্রসারণ করে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়।  চারদলীয় জোট গঠনের আগেও বিএনপি তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে আন্দোলন হালে পানি পায়নি। 

তবে ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি চারদলীয় জোট গঠনের পর রাজপথের আন্দোলনে জামায়াত সক্রিয় ভূমিকা পালনের পর সে আন্দোলন জোরদার হয়। এ পরিস্থিতিতে রাজপথের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে রেখে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। তবে জামায়াতের শীর্ষ ২ নেতা- মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে দেশ-বিদেশে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। আর এ কারণেই পরবর্তীতে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। 

কিন্তু বিএনপি চাপকে আমলে না নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে এবং ওই নির্বাচনের পর ২০১৫ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি আরও বেশি সমালোচনার শিকার হয়। তখন বিএনপি দেশী-বিদেশী চাপ উপেক্ষা করলেও রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকায় এখন বিভিন্ন মহলকে খুশি রেখে রাজনীতি করার কৌশল নিয়েছে বলে জানা যায়। 
 

এসআর

সম্পর্কিত বিষয়:

×