ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

মাইলস্টোন ট্রাজেডি, গুজবলীগের অপতৎপরতা ও জাতীয় দায়বদ্ধতা

মোহাম্মদ ফয়সাল আকবর

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ২৩ জুলাই ২০২৫

মাইলস্টোন ট্রাজেডি, গুজবলীগের অপতৎপরতা ও জাতীয় দায়বদ্ধতা

শিক্ষক ও গবেষক, ফয়সাল আকবর 

মাইলস্টোন ট্রাজেডি আমাদের সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নিষ্পাপ কোমলমতি শিশুদের এভাবে ঝরে যাওয়া শুধু হৃদয়বিদারকই নয়, তা আমাদের অব্যবস্থাপনার নগ্ন চিত্রও সামনে এনেছে। যে শিশুদের বই-খাতা হাতে থাকার কথা, তাদের রক্তমাখা দেহ দেখে প্রতিটি বিবেকবান নাগরিক শোকাহত। তবে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার মাঝেও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী চক্রের কিছু সদস্য উল্লসিত হয়েছে!

সার্বিক বিশ্লেষণে এটি নিছক দুর্ঘটনাই বলে মনে হয়েছে। পাইলট, বিমানবাহিনী কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর সরাসরি দায় চাপানোর সুযোগ এখানে কম। এখানে মূলত—পদ্ধতিগত ত্রুটিই  প্রধানত দায়ী। এই পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত ত্রুটির ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাতেই প্রাণ হারায় প্রায় ৮-১০ হাজার মানুষ। অন্যান্য দুর্ঘটনা যুক্ত করলে এই সংখ্যা বেশ বড়ই হবে। 

এদিকে দুর্ঘটনার সময় 'উৎসুক জনতা' নামে নতুন এক উপদ্রব হাজির হয়েছে। তারা অনেকে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে বাধা সৃষ্টি করে, আবার কেউ কেউ আন্তরিকভাবে উদ্ধারকাজে অংশ নেন। অনেকে নিজের জীবন বিপন্ন করে উদ্ধারকাজে নামেন, রক্ত দান করেন, পানি ও খাবার বিলিয়ে দেন। তাই উৎসুক জনতার সমালোচনায় ভারসাম্য রাখতে হবে। বিচ্ছিন্ন কিছু অনৈতিক আচরণকে কেন্দ্র করে গোটা জনগোষ্ঠীর ভূমিকা খাটো করা দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে।

তবে সবচেয়ে গভীর উদ্বেগের বিষয়—মৃতের সংখ্যা নিয়ে গুজব ও অপপ্রচার। এই অপতৎপরতার পেছনে রয়েছে পরাজিত ও পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের 'সহমত কর্মীবাহিনী'। তারা কখনো বাসায় ঘুমানো সামন্ত লালকে "মুক্তি দেওয়ার" নাটক করে, কখনো আবার AI জেনারেটেড ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে জনগণের মনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অথচ বাস্তবতা পরিষ্কার—মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করার কোনো সুযোগ নেই। মাইলস্টোন কলেজের কর্মকর্তা বুলবুল জানালেন, প্রতিষ্ঠানটির অ্যাটেনডেন্স, ক্লাসসূচি, শিক্ষার্থী রেকর্ড অত্যন্ত নিয়মিত ও ডকুমেন্টেড। তার তথ্য অনুযায়ী, মোট ৩১ জন প্রাণ হারিয়েছেন—যার মধ্যে একজন শিক্ষক, একজন আয়া ও বাকি সবাই শিক্ষার্থী। আহত অনেকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

এই ট্রাজেডিকে কেন্দ্র করে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের মতো একটি অত্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের দেরি ছিল চরম অবিবেচকতা। এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে, যা ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে। তাদের ন্যায্য দাবিগুলোকে আমরা পূর্ণ সমর্থন করি। তবে খুনি লীগের চিরাচরিত ষড়যন্ত্র—এই আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা অবশ্যই চালাবে। সেই ফাঁদে পা না দিয়ে শিক্ষার্থীদের সংযত ও দায়িত্বশীল থেকে তাদের দাবির পক্ষে ভূমিকা রাখতে হবে।

আমরা একটি অপ্রস্তুত রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে কোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার সময় দ্রুত রেসপন্স নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। শুধু দুর্ঘটনার পরে হৈচৈ করে কিছুদিন পর থেমে যাওয়া—এই চক্র থেকে আমাদের বের হতে হবে। বিশেষ করে ফায়ার সার্ভিস, উদ্ধার ব্যবস্থাপনা, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কার দরকার। সংবাদমাধ্যমেই এসেছে—গত ৩৪ বছরে বিমানবাহিনীর ৩২টি বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। দুর্নীতির চরম উদাহরণ হিসেবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা যুগের এক বিমানবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ব যখন পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের যুগে প্রবেশ করছে, আমরা এখনো পুরনো, জীর্ণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত অবকাঠামো দিয়ে নিজেদের আকাশ রক্ষা করতে চাইছি। এটা শুধু অক্ষমতা নয়—এটা আত্মঘাতী।

মাইলস্টোন ট্রাজেডি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—জাতি হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা কতটা জরুরি। তাই আসুন, এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আমরা পদ্ধতিগত সংস্কার, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতিমুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য কথা বলি।

ফয়সাল আকবর 
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।
 

 

শেখ ফরিদ
 

×