ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

বেদনা বিধুর বাকরুদ্ধ বাংলাদেশ

জুবায়ের হাসান

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ২৩ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৯:৩৯, ২৩ জুলাই ২০২৫

বেদনা বিধুর বাকরুদ্ধ বাংলাদেশ

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ঘটে গেল স্মরণ কালের বেদনাদায়ক দুর্ঘটনা। বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলো উত্তরার একটি স্কুলের উপর। হতাহতদের বেশিরভাগই স্কুল শিক্ষার্থী মাসুম বাচ্চারা। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। নিহত আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো আসেনি। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিহত হয়েছে ২৭ জন, যাদের মধ্যে ২৫ জনই শিশু শিক্ষার্থী। আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থ। আল্লাহ তায়ালা শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে ধৈর্যধারণের শক্তি দিন। নিহতদের সবাইকে জান্নাতের বাগান দান করুন। আহতদের দ্রুত পূর্ণ আরোগ্য দান করুন। পুরো জাতিকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দান করুন। আমিন।

জাতীয় প্রত্যেক ট্রাজিক ঘটনায় শোকের পাশাপাশি ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম হয়, ঘটে নানা প্রশ্নের উদ্রেক। সর্বত্র বলা হচ্ছে, আবাসিক এলাকার ওপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান পোড়ানো হয় কেন? সমস্যা হলো যখন বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করা হয়েছিলো তখন উত্তরার এসব এলাকা আবাসিক ছিলো না। কিন্তু এখন তা আবাসিক এলাকা হয়ে পড়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা পূর্বে এ নিয়ে ভাবেননি। আরেকটি রব উঠেছে যে এই মডেলের ট্রেনিং এয়ারক্র্যাফ্ট বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এখনও ব্যবহার করছে কেন? আসলে বাংলাদেশে তার সামর্থ্য অনুযায়ী যা কিনতে পারে তা-ই ব্যবহার করছে। এছাড়া এফ১৬ কিম্বা এফ৩৫ এ ধরনের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমানও দুর্ঘটনা কবলিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অতএব দুর্ঘটনার ঝুঁকি সবসময়ই থাকে। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে যে এ ধরনের বিমান কেনাকাটায় কোনো প্রকার দুর্নীতি হয়েছে কিনা। সেই সাথে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে আর কত পাইলট জীবন দেবেন? বেসামরিক মানুষই বা কেন জীবন দেবেন? দেশ ও সর্বসাধারণের জানমালের আর কত ক্ষতি হবে ?

এধরনের আরো বহু প্রশ্নের উদ্রেক জাতির মনে ঘটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, শোক যেনো চরম ক্ষোভে পরিণত না হয়। কেননা এটা একটি দুর্ঘটনা। চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ও অপরের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে কিছু অর্জন করা যাবে না। আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের আর কখনোই ফিরে পাবো না। অন্য কিছুর বিনিময়েও তাদেরকে ফিরে পাব না। আমাদের কামনা হওয়া উচিত এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। প্রত্যেক প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর উচিত তাদের বাড়ির পাশের নিহত-আহত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। এসব পরিবারগুলোর প্রায় সবই মধ্যবিত্ত পরিবার। তাদের আহত সন্তানদের দেখাশোনা ও পরিচর্যার জন্য হাসপাতালে যাওয়া আসা করা জরুরি। এ জন্য তাদের ট্রান্সপোর্টের ভীষণ প্রয়োজন। সামর্থ্যবান প্রতিবেশীরা তাদেরকে ট্রান্সপোর্ট সহায়তা দিতে পারে। আহতদের জন্য রক্তদানে প্রস্তুত থাকতে পারে। এ ধরনের আরো অনেক প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা প্রতিবেশীরা করতে পারেন। মনে রাখা উচিত এ দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়, বরং আমাদের সকলের।

এ দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। ইনভেস্টিগেশনের সাথে শক্ত রেকোমেন্ডেশন থাকতে হবে। আর সেই রেকোমেন্ডেশনগুলোকে ইমপ্লিমেন্টেশনের জন্য কমিটমেন্ট থাকতে হবে। জাতিকে জানাতে হবে প্রকৃত ঘটনা কি ঘটেছে। ভবিষ্যতে যেন আর এ ধরনের ঘটনা না ঘটার জন্য কি প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানাতে হবে। দ্রুতই নিহত আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পেশ করতে হবে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় খরচে উন্নত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। উপরন্তু এসব শোকসন্তপ্ত পরিবারের মনে আস্থা জাগাতে হবে যে রাষ্ট্র তাদের পাশেই আছে। পুরো জাতিকে আমাদের দেশের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা সম্পর্কে জানাতে হবে। তাহলে জনগণ রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাবান হয়ে উঠবেন। এ দুর্ঘটনার উদ্ধার তৎপরতার কাজে যারা সাহসিকতার সাথে নিরলসভাবে অংশ নিয়েছেন তাদের চিত্রও তুলে ধরতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে এধরনের মহৎ কাজে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে তারা এবং অন্যরা উদ্বুদ্ধ হবেন ও অনুপ্রেরণা লাভ করবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তার নার্সরা নিরলসভাবে যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের কাজেরও স্বীকৃতি দিতে হবে। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চটজলদি কর্মতৎপরতারও প্রশংসা করতে হবে। স্বর্ণাক্ষরে লিখতে হবে সেই শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরীর নাম, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষা করার মহৎ অভিযানে নিজের জীবন দান করেছেন।

এই মুহূর্তে দেশের সকল শিক্ষার্থীরা ভীষণ রকমের শোকাভিভূত, বিমর্ষ, আতঙ্কিত ও ট্রমাটাইজড। শিশুমনের এ ভীতিকর অবস্থা দ্রুতই দূর করতে হবে। এ দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো প্রকারের অপরাজনীতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেকোনো ট্রাজিক ঘটনা থেকে সীমাহীন গুজবের উদ্ভব হয়। মিস ইনফরমেশন ও ডিস ইনফরমেশনের ছড়াছড়ি হয়। চলে অপসংবাদিকতা। এসব বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে মনে রাখা প্রয়োজন সবার আগে ভিকটিমের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। ভিকটিমকে বাঁচাতে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টা আগে, সাংবাদিকতা পরে। সহমর্মিতা জানাতে অনেক রাজনীতিবিদ দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে ছুটে গিয়েছেন। এটাকে অনেকে অপছন্দ করেছেন। তবে যদি রাজনীতিবিদরা সেখানে না যেতেন তখন আবার প্রচুর সমালোচনা হতো। কেননা দুর্ঘটনাস্থলে তড়িৎ গমন এবং হাসপাতালে দেখা সাক্ষাৎ করতে যাওয়াটাই আমাদের দেশের প্রচলিত সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উত্তরার ট্রাজিক ঘটনার বিমর্ষতা থেকে উত্তরণ পেতে আমাদের বেশ কিছু সময় লাগবে। কেননা এটা এক বিরাট মনোজাগতিক ধাক্কা। জীবন গেছে আমাদের সন্তানদের, একেবারে কচি কচি বাচ্চাদের। সান্ত্বনা দেবার কোনো ভাষা কারো কাছেই নেই। মনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সহজেই করা যেতে পারে অনেক তির্যক প্রশ্ন। কিন্তু আবেগের চেয়ে বেশি ভাবা দরকার দুর্ঘটনা এড়াবার কর্মকৌশল নিয়ে। সেই সাথে এমন কিছু অবান্তর প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া উচিৎ নয় যা আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাহলে এদেশের জনগণ রাষ্ট্রের প্রতি চরম বৈরি হয়ে পড়বেন। রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই আর টিকিয়ে রাখতে চাইবে না। যেটা হবে সর্বনাশ। মনে রাখা প্রয়োজন হাসিনা উত্তর যুগে বাংলাদেশ বহুমুখী সংকট মোকাবেলা করে চলেছে। তাই এই বিমান দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে নতুন সংকট তৈরি করা কাম্য নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের সেনা, বিমান ও নৌ বাহিনী তথা সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীকে কোনোভাবেই হেয় প্রতিপন্ন করা সমচীন নয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষিত হয়ে চলেছে ও চলবে সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে। এ বাহিনী আমাদের অহংকার। এ বাহিনীই দেশের বিভিন্ন ভয়ংকর প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগগুলো মোকাবেলা করতে এগিয়ে যায়। তাই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাহিনীর অবমূল্যায়ন করার সুযোগ কাউকেই দেওয়া উচিত নয়। শত্রুপক্ষ সবসময়ই চেষ্টা করে থাকে জনগণ ও সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করবার। আমাদেরকে এ ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।

লেখক: জুবায়ের হাসান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আসিফ

×