
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে যথার্থ শিক্ষার ম্যধমে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না। বড়জোড় একজন কেরানি হবার শিক্ষা ও মানসিকতা অর্জন করতে পারে মাত্র। যারা প্রকৃত অর্থে মেধাবী দেশ ও জাতির জন্য কিছু করার আকাঙ্খা যাদের রয়েছে, তারা তা করতে পারছেনা শিক্ষাব্যবস্থা ও সঠিক পরিচালনার অভাবে। গতানুগতিকতার শিকলে বন্দী হয়ে তাদের প্রতিভা ক্রমেই ¤øান হয়ে যাচ্ছে। অনেক উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও তাদের একটি উপযুক্ত কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অন্যদিকে যারা কম মেধাবী তাদের কেউ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই।ফলে সবাই কে যেতে হচ্ছে একই পথে। কিন্তু সাধারণ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও একটি কাজ পাবার জন্য যথেষ্ট নয়। এভাবে ডিগ্রি অর্জনের অন্ধ মোহ কাটিয়ে এক সময় তরুণরা বেকারত্বের চরম হতাশায় হাবুডুবু খায়। তাদেরকে সঠিক পথ নির্দেশনা দেবার যেন কেউ নেই এদেশে। আমাদের অবৈজ্ঞানিক পশ্চাৎপদ শিক্ষা ব্যবস্থা বস্তুত এদেশের দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ। বর্তমান শিক্ষা মানুষের মেধা ও শ্রমের অপচয় করে তাকে উপহার দিচ্ছে একটি অনিশ্চিত অভিশপ্ত বেকার জীবন। এভাবে ক্রমাগত দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকায় আমাদের অর্থনীতি ক্রমেই অনিশ্চিতার দিকে এগোচ্ছে।
বিশ্বের যেসব জাতি আজ উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে তারা অনেক আগেই বৃত্তিমূলক শিক্ষার তাৎপর্য অনুধাবন করে সে অনুযায়ী বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশের মতো সকলেই উচ্চশিক্ষায় অগ্রহী নয়। আর যারা যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন তারা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন। বরং অর্থ উপার্জনের মোক্ষম ও বাস্তবমুখী শিক্ষার প্রতিই তাদের আগ্রহ অধিক। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মান, ইতালি, চীন, ফ্রান্স, জাপান, প্রভৃতি দেশে যেমন বড় বিঙ্গানী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাহিত্যক তৈরি হচ্ছে, পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাভিত্তিক কাজেও কর্মদক্ষ মানুষ গড়ে তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ উচ্চ শিক্ষিত গবেষক বা বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমিকেও সেখানে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয় না।
বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বৃত্তিমূলক শিক্ষার অপরিহার্যতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বাংলাদেশ নদীমাতৃক ও কৃষিপ্রধান দেশ। তবে বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্প, চামড়া শিল্প, পাট শিল্প, চা শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেতে যথেষ্ট সম্ভনা দেখা দিয়েছে। অথচ এসব ক্ষেতে দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলার কোন প্রদক্ষেপ আমাদের নেই। উন্নয়নশীল দেশ গুলোর শিক্ষানীতি আর আমাদের শিক্ষানীতি একেবারে উল্টো। বাংলাদেশের শিক্ষায় দীর্ঘ আঠারো বছর তার থেকেও বেশি সময় নিয়ে পড়া শেষ করে একজন শিক্ষার্থীকে আবার নতুন করে চাকরির পড়া পড়তে হয়। এতে তার আরও সময় লাগে। একজন শিক্ষার্থী প্রায় জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পড়াশোনা ও চাকরির পিছনে ছুটতে হয়। পড়াশোনা শেষ চাকরির জন্য আরও সময় নিলেও অনেকে চাকরির মুখ দেখতে পায় না। এর প্রধান কারণ বাস্তবমুখী শিক্ষা এ দেশে নেই। সম্পূর্ণ কল্পনীয় শিক্ষাব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। যার সংজ্ঞে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। যার কারণে দিন দিন বেকারত্বে জর্জরিত হচ্ছে দেশ ও সমাজ। এ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে বাস্তবমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে যে বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির ব্যাপক সুযোগ আছে। জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান খাত। যদি শ্রমিকদের কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো হয় তাহলে তাদের পক্ষে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ উপার্জন সম্ভব হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দেশে এরকম কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। শ্রমিক শুধু বিদেশে রপ্তানি নয় দক্ষ শ্রমিক দেশে থাকলেও দেশের শিল্প, কৃষি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আর এতে দেশী-বিদেশীরা আকৃষ্ট হবে এবং অর্থনীতি হয়ে উঠবে চাঙা। এজন্য আমাদের মাধ্যমে স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাস্তরে বাস্তবমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দেশে-বিদেশে সার্থকভাবে কাজে লাগানো যাবে। এজন্য প্রয়োজন স্বপ্লমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ। দেশের প্রতিটি মানুষকে এভাবে কর্মক্ষম করে তুলতে পারলে দারিদ্র্র্যবিমোচন আর অসম্ভব বলে বিবেচিত হবে না। বৃত্তিমূলক শিক্ষা শুধু কর্মের নিশ্চয়তাই দেয় না সেইসঙ্গে জাতিকে নানা সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। অবাস্তব শিক্ষার কারণে দেশে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয় তার মধ্যে সব থেকে বেশি বেকারত্ব। বেকারত্বের ফলে তরুণদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এমকি আত্মহত্যা পর্যন্তও করে থাকে বেকার যুবকরা। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে বৃত্তিমূলক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
কর্মমুখী শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করতে দেশের মানুষকে শিক্ষিত করার পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে নতুন নতুন কলকারখানা ও কর্মবান্ধব প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য অবকাঠামো গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে একটি স্থিতিশীল সমাজের গুরুত্ব অনেক। তাছাড়া বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে কার্যকর করার জন্য সমাজে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে কোন কাজই তুচ্ছ নয়। মানুষকে নিচু দেখার অবকাশ নিতান্তই মধ্যযোগীয় বর্ণবাদী ধারণা। এ হীনমানসিকতা বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিকাশের পথে একটি বড় বাধা। এ মনোবৃত্তি যত তাড়াতাড়ি দূর হবে ততই মঙ্গল।
তাই সময় এসেছে কার্যকরী বৃত্তিমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দেশের প্রতিটি মানুষকে দক্ষরূপে গড়ে তোলার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন এমন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের সংস্কার করছে। শিক্ষা সংস্কার গঠন করবে বলেও জানিয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, দ্রæত শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে কিভাবে বাস্তবমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষ প্রণয়ন করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। এছাড়া সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও নানা কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষাক্ষেত্র গড়ে তোলা সম্ভব। কৃষি, গার্মেন্টস, চামড়া শিল্প, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের চাহিদা মোতাবেক সুদক্ষ কর্মী তৈরির মাধ্যমে আমরা সহজেই দেশের মানুষের সাধারণ হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করতে পারি। সচল করতে পারি দেশের অর্থনীতির চাকা। তবেই তা হবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ