ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ মাঘ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যে ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন!

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:১৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪

মধ্যপ্রাচ্যে ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন!

.

ফিলিস্তিন ভূখন্ড দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। এরপর গত সাত দশকে ফিলিস্তিনের ৯৫ শতাংশ এলাকা দখল করেছে জায়ানবাদী রাষ্ট্রটি। বর্তমান ফিলিস্তিন বলতে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরকে বোঝানো হয়। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরাইল গাজায় হামলা চালাচ্ছে। এরপর লেবাননেও সামরিক আগ্রাসন শুরু করেছে। ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল সে¥াট্রিচ গণমাধ্যমে আয়োজিত এক টকশোতে দখলদার রাষ্ট্রটির সীমানা ইউফ্রেটিস থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বৃদ্ধি করার পরিকল্পনার পক্ষে জোরালোভাবে যুক্তি তুলে ধরেন। এর ফলে, মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশে^ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং সমালোচনার ঝড় ওঠে। বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিবাদী ভাষণ প্রদানের জন্য সমালোচিত সে¥াট্রিচ ফ্রান্স-জার্মানভিত্তিক নিউজ ম্যাগাজিন আর্টে রিপোর্টেজ থেকে নির্মিত সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত প্রামাণ্যচিত্র ‘ইন ইসরাইল : মিনিস্টারস অব কেয়াস’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন। সেখানে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরও ইহুদি রাষ্ট্রের বিস্তৃতি নিয়ে কথা বলেন। সে¥াট্রিচ বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখন্ডকে ঘিরে রেখেছে, সেইসঙ্গে মিসর এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অঞ্চল এবং সেইসঙ্গে ইরাকে পৌঁছানো অঞ্চলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত করার উচ্চাকাক্সক্ষা। এবং সৌদি আরব। তিনি আরও দাবি করেন যে, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, মিসর এবং এমনকি সৌদি আরবের অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তথ্যচিত্রে তিনি বলেন, আমি এমন একটি ইহুদি রাষ্ট্র চাই, যা ইহুদি জনগণের মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। আর জেরুজালেম হবে সেই রাষ্ট্রের রাজধানী। দুই দেশের মধ্যে শান্তি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে জর্দান বেজালেলের এমন দাবির তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।

অনেকের নিকট এই দৃষ্টিভঙ্গি চরমপন্থি বলে মনে হলেও এটি ইতোমধ্যেই ইসরাইলের জনসাধারণের বক্তৃতার অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ডকুমেন্টারিতে তিনি একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছেন এই বলে, ‘এটি লেখা আছে যে জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ দামেস্কে প্রসারিত হবে’। ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ মতবাদ নিয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাকি নুসিরাত বলেন, বাস্তবতা হলো বেজালেল বা বেন গুর এই দুই কট্টর ডানপন্থি ইসরাইলি রাজনীতিবিদ বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণাকে বৈধ ভবিষ্যৎ হিসেবেই দেখে।
ওদেদ ইনন পরিকল্পনায়ও বৃহৎ ইসরাইল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান নেতানিয়াহু সরকার এবং লিকুদ পার্টির বিভিন্ন গোষ্ঠী; এমনকি ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আদর্শিক ভিত্তিও এই পরিকল্পনা। ২০১১ সালে গ্লোবাল রিচার্সে প্রকাশিত এক নিবন্ধে মাহদি দারিয়ুস নাজেমরোয়া বলেছিলেন, ইনন পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ উপনেশবাদী নকশারই ধারাবাহিকতা। এটি আঞ্চলিক আধিপত্য নিশ্চিত করার ইসরাইলি কৌশলগত পরিকল্পনা। এতে বলা হয়েছে, ইসরাইলকে অবশ্যই তার ভূরাজনৈতিক প্রতিবেশ পুনর্বিন্যস্ত করে নিতে হবে; বলকানাইজেশন প্রক্রিয়ায় আশপাশের আরব রাষ্ট্রগুলোকে ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাজ্যে বিখ-িত করে। এই পরিকল্পনায় লেবানন, মিসর ও সিরিয়ার বিভাজনের কথাও বলা হয়েছে। ইরান, তুরস্ক, সোমালিয়া ও পাকিস্তানের খ-িতকরণও এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ওই পরিকল্পনা অনুসারে, উত্তর আফ্রিকার বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোর অবসানের কথা বলা হয়েছে। প্রথমে মিসর, এরপর সুদান, লিবিয়া ও অবশিষ্ট অঞ্চল বিলুপ্ত হবে। ওই পকিল্পনার প্রেক্ষিত দুটি। ১) আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হতে হবে এবং ২) বিখন্ডিকরণ করে সব আরব রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। এই বিভাজন নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিভাজন রেখা বরাবর হবে। এসব ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরাইলের আশ্রিত হবে। ইসরাইল হবে সেগুলোর নৈতিক বৈধতার উৎস। এটি নতুন কোনো ভাবনা নয়; বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি মার্কিন-ইসরাইলি সম্প্রসারণবাদী প্রকল্পেরই অংশ। এই ‘গ্রেটার ইসরাইল’ মতবাদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হিব্রু বাইবেল থেকে। এই ধারণাটি পরে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ জায়োনিজমের প্রধান প্রবক্তা থিওডর হার্জলের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। তিনি ‘দ্য কমপ্লিট অব থিওডর হার্জল’ গ্রন্থের ২য় খ-ে বলেন, বাইবেলে উল্লিখিত ‘মিসরের নদী থেকে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত’ গোটা ভূখন্ডটি জায়ানিস্ট রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সীমানা হিসেবে কল্পনা করেন। এটি মূলত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি গড়াকে কেন্দ্র করে করা হয়, যা স্থানীয় ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের জীবনের বিনিময়ে গড়ে উঠবে। 
বর্তমান সময়েও অনেক ইসরাইলি রাজনীতিবিদ এই ধরনের ধারণার সমর্থক এবং বাহক। ভূখন্ডগত বিতর্কিত এই ধারণায় বলা হয়, এটি বর্তমান জায়ানিস্ট রাষ্ট্রকে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ড ও সিরীয় ভূখ-গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর সবচেয়ে ব্যাপক ধারণায়, এটি নীল নদ থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ মিসর, জর্দান, লেবানন, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত এবং সৌদি আরবের উল্লেখযোগ্য ভূখন্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে। ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন বলেন, ফিলিস্তিনের এই বিভাজন অবৈধ। তিনি মনে করেন, জেরুজালেম সবসময় ইহুদিদের রাজধানী ছিল এবং থাকবে। সেইসঙ্গে এরিটজ ইসরাইলের সীমানা চিরতরে পুনরুদ্ধার করা হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাকি নুসিরাত এ প্রসঙ্গে বলেন, বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণাটি ইসরাইলি সমাজে গেঁথে আছে। তবে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওমার করিম মনে করেন, বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণাটি একটি মিথ। ইহুদি ধর্ম অনুযায়ী বৃহত্তর ইসরাইল বলতে মধ্যপ্রাচ্যের সেই সব প্রাচীন এলাকাকে বোঝানো হয়, যেগুলো একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং যেখানে ইহুদিরা বসবাস করত। ‘দ্য প্রমিজড ল্যান্ড’ বলতে তিনি মনে করেন, হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সময়ে ইহুদিরা যখন মিসরে বসতি স্থাপন করেছিল, তখন তাদের শাসন ফিলিস্তিন থেকে বালাদ-ই-শাম (বর্তমান সিরিয়া) এবং ফোরাতের কিছু অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং সেখানে কোনো আরব ছিল না। এতে করে, তাদের প্রভাব অনেক অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল। বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণা মূলত এখান থেকেই এসেছে। তিনি মনে করেন, এই ধারণাকে বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব নয় এবং বৃহত্তর ইসরাইল বলতে এখন কেবল দখলকৃত অঞ্চল বোঝায়, যার মধ্যে ফিলিস্তিনের দখলকৃত অঞ্চলসহ অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা অন্তর্ভুক্ত। স্টিফেন লেন্ডমানের মতে, প্রায় এক শতাব্দী আগে ‘ওয়ার্ল্ড জায়ানিস্ট অর্গানাইজেশন’ একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিল। সে রাষ্ট্রে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন; সিদন ও লিতানি নদী পর্যন্ত দক্ষিণ লেবানন; সিরিয়ার গোলান মালভূমি, হাওরান সমতল ও দেরা এবং দেরা থেকে আম্মান পর্যন্ত হেজাজ রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণসহ জর্দান ও আকাবা উপসাগর অন্তর্ভুক্ত। কিছু জায়ানবাদী মনে করেন, নীল নদ উপত্যকা থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত এলাকায় পশ্চিম সিরিয়া ও তুরস্কের দক্ষিণাংশও অন্তর্ভুক্ত। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক জায়ানবাদী পরিকল্পনার সঙ্গে ২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসন, ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধ, ২০১১ সালের লিবিয়া যুদ্ধ; সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে যুদ্ধ, গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং ইরানে হামলার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত সব ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এগিয়ে চলেছেন। তিনি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি কৌশল অনুসরণ করেছেন; যা তিনি ১৯৮৬ সালে লেখা তাঁর ‘টেররিজম : হাউ দ্য ওয়েস্ট ক্যান উইন’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। এতে তিনি সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

তিনি বলেন, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, আহত ও আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত প্রক্রিয়া। এটি মূলত সেই কর্মকান্ডের বিবরণ; যা ইসরাইল গত এক বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজায় এবং বর্তমানে লেবাননে করে যাচ্ছে। তাঁর সন্ত্রাসবিরোধী তত্ত্বেও মূল ভিত্তি হলো বলপ্রয়োগ। তাঁর ধারণা ছিল, তিনি ফিলিস্তিনের সমস্যা মোকাবিলা করবেন গাজা অবরোধ আরোপের মাধ্যমে এবং পশ্চিম তীরে ধীরে ধীরে ইহুদি বসতি স্থাপন করে। তাই তিনি ও তাঁর মিত্ররা পুরোপুরি যুদ্ধের নীতি গ্রহণ করেছেন। ইসরাইলি সমর্থনকারী পশ্চিমা দেশগুলো তাদের এসব পদক্ষেপের ব্যাপারে বড় ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। পশ্চিমা দেশগুলো মূলত এভাবেই বৃহত্তর ইসরাইলের স্বপ্ন পূরণে ইসরাইলকে সহায়তা করে আসছে। ২০২৪ সালে জানুয়ারি মাসে ইসরাইলি লেখক আভি লিপকিন একটি সাক্ষাৎকারে বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের সীমানা লেবানন থেকে সৌদি আরবের বিশাল মরুভূমি, ভূমধ্যসাগর থেকে ফোরাত নদী (ইরাক) পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তিনি আরও বলেন, ফোরাত নদীর ওপারে যে কুর্দিরা আছেন, তারা আমাদের বন্ধু। আমাদের পিছনে ভূমধ্যসাগর এবং সামনে কুর্দিস্তান। লেবাননের ইসরাইলের সুরক্ষা প্রয়োজন এবং আমি নিশ্চিত যে আমরা মক্কা, মদিনা এবং সিনাইও দখল করব এবং এই স্থানগুলোকে শুদ্ধ করব। প্রতিবেশী দেশগুলোতে ইসরাইলি তৎপরতা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে ইরান, সিরিয়া এবং লেবাননের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে তারা হামলা চালিয়েছে। যুদ্ধবিরতি ডাকার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ও সংস্থা ব্যর্থ হওয়ায় ইসরাইলের কর্মকান্ড আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। 
ইসরাইলের শাসকগোষ্ঠীর ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ এই ধারণাটি কেবল একটি কাল্পনিক, নাকি সত্যিই সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে জমি দখল করার পরিকল্পনা। বিশেষ করে ইরানের ওপর ইসরাইল আক্রমণের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে এই দখল নীতি বাস্তবায়ন করতে পারে তেল আবিব। গাজায় হামলার পর লেবাননে ইসরাইলের চলমান অভিযানের পর থেকে বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণাটি আবারও সামনে এসেছে। এর কারণ হলো, গাজায় স্থল অভিযানের সময় কিছু সামাজিক মাধ্যমে পোস্টে দাবি করা হয়েছিল, কিছু ইসরাইলি সৈন্য তাদের ইউনিফর্মে ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ মানচিত্রযুক্ত ব্যাজ পরিধান করেছিল। উগ্র ডানপন্থি ইসরাইলি মন্ত্রীরাও অতীতে এই ধারণাটির কথা বলেছিলেন। ‘দ্য প্রমিজড ল্যান্ড’ (প্রতিশ্রুত ভূখ-) এর মানচিত্রে জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং মিসরের অংশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইসরাইলের অনেক ইহুদি বিশেষ করে উগ্র ইহুদিবাদীরা এই অঞ্চলটিকে ‘এরিটজ ইসরাইল’ বা ‘ইসরাইলের পবিত্র ভূমি’ বলে মনে করে; যা ইসরাইলের বর্তমান সীমানা থেকেও অনেক বড় একটি ভৌগোলিক এলাকা। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পরিচিত ছিলেন। অতীতে তার প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় (ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে প্রত্যাহার), মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করে এবং গোলান মালভূমিতে ইসরাইলি সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতির উদ্দেশ্য হলো গোটা অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। মধ্যপ্রাচ্যে বৃহৎ ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা শুধু একটি জায়ানবাদী পরিকল্পনা নয়, এটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মার্কিন আধিপত্যের প্রসার এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিখন্ডিকরণ। 
ট্রাম্প দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ইসরাইলপন্থি ও সাবেক গভর্নর মাইক হাকাবিকে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত এবং ব্যবসায়ী স্টিভেন উইটফকে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। আল জাজিরা জানিয়েছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আরকানসাসের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হাকাবি সবসময় ইসরাইলকে সমর্থন দিয়েছেন। প্রায় সময় তিনি ইসরাইলি অধিগ্রহণ, বসতির প্রসঙ্গ এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। ২০১৭ সালে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাকাবি বলেন, পশ্চিম তীর বলতে কিছু নেই। ওই জায়গার নাম জুডিয়া এবং সামাবিয়া (বাইবেল অনুযায়ী)। (অবৈধ ইসরাইলি) বসতি বলতেও কিছু নেই। সেখানে বিভিন্ন শহর, কমিউনিটি রয়েছে। অধিগ্রহণ বলতেও কিছু নেই। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প তার সাবেক কর্পোরেট আইনজীবী জেসন গ্রিনব্ল্যাটকে আন্তর্জাতিক আলোচনার জন্য বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে আলোচনার জন্য ট্রাম্প তার জামাতা এবং উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ওই সময় ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে স্বাক্ষরিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর পেছনে গ্রিনব্ল্যাট ও কুশনার মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। সৌদি আরবের সঙ্গেও এবার একই রকম চুক্তি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের অবস্থান যেমন আরও সুসংহত হবে, তেমনি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নও একরকম বিলীন হয়ে যাবে। সমালোচকরা বলছেন, কট্টরপন্থিদের নিয়ে এটি ঘোরতর যুদ্ধবাজ প্রশাসনে রূপ নিতে পারে অচিরেই। একটি কট্টর অবস্থান বা সামরিক হুমকি অনাকাক্সিক্ষত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ, প্রক্সিযুদ্ধ বা ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। মিডল ইস্ট আই-এর মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ডেভিড হার্স্টের মতে, দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প যেভাবে তার প্রশাসন সাজাচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য পুরোপুরি যুদ্ধের সব প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অথচ নির্বাচিত হওয়ার আগে ট্রাম্প বারবার দাবি করেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ হতো না। ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ তথা ‘শতকীয় সমঝোতা’য় ট্রাম্প বৃহৎ ইসরাইল প্রকল্পের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। প্রস্তাবিত সমঝোতায় লেবানন, জর্দান, সিরিয়া ও ইরাকে বা অন্য দেশে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের নাগরিকত্ব দিতে বলা হয়েছে। এতে ফিলিস্তিনের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকারের দাবিকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। নেতানিয়াহুর বর্তমান সরকার অবৈধ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের অস্ত্র, সমর্থন এবং সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে এই ধারণাকে বাস্তব রূপ দিতে চাইছে। 

লেখক  :  সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×