ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি

ওবায়দুল কবির

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২ নভেম্বর ২০২৪

কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি

দেশের দেড় শতাধিক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের দেড় শতাধিক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাড়ে পাঁচশ’ মহাবিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হয় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে দেড় লাখ শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান হলেও দুই লাখ থেকে যায় উপযুক্ত কাজের বাইরে। কেউ বেকার আবার কেউ উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন কাজ করতে বাধ্য হয়। এর কারণ, আমাদের দেশে এত সংখ্যক উচ্চ শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশে^র সকল দেশেই উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কাজের পরিমাণ বেশি থাকে না।

এ কারণে, উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা নিরুৎসাহিত করা হয়। এসব দেশে উচ্চশিক্ষাকে প্রবল প্রতিযোগিতাময় এবং ব্যয়বহুল করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে প্রাইমারি ও দ্বাদশ শ্রেণির (এ লেভেল) পর শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয় কারিগরি শিক্ষায়। বিশে^র প্রায় সকল উন্নত দেশেই কারিগরি শিক্ষা সহজলভ্য। অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৃত্তি প্রদান করা হয়। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের নিজের ভরণপোষণের খরচও হয়ে যায় বৃত্তির টাকায়। শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায় কর্মসংস্থান। আমাদের দেশেও সময় হয়েছে উচ্চশিক্ষার বদলে ভর্তুকি দিয়ে হলেও কারিগরি শিক্ষা উৎসাহিত করা।     
ব্যক্তিগতভাবে আমার চেনা অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা বিশ^বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়েও উপযুক্ত চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। অনেক ছেলেকে দেখেছি ব্যাচেলর কিংবা মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে খেতে খামারে কাজ করছে। অনেকে হয়েছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, আবার কেউ গায়ে খাটা শ্রমিক। এইসব কাজের জন্য তাদের বিশ^বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার প্রয়োজন ছিল না। এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস করে ২/৩ বছরের কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে অনেক বেশি বেতনে তারা চাকরি করার সুযোগ পেতেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পায়। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ৩ শতাংশ স্বউদ্যোগে কিছু করছে।

বেকারদের মধ্যে অনন্যোপায় হয়ে কেউ কেউ বিদেশে চলে যাচ্ছেন, কেউ বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছোটখাটো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। উচ্চশিক্ষার মোট ৭০৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ৫৫৭টি। এই পরিসংখ্যান থেকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ পরিণতিই ফুটে ওঠে। 
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তারা স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করে কর্মসংস্থানের চেষ্টা শুরু করে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত বেকারের পরিমাণ ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ মোট স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই বেকার থেকে যাচ্ছে। ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকার ৩০ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৮ শতাংশ।

ইউরোপের প্রায় সকল রাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়, জাপানের মতো উন্নত বিশ্বে ¯œাতক ডিগ্রীধারী বেকার নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় শিক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে ৫০ ভাগের কম শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার দিকে যায়। বাকি ৫০ ভাগ স্বল্প মেয়াদে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে কাজ খুঁজে নেয়। বর্তমানে এর পরিমাণ আরও বাড়ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাইমারি (অষ্টম শ্রেণী) শিক্ষার পরই শুরু হয় বাছাই প্রক্রিয়া। লেখাপড়ার প্রতি যাদের আগ্রহ কম, তাদের পাঠানো হয় ভোকেশনাল শিক্ষায়। দ্বাদশ শ্রেণির পর আবারও বাছাই করে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয় কারিগরি শিক্ষায়। বাকিরা উচ্চ শিক্ষার জন্য অনুমতি পায়।

উন্নত বিশে^র রাষ্ট্রগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় মেধার প্রমাণ দিতে পারলে ওখান থেকেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকে। সরকারের পক্ষ থেকেও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়া হয়। যেসব শিক্ষার্থী দ্বাদশ শ্রেণিতে ভালো রেজাল্ট করছেন, তারা উচ্চশিক্ষার জন্য মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য পড়ার সুযোগ পান। অপেক্ষাকৃত কম ভালো রেজাল্ট নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে তাদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। সরকার তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করে।

আমাদের দেশেও সময় এসেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় নিরুৎসাহিত করে কারিগরি শিক্ষার পরামর্শ দেওয়া। এজন্য অবশ্য আরও বেশি কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রয়েছে নানা সংকট। এগুলো খুঁজে বের করে সমাধানের পাশাপাশি আরও বেশি কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে কর্মক্ষেত্র। উচ্চশিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষার কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি অপেক্ষাকৃত সহজ।    
প্রশ্ন হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা কি? প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হাতে কলমে বাস্তবধর্মী শিক্ষাই হলো কারিগরি শিক্ষা। এই শিক্ষায় নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষ এবং বাস্তবসম্মত জ্ঞানের অধিকারী করে গড়ে তোলা হয়। ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের পেশা বেছে নিতে পারেন। কারিগরি শিক্ষা পদ্ধতিতে পাস-ফেল বলে কিছু নেই। পরিপূর্ণ দক্ষতা অর্জনের জন্য যতক্ষণ প্রয়োজন পরীক্ষা দেওয়া এবং নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাওয়া যায়। তত্ত্বীয় পড়াশোনার চেয়ে বাস্তব প্রয়োগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ভাল কাজের সুযোগ খুঁজে নিতে পারেন। বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতায় চাকরির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বেকার হওয়ার চেয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ অনেকটাই যৌক্তিক। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সরকার আলাদাভাবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড গঠন করেছে। সারাদেশে প্রায় ৯ হাজার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। কারিগরি শিক্ষাকে শতভাগ গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে এই শিক্ষায় বিদ্যমান সমস্যার দিকেও নজর দিতে হবে। 
সরকারি তথ্যমতে, দেশে তিনটি স্তরে কারিগরি শিক্ষার পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে সার্টিফিকেট স্তর (এইচএসসি ভোকেশনাল, এইচএসসি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনাল ও বেসিক ট্রেডকোর্স); ডিপ্লোামা স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোামা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং) ও ডিগ্রি স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে বিএসসি-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-টেকনিক্যাল এডুকেশন)। কারিগরি শিক্ষা  বোর্ডের অধীনে দেশে চার বছর মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, ফিশারিজ, ফরেস্ট্রি, লাইভস্টক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (নেভাল), ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং (আর্মি) ও ডিপ্লোমা ইন  মেডিক্যাল টেকনোলজিতে কোর্স পরিচালিত হচ্ছে।

‘জাতীয় দক্ষতামান’ (বেসিক ৩৬০ ঘণ্টা) নিয়েও তিন  থেকে ছয় মাস মেয়াদি শিক্ষাক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমান কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম নানা সংকটে নিমজ্জিত। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষক সংকট, অপর্যাপ্ত ল্যাব বা গবেষণাগার, অবকাঠামোর অভাব এবং অনুন্নত কারিকুলাম। অনেক প্রতিষ্ঠানে ল্যাব থাকলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। শিক্ষার নামে এ প্রতিষ্ঠানগুলো সনদ বাণিজ্যকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।  এসব সনদ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বাস্তবে কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। এ কারণে এই খাতের সরকারি বরাদ্দ বাড়লেও আগ্রহ কমছে শিক্ষার্থীদের।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের কারিগরি শিক্ষার ডিপ্লোমা স্তরে সরকারের ব্যয় ছিল ১৫০ কোটি ৬৯ লাখ ৬৩ হাজার ৮৬৮ টাকা। বিপরীতে ওই শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৯১ হাজার ২৬ জন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয়েছিল ৭৬ কোটি ৯৩ লাখ ৩৮ হাজার ৩৯১ টাকা। বিপরীতে শিক্ষার্থী ছিল এক লাখ ১১ হাজার ১২০ জন। পাঁচ বছরে সরকারের ব্যয়  বেড়েছে ৭৩ কোটি ৬৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৭৭ টাকা। আর শিক্ষার্থী কমেছে ২০ হাজার ৯৪ জন। 
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলেও এখন পর্যন্ত গুণগতমান অর্জন সম্ভব হয়নি। এই মুহূর্তে মনোযোগ দিতে হবে কারিগরি শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নের দিকে। সবার আগে নজর দিতে হবে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের প্রতি। শিক্ষার কোর্সসমূহকে নিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিকমানে। নজর দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং ল্যাব সুবিধার দিকে।

যুগের চাহিদা অনুযায়ী এই শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে নতুন নতুন বিষয়। বর্তমানে চালু সিলেবাস যুগের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকীকরণ ও সংশোধন করা প্রয়োজন। দেশ-বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী কোর্স কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। গ্রামের দরিদ্র তরুণদের আর্থিক অসচ্ছলতার বিষয়টিতে নজর দিয়ে কমাতে হবে ড্রপ আউটের সংখ্যা। প্রয়োজনে তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অবকাঠামো ও জনবল বাড়াতে হবে।

জনসচেতনতা এবং ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য চালাতে হবে এই শিক্ষার যৌক্তিক প্রচার। দেশে পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা প্রায় সমান। মহিলাদের বাইরে রেখে কোনো ক্ষেত্রেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদের জন্য আরও পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে হবে। প্রয়োজনে ছাত্রীদের অধিকতর বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান এবং পড়াশোনা শেষে চাকরি প্রাপ্তি সহজ করতে হবে।  
মাধ্যমিক পাসের পর শিক্ষার্থীদের উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে হয় দুই বছর। এরপরই তারা চলে যান উচ্চশিক্ষার দিকে। শিক্ষার্থীদের ডিপ্লোমা কোর্স করতে হয় চার বছরে। যারা ভালো রেজাল্ট করেন, তারা কর্মক্ষেত্রে যোগদান না করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হন। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম। ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (ডুয়েট) নামে একটি মাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার জন্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় আসতে অনাগ্রহী হন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
দেশে অনেক কর্মক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাব অনুভূত হয়। দেশ থেকে চাহিদা মিটাতে না পারায় ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ লোক আনতে হয়। তারা বছরে একটি বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের তরুণদের দক্ষ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে কমে যাবে বিদেশনির্ভরতা। বাঁচবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। একই সঙ্গে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে পারলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

কারিগরি শিক্ষা অর্থবহ করার জন্য ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং মানসম্মত করার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষতা বাড়িয়ে মানবসম্পদ কাজে লাগিয়ে নিশ্চিত করতে হবে প্রযুক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার। তবেই সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। বৃদ্ধি পাবে উৎপাদনশীলতা। মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে দারিদ্র্য থেকে। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কারিগরি শিক্ষার হার এবং মান বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
উন্নত বিশে^ লেখাপড়া শেষে শিক্ষার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণে রীতিমতো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বছরে কত শিক্ষার্থী পাস করে বের হবে এর পরিসংখ্যান নিয়ে তৈরি করে রাখা হয় তাদের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা। দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মীর চাহিদা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের প্রাইমারি শিক্ষা, দ্বাদশ শ্রেণি ও উচ্চশিক্ষার স্তর নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় সেভাবেই। পরীক্ষার ফল ও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী তাদের পাঠানো হয় শিক্ষা কার্যক্রমে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষাজীবন শেষ করে একজন শিক্ষার্থীরও বেকার থাকার সম্ভাবনা থকে না, অন্যদিকে রাষ্ট্রের কোনো খাতে অভাব হয় না প্রশিক্ষিত কর্মীর।

বাংলাদেশে হয়তো এখনই এতটা হিসাব করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও কর্মসংস্থান সম্ভব নয়, তবুও কাজটি শুরু করতে হবে। বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের নানা খাতে সংস্কার কাজ শুরু করেছে। শিক্ষা খাতে সংস্কার এখন সময়ের দাবি। সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে হলে উন্নত বিশে^র মতো পরিকল্পিত শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণের বিকল্প নেই। শিক্ষা খাতের বিষেজ্ঞদের দিয়ে এমন একটি সংস্কার কমিশন করা উচিত।

অতীতের মতো প্রশাসন ক্যাডার দিয়ে শিক্ষা বিভাগ পরিচালনার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সংস্কার ও পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখতে হবে শিক্ষক কিংবা শিক্ষা ক্যাডারের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের। যথাযথ ব্যক্তির মাধ্যমে সঠিক সংস্কারই পারে শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষিত বেকার তৈরির পরিবর্তে মানব সম্পদ তৈরির কারখানা হিসেবে গড়ে তুলতে। 
 
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ

×