.
মধ্যপ্রাচ্য শব্দটি ১৯০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ঐতিহাসিক অ্যালফ্রেড থায়ের মাহান কর্তৃক আবিষ্কৃত। এই তত্ত্বটি এতদিন প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে তা আরও দুই বছর আগে ব্রিটিশ জেনারেল টি ই গর্ডন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উত্থাপন করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। গর্ডন ও মাহান উভয়েই আরব থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে তাদের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
মাহানের পরবর্তী ঐতিহাসিক ব্যাখ্যায় মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক সীমানা তাই আফগানিস্তানের পূর্বপ্রান্তে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকা হয়ে আটলান্টিক পর্যন্ত বিস্তৃত। মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা নির্ধারণে ভৌগোলিক বিস্তৃতি ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ভৌগোলিক প্রকৃতিরও একটি সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। পারস্য উপসাগরীয় কূল থেকে আরম্ভ করে উত্তর আফ্রিকা হয়ে আটলান্টিক পর্যন্ত সমুদয় ভূখ-ের অধিকাংশ এলাকাই শূন্য মরুভূমি ও মালভূমি আকারে পর্বত সঙ্কুল। বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। তুরস্কের দার্দানেলিস প্রণালী ও মিসরের সুয়েজ জলপথ এই অঞ্চলের সামরিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক সীমারেখার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- তার প্রাচীন গর্বিত ইতিহাস ও সভ্যতা। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, এই মধ্যপ্রাচ্যেই টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস ও নীলনদের তীরে গড়ে উঠেছিল জ্ঞাত প্রাচীনতম সভ্যতা।
পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানি তেল বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য সংজ্ঞায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে রাশিয়া কর্তৃক আজারবাইজানে তৈলকূপ খননের সময় থেকেই যে তেলের এই গুরুত্ব জ্বালানি হিসেবে আরম্ভ হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষিতে, মধ্যপ্রাচ্য ভূমধ্যসাগর, পারস্য উপসাগর এবং লোহিত সাগরের মাঝখানে অবস্থিত দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইসলাম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মের মতো প্রধান একেশ্বরবাদী ধর্মের জন্মের মতো ঘটনাগুলোর সঙ্গে সংযোগের কারণে অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের তেল সম্পদ এতই বিস্তৃত যে, বিশ্বের তেল উৎপাদনের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি তেল এই দেশসমূহে আহরিত হয়। তেল ক্ষেত্রসমূহের বেশিরভাগ পাইপলাইনই পারস্য উপসাগরীয় ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পারস্য উপসাগর ও ভূমধ্যসাগর মধ্যস্থিত এলাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। উপলব্ধি এবং বাস্তবতার নিরিখেই বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং এই গুরুত্বের ওপর নির্ভর করেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মধ্যপ্রাচীয় নীতি। আর মধ্যপ্রাচীয় বহুরূপী এই নীতির জন্যই বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল মধ্যপ্রাচ্য। বিভিন্ন কারণে মধ্যপ্রাচ্য বিশ^ রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এর প্রধান কারণ, এর অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান।
সাধারণভাবে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য এবং বিশেষভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে মধ্যপ্রাচ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সুয়েজ খাল খননের পর এই এলাকার ভৌগোলিক গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলাচলের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বিপুল পরিমাণ খনিজ তেল আবিষ্কার এই এলাকার গুরুত্ব শতগুণ বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে এই অঞ্চলের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক নতুন মোড় নেয়।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এই দেশগুলো মধ্যযুগীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি করা আধুনিক ভাবধারা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, যন্ত্রপাতি ও জীবনযাপন পদ্ধতির সংঘাতের ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও সর্বব্যাপী অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই এলাকার দেশগুলো পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থের দাবা খেলার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
যদিও বর্তমান সময়ে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শিল্পসমৃদ্ধ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো কল-কারখানার জন্য নিয়মিতভাবে তেল সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় নিজেদের স্বার্থে তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাদের প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস পেয়েছে। দেশগুলোতে তারা এমন ধরনের সরকার চেয়েছে, যে সরকার তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে চলবে। ১৯৩০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে বিশ^রাজনীতি বারবার আলোড়িত হয়েছে। ১৯৪৬ সালে প্রধানত উত্তর ইরান সংকট নিয়ে প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সূত্রপাত। এরপর ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম, ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সংকট, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। তাছাড়াও ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান, ঐতিহাসিক গঠন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুুতে পরিণত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রতিটি ইস্যুতে কোনো না কোনোভাবে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ, জাতি বা গোষ্ঠী ও গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়।
এমনকি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেখা যাবে, মধ্যপ্রাচ্য বিশ্ব রাজনীতির মূল আলোচনায় রয়েছে। কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য। এটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মিলনস্থলের কতিপয় রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত। এসব দেশের বৃহৎ শক্তির আধিপত্যের ওপর নির্ভর করে শক্তির ভারসাম্য। এই অঞ্চল থেকে জল, স্থল ও আকাশপথে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যোগাযোগ অত্যন্ত সহজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এই অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত এবং মার্কিনবিরোধী বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রও এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে উপসাগরীয় ৬টি আরব দেশে বিশ্বের মোট ৬০ ভাগের বেশি তেল মজুত আছে। আবার মধ্যপ্রাচ্য বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর অস্ত্র বিক্রির একটা বিশাল বাজার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে তার অস্ত্রের বাজার সম্প্রসারণ করে, যা এখনো পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
মধ্যপ্রাচ্যে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ দিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গ এই অঞ্চলের অস্থিরতাকে জিইয়ে রেখেছে এবং তেল সম্পদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। তেল বাণিজ্যের মূলশক্তি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সৌদি আরবসহ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের মতো দেশ এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের বহুমুখীকরণ করছে। এ অঞ্চলে বিশে^র জ্বালানি তেলের ৩৬ শতাংশ উৎপাদিত হয়। আর বিশে^ যত তেল রপ্তানি হয়, তার ৪৬ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্য থেকেই হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের ২২ শতাংশ এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩০ শতাংশ আসে এ অঞ্চল থেকে। তেল ও গ্যাসের ব্যাপক মজুতও আছে মধ্যপ্রাচ্যে। বিশে^র মোট তেলের ৫২ শতাংশ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪৩ শতাংশ এ অঞ্চলে মজুত রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করত। কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এশিয়ার উত্থান সেই হিসাব পাল্টে দিয়েছে। ২০২২ সালে সৌদি আরব চীনের নিকট সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করেছে; যা মোট রপ্তানির ২৭ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের নিকট রপ্তানি ছিল ২৫ শতাংশ। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণও পাল্টে গেছে। সৌদি আরব এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কোন্নয়ন করছে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন অর্থনীতির নতুন নতুন খাত তৈরি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি অন্যতম।
মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনীতি বহুমুখীকরণের নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ। ইতোমধ্যে তেলের দাম বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকে আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে অলিভিয়ের গৌরিঞ্চাস বলেছেন, তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে প্রবৃদ্ধির হার ০.১৫ শতাংশ হ্রাস পায় এবং সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ে ০.৪ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির নতুন রূপান্তর ঘটেছে; যখন মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করা যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে চীন-রাশিয়ার নজর পড়ে অঞ্চলটিতে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। দুই দেশের ভূরাজনৈতিক ও আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের জেরে এখানকার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। সুন্নি মুসলিম বিশে^র রক্ষক হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবের প্রভাব ও দেশটির পশ্চিমাপ্রীতির কথা সকলেরই জানা।
সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সমৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, আঞ্চলিক গ-ি পেরিয়ে বহির্বিশে^ নিজের প্রভাব রাখার বিষয়টি দৃশ্যমান। ইরানের আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার পেছনে এর ভৌগোলিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। কারণ, রাষ্ট্রটি আরব, তুরস্ক, রাশিয়া ও ভারত উপমহাদেশের মধ্যকার একটি কৌশলগত সংযোগস্থলে অবস্থিত। এটি মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য উপসাগর, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং তিনটি সমুদ্র অর্থাৎ ক্যাস্পিয়ান, পারস্য উপসাগর এবং ওমান সাগরের প্রবেশে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট।
ইরান নিজেকে শিয়া মুসলিম বিশ্বের রক্ষক মনে করে। এ কারণে ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের মতো দেশে শিয়াপন্থি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমর্থন পেয়ে আসছে ইরান। দিন দিন ইরানের শক্তিশালী হয়ে ওঠা ও বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সমর্থন লাভ সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য উদ্বেগের কারণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি ও শক্তি অর্জন করায় সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্য-পূর্বাঞ্চলের রাজনীতি এবং ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত মিত্র হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই প্রভাবশালী দেশের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। বিদেশী বিনিয়োগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বৈশি^ক তেলের বাজারে প্রভাব বিস্তার এবং ইয়েমেন যুদ্ধের গতিপথ নিয়ে দুই দেশের বিরোধিতা প্রকাশ পাচ্ছে।
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সাম্প্রতিক অস্ত্র বিরতির মধ্যস্থতা করার পর মধ্যপ্রাচ্যের গ্যাসসমৃদ্ধ দেশ কাতার আলোচনায় উঠে আসে। এতে করে পশ্চিমাদের নিকট কাতারের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ না হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে তুরস্কের উপস্থিতি বেড়েছে। ২০২১ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে মনোযোগ দিয়েছে তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যে গত কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে আলোচিত ভূরাজনৈতিক ইস্যু আরব-ইসরাইল কূটনৈতিক সম্পর্ক। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কয়েক বছর ধরে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যেখানে আরব দেশগুলোর অনেকেই ইসরাইলের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির পাশাপাশি ফিলিস্তিন ইস্যুকে বাইরে রেখে শুধু নিজেদের ইস্যু নিয়ে মনোযোগ দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে অঞ্চলটিতে নতুন ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে চীন ও রাশিয়াকে দেখা যাচ্ছে। সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা এবং রুশ সফলতায় ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা এখন রাশিয়ামুখী। তবে চীনের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের কর্মসূচি ঘোষণার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক বিনিময় বেড়েছে বহুগুণ। সৌদি আরব ও ইরানকে কাছাকাছি আনার প্রচেষ্টা ছিল মধ্যপ্রাচ্যে চীনের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য। যা পরাশক্তি হিসেবে দেশটিকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা বাড়তে থাকার পরই মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে অঙ্ক কষতে শুরু করে রাশিয়া।
এটিকে ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর দীর্ঘদিনের দুটি লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। তা হলো-মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের গ্রহণযোগ্যতা দুর্বল করা ও রাশিয়ার প্রভাব তৈরি করা। মধ্যপ্রাচ্য, আরব দেশ ও এর বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মনে করা হচ্ছে- একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের উত্থান হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান এবং দেশটির সঙ্গে অনেক দেশের অংশীদারিত্ব, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অবকাঠামো ক্ষেত্রে। এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব ও স্বার্থ হ্রাস, পাশাপাশি রাশিয়া ও তুরস্কের চ্যালেঞ্জ; যা আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ও বিষয়গুলোতে আরও সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতির আধুনিকীকরণ ও বৈচিত্র্যকরণ এবং তেল ও গ্যাস রাজস্বের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে তাদের তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য আরও সুযোগ বৃদ্ধি করতে চাইছে। এই অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর এখন আরও প্রগতিশীল, বাস্তববাদী ও সহনশীল হয়ে উঠছে। নারী অধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ধর্মীয় শিক্ষা সংস্কারের সমর্থনও এখানে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। নতুন মধ্যপ্রাচ্য জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তি ও সুরক্ষার মতো বৈশি^ক ইস্যুতে আরও সক্রিয় এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালন করছে।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়