.
শুরুতেই স্বীকার করে নেই আজকের উত্তাল বাংলাদেশে। বাংলাদেশকে যখন নতুন করে চিনছি, তখন শিখছি অনেক নতুন নতুন টারমিনোলজিও- যেমন ‘জেন জি’। হলফ করে বলছি গত শতাব্দীর শেষার্ধ্বে যে সময়টায় আমার জন্ম, সেই সময়টায় বেড়ে উঠতে গিয়ে টাইপরাইটার দেখেই আমরা অবাক হতাম, কম্পিউটারতো ছিল চিন্তারও বাইরে। বলাকা সিনামা হলে ঢাকা কলেজ থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ছবি দেখা ছিল আমাদের জমানার বিরাট এডভেঞ্চারাস বিলাসিতা। আজকের মতো নেটফ্লিক্সে চ্যানেল টিপে মুহূর্তে হাজারো সিনেমা থেকে পছন্দেরটি বেছে নেওয়া আমাদের সেই জমানায় ছিল স্বপ্নেরও অতীত।
কাজেই ঘটমান এই দিনগুলোতে যতই বুঝতে পারছি যে, জেন জিকে চেনাতো দূরে থাক, এই শব্দটাই আমার অনেক অচেনা আর চেষ্টা করেছি নতুন এই জেনারেশনকে আরেকটু ভালোভাবে চেনার-বোঝার, তখনই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে সমাগত আরেকটি পাঁচ আগাস্ট, শেখ কামালের আরও একটি জন্মদিন। আর দিনটি নিয়ে লিখতে বসে হঠাৎই উপলব্ধিটা হলো। জেন জির ভাষা বুঝে উঠতে আমাদের দেরিটার সুযোগে যেমন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ করে নিয়েছে কিছু অশুভ শক্তি, ঠিক তেমনি আমরা শেখ কামালের মতো ক্ষণজন্মা মানুষটিকে কখনোই ঠিক-ঠাক বুঝে উঠতে পারিনি বলেই তাকে নিয়ে আমাদের কতই না বিভ্রান্তি। এতে তার কি ক্ষতি হয়েছে জানি না, কিন্তু দেশের ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক অনেক বেশি।
ক্ষনজন্মা একজন মানুষ ছিলেন শেখ কামাল। ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। পৃথিবীতে তিনটি দশকও পুরো করতে পারেননি, কিন্তু এর মধ্যেইতো করে গেছেন কত কিছুই। এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতার জনক তিনি। তার প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হাত ধরেই হাতে সেলাই করা ফুটবল আর গেঞ্জি-হাফপ্যান্ট সরিয়ে এদেশে আধুনিক জার্সি পরা ফুটবলারদের পায়ে গড়িয়েছে আধুনিক ফুটবল। আবার এই ফুটবলকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন অন্য জায়গাতেও। কামাল স্পোর্টিং ক্লাব আর ইস্ট অ্যান্ড স্পোর্টিং ক্লাবের মাধ্যমে তিনি পুরনো ঢাকার মানুষকে শুধু ক্রীড়ামনস্কই করে তোলেননি, তাদের তিনি তুলেছিলেন আওয়ামী লীগের নৌকায়ও। যার সুফল এখনো ভোগ করছে আওয়ামী লীগ তার মৃত্যুর প্রায় পাঁচটি দশক পরও।
আজকের জেন জি গেম অব থ্রোনস জাতীয় যেসব সিরিজের অনুরক্ত, এ জাতিকে তাও চিনিয়েছিলেন এই শেখ কামালই। সেই জমানায় বাংলাদেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনের তিন পর্বের প্রথম টিভি সিরিয়ালটি যাত্রা তার হাতেই। ঠিক তেমনি ঢাকা জেলা পরিষদ মিলনায়তনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মঞ্চনাটক মঞ্চায়নের কারিগরও শেখ কামালই। নিজে যেমন খেলতেন ক্রিকেট, বাস্কেটবল আর ফুটবল, তেমনি বাজাতেনও নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। ছিলেন যেমন সফল ক্রীড়া সংগঠক, তেমনি সংগঠিত করেছিলেন ব্যান্ড সংগীত দলও। সত্যি বলতে কি, স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের পুনঃজাগরণ শেখ কামালের হাত ধরেই।
একাত্তরে শেখ কামাল যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ভারতে কমিশনপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন শেখ কামাল। পাসিং আউটের মেধা তালিকায় তার স্থান ছিল পঞ্চম। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানীর এডিসির দায়িত্ব পালন করেছিলেন শেখ কামাল। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন প্রাণের ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগের সভাপতিত্ব নেননি কখনই। কিন্তু ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করায় রেখেছিলেন দারুণ ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কেন্দ্রিক নাট্য আর সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রেও ছিলেন শেখ কামাল।
অথচ এই শেখ কামালকেই আমরা চিনে উঠতে পারিনি। পঁচাত্তরের পর তাকে নানা রঙের কালিতে থেকে যে বিকৃত উপস্থাপনা জাতির সামনে, তাতে পার্থিব মায়া কাটিয়ে সাত আসমানের ওপারে শেখ কামালের যায় আসে না কিছুই। কিন্তু আমাদের তো এসে গেছে কত কিছুই। এই যে, আমাদের জেন জিদের কথা আর কাজ আমাদের এত বেশি অচেনা, তাদের এখন যতই আরও ভালোভাবে ক্রমাগত বোঝার চেষ্টা করছি, শুধুই মনে হচ্ছে যদি শেখ রেহানার মতো শেখ কামালও বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানি চলে যেতেন! গত শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে যিনি আজকের জেন জির ভাষায় কথা বলছিলেন আর করে দেখাচ্ছিলেন, তার সময়ের চেয়ে বহু দশক এগিয়ে থাকা এই মানুষটির সঙ্গে যদি এই জাতি আরও বেশি সময় পেত, আজকে অশুভ শক্তি বোধ করি কখনোই আজকের মতো এভাবে এই দেশটাকে নিয়ে খেলার সুযোগ পেত না। ভালো থাকুন শেখ কামাল, জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিন! অসময়ে আপনাকে হারিয়ে আপনার বাংলাদেশ ভালো নেই।
লেখক : ডিভিশন প্রধান
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ