
শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা
সবচেয়ে বিশাল ও ভারী যে লাশটি বাংলাদেশ নিজের বুকের কবরে বয়ে চলেছে, সেটি মুজিবের লাশ-হুমায়ুন আজাদ। এই একটি উক্তির মাধ্যমেই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ও হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায়কে প্রকারান্তরে তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে অসংখ্য দেশে রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটেছে। কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকা-ের প্রভাব সারাবিশ্বের মেহনতি এবং শোষিত মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষণিক সময়ের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে।
বিশ্বের নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত এবং মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হিসেবে শেখ মুজিবকে ভাবা হয়। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিশ্বকে তাঁর বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি শোষিত মানুষের জন্য আমরণ সংগ্রাম করে যাবেন। মৃত্যু অবধি গরিব দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল ছিলেন। আর তাঁকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলার জমিনে। নিষ্ঠুর থেকেও নিষ্ঠুরতম ছিল ঘটনাটি। বাংলার মানুষ আজও বঙ্গবন্ধুর শোকে মুহ্যমান। নিজের বিবেকের কাছে সকলেই দেনার দায়ে জর্জরিত।
বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুÑশব্দগুলো একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে সকল কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন। নিজের যৌবন, পারিবারিক দায়িত্ব সবই পেছনে ফেলে তিনি বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর বাঙালি যেন সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে বিশ্বের মানচিত্রে। তিনি তাঁর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করেছিলেন।
বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিলে তিলে প্রস্তুত করেছিলেন। বাঙালি জাতিও স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আকাক্সক্ষাকে পূরণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টায় বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তিনি অস্থিমজ্জায় লালন করেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তি। বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন সংগ্রামী চেতনা এবং ফলস্বরূপ ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ছিল বদ্ধপরিকর।
বঙ্গবন্ধু কেমন নেতা ছিলেন সে প্রশ্নকে সামনে নিয়ে কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করেছি মাত্র। প্রথমত, বিভিন্ন ভাষায় একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত সংখ্যক বই বের হয়েছে বিশ্বের অন্য কোনো নেতার নামে কিংবা স্মরণে এত বই বের হয়নি। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু রাজনীতিকে নিজের পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি রাজনীতিতে অমর কাব্যের মহাকবি। তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে তৎসময়ে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার শপথে হয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ। চতুর্থত, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আনীত স্বাধীনতাকে এখন পর্যন্ত কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তাকে কেউ অস্বীকার করেনি। পঞ্চমত, স্বাধীনতার পরেও ক্ষমতার লোভ কখনোই বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি গণভবন রেখে ধানম-ির ৩২ নম্বরে সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন।
দলীয় নেতাকর্মীদের নিকট তিনি প্রিয় মুজিব ভাই হিসেবেই ছিলেন, যদিও তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ রকম বহুমুখী গুণের অধিকারী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে উল্লেখ্য, প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বইটি নতুন রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতির ব্যাকরণ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রসঙ্গত, কারাগারের রোজনামচা বইটিও বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অনবদ্য দলিল। যেখানে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে বাধা-বিপত্তি ও সংগ্রামের বিশদ বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থেও বঙ্গবন্ধু লেখক হিসেবে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
প্রকৃত অর্থে, বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনকাল রাজনৈতিক গবেষণার বিষয়বস্তু। ঘটনার প্রবাহে জীবনের বাঁকে বাঁকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েই তরুণ প্রজন্মের গবেষকরা নতুন নতুন বিষয় আবির্ভাব ঘটাতে পারে। মানুষ কিভাবে সাধারণের নিকট তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সমকালীন রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সেটাই উঠে আসতে পারে গবেষণায়।
তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের নিকট শেখ মুজিবের জীবনকাল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হতে পারে। তিনি রাজনীতিটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সংসার, ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিয়ে তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। প্রত্যন্ত টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসে সমগ্র বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
আগস্ট মাস বাঙালির শোকের মাস। কারণ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাত্রিতে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাকে সপরিবারে হত্যা করে দেশী-বিদেশী কুটিলদের চক্রান্তে। যে বাঙালির জন্য সারাটা জীবন নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে সপরিবারে, সেটি কখনো তিনি চিন্তাই করতে পারেননি। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুকে বারবার হত্যার ছক সম্বন্ধে জানালেও তিনি ছিলেন নির্ভয় নির্ভার। তিনি বলেছিলেন, বাঙালি কখনোই আমাকে হত্যা করতে পারে না।
কারণ, জাতশত্রু পাকিস্তান বারবার সুযোগ পেয়েও বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম দৃঢ়তা ও পশ্চিমা বিশ্বের চাপের কারণে হত্যার সাহস দেখায়নি। সে বিবেচনায় যে বাঙালির জন্য তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেই বাঙালি কিভাবে তাঁকে হত্যার দুঃসাহস করবে? তাই শেখ মুজিব এ সংক্রান্তে কোনো গোয়েন্দা রিপোর্টে বিশ্বাস করতেন না। অবশ্য বাঙালির ওপর অতিরিক্ত বিশ্বাসই কাল হয়ে দাঁড়ায় শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য।
কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলোÑ এ প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এলে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করা যায়। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর আনীত স্বাধীনতাকে খুনিচক্র মেনে নিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রকল্প হাতে নেওয়ার ফলে বঙ্গবন্ধু এক শ্রেণির শোষকের রোষানলে পড়েন। তৃতীয়ত, তৎকালীন পশ্চিমা গোষ্ঠীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কারিশমাকে মেনে নিতে পারেনি। চতুর্থত, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতেন না। পঞ্চমত, দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য গ্রহণীয় পদক্ষেপের বাস্তবায়নের বিরোধিতাকারীগণই ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী।
স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে বাংলার কুটিলচক্র যখন হত্যা করে খুনের মরণনেশায় মেতে ওঠে, তখন সে দেশটি বিপদাপন্ন হয়ে ওঠে বিপথগামী সদস্যদের নেতৃত্বের কারণে। ভূলুণ্ঠিত হয় রাষ্ট্রিক কাঠামো। নষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশের সার্বিক কাঠামো নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষমতায় আসে সেনাশাসিত সামরিক সরকার। স্বাধীনতার চেতনাকে নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লাগে তৎকালীন সরকারগুলো।
কিন্তু মুজিবপ্রেমীরা ক্রমে ক্রমে সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ছিলেন বদ্ধপরিকর। সকল বাধা-বিপত্তি পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধ হয় মুজিবপ্রেমীরা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে খুনিদের বিচার করেছে। অবৈধ শাসকরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথ অবরুদ্ধ করে দেয়। ধিক্কার জানাই তাদের প্রতি। আগস্ট মাস মাতমের মাস, শোকের মাস। এ মাসে বাংলাদেশ সরকারের নিকট আবেদন- যত দ্রুত সম্ভব বঙ্গবন্ধুর খুনিদের (যাদের ফাঁসির রায় এখনো কার্যকর হয়নি) দেশে ফিরিয়ে এনে রায়কৃত শাস্তি কার্যকর করা হোক। যাতে কিছুটা হলেও দায়মুক্তি মিলে বাঙালির।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়