
প্রসঙ্গ ইসলাম
(গত শুক্রবারের পর )
নবী পরিবারের প্রশংসায় কুরআনের ১৭টি আয়াত নাজিল হয়। সূরা শুরার ২৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন (হে হাবীব) আপনি বলে দিন যে আমি (রাসূল) তোমাদের নিকট কোনো বিনিময় চাই না আমার বংশধর ও নিকটাত্মীয়দের ভালোবাসা ব্যতীত। ১৪৪৬ চন্দ্রবছর আগে ২৫ জিলহজ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর পবিত্র আহলে বাইতের অনন্য আত্মত্যাগের প্রশংসায় নাজিল হয়েছিল পবিত্র কুরআনের সূরা ইনসান বা দাহরের ৫-২২ নং আয়াত। এ ছাড়াও ৩৫ হিজরির এ দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফতের দায়িত্ব পালন শুরু করেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (রা.)।
একবার হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন অসুস্থ হয়ে পড়লে হযরত আলী (রা.) মানত করেন যে তারা সুস্থ হলে তিনি তিনটি রোজা রাখবেন। একই মানত করেন হযরত ফাতিমা (রা.) ও তার সন্তান ইমাম হাসান ও হুসাইন (রা.) এবং পরিচারিকা ফিজ্জা। ইমাম হাসান ও হুসাইন (রা.) সুস্থ হলে তারা মানত বা প্রতিজ্ঞা পূরনের জন্য রোজা রাখেন। ইফতারের জন্য কিছুই ছিল না ঘরে। হযরত আলী (রা.) এক রাত ধরে শ্রমিকের কাজ করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে সামান্য আটা কিনে আনেন।
সেই আটার এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে ৫টি রুটি বানান হযরত ফাতিমা (রা.) কিন্তু ইফতারির সময় একজন নিঃস্ব হতদরিদ্র্য ব্যক্তি এসে খাবার চাইলে ৫ জনই তাদের ৫টি রুটি দিয়ে দেন ওই নিঃস্ব ব্যক্তিকে। তারা শুধু পানি পান করে ক্ষুধার্থ অবস্থায় রাত কাটান এবং পরদিনও রোজা রাখেন। হযরত ফাতিমা (রা.) পরের দিনের ইফতারের জন্য আবার এক-তৃতীয়াংশ আটা দিয়ে আরো ৫টি রুটি বানান। এই দিন ইফতারের সময় আসে এক ইয়াতীম। সবাই তাদের রুটিগুলো ঐ ইয়াতীমকে দিয়ে দেন এবং কেবল পানি পান করে রাত কাটান। ৩য় দিনেও ঘটে একই ধরনের ঘটনা।
এবার এসেছিল মুক্তিপ্রাপ্ত অমুসলিম এক বন্দী। তাকে রুটিগুলো দিয়ে দেয়ায় ঘরের সব আটা শেষ হয়ে যায়। ফলে তারা তিনদিন ইফতার ও সেহরির সময় কেবল পানি পান করেছেন। কোন প্রতিদান এমনকি সামান্য মৌখিক কৃতজ্ঞতার আশা না করে নিজের জরুরী খাদ্য এভাবে দান করার নজির ইতিহাসে বিরল। এ সময় আবির্ভূত হন হযরত জিবরাইল (আ.)। তিনি সূরা দাহরের ১ম থেকে ২২ নং আয়াত পর্যন্ত পড়ে শোনান রাসূল (স.) কে। (ইমাম ফাখরে রাজি, আবুল ফারাজ জাওজি ও আল্লামা জালালউদ্দীন সিয়ুতিসহ বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মনীষী এ শানে নুজুলকে সমর্থন করেছেন)।
সূরা দাহরে এসেছে,আয়াত নং ৫. নিশ্চই সৎকর্মশীলরা বা পুণ্যাত্মারা পান করবে এমন পানীয় যাতে বেহেশতী কাফুর মিশ্রিত থাকবে, ৬. এটা এমন একটি ঝর্ণা বা প্র¯্রবন যেখান থেকে আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ পান করবে এবং তা প্রবাহিত করতে পারবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। ৭. তারা মান্নত বা প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করে এবং সেদিনের ভয় করে যেদিনের অনিষ্ট ছড়িয়ে পরবে ব্যাপকভাবে। ৮. তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। ৯. তারা বলে - কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’
বিখ্যাত হাদীস সংকলন তিরমিযী শরীফে সাহাবী হযরত জাবির ইব্ন আবদুলাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুলাহ (স.) কে তাঁর বিদায় হজ্জে আরাফাতের দিন তাঁর কাসওয়া নামক উষ্ট্রীতে আরোহিত অবস্থায় ভাষণ দিতে দেখেছি এবং তাকে বলতে শুনেছি : হে লোক সকল! নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা তা ধারণ বা অনুসরণ করলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; আল্লাহর কিতাব (আল কুরআন) এবং আমার ইতরাত অর্থাৎ আমার আহলে বাইত-পরিবারের সদস্যবৃন্দ।
নবী করীম (স.) এর পোষ্য উমার ইব্ন সালামা (রা.)-এর ঘরে নবী (স.) এর উপর এ আয়াত নাযিল হয় (অনুবাদ) : ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’- (৩৩:৩৩)।
তখন নবী করীম (স.) ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা.) কে ডাকেন এবং তাদেরকে একখানা চাদরে ঢেকে নেন। আলী (রা.) তাঁর পেছনে ছিলেন।
তিনি তাকেও চাদরে ঢেকে নেন। অতঃপর বলেন : ‘হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত। অতএব তুমি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দাও এবং তাদেরকে উত্তমরূপে পবিত্র কর।’ তখন উম্মু সালামা (রা.) বলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) আমিও কি তাদের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বলেন, তুমি স্বস্থানে আছ এবং তুমি কল্যাণের মধ্যেই আছ।
যায়েদ ইব্ন আকরাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুলাহ (সা.) বলেছেন : আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রেখে গেলাম যা তোমরা মজবুতভাবে ধারণ (অনুসরণ) করলে আমার পরে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার একটি অপরটির চাইতে অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ : আল্লাহর কিতাব যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত এবং আমার পরিবার অর্থাৎ আমার আহলে বাইত। এ দুটি কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না কাওসার নামক ঝর্ণায় আমার সঙ্গে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত। অতএব তোমরা লক্ষ্য কর, পরে এতদুভয়ের সঙ্গে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে।-(মুসলিম)।
হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আল্লাহ আবু বকরের কল্যাণ করুন। তিনি তার কন্যাকে আমার সঙ্গে বিবাহ দিয়েছেন, আমাকে দারুল হিজরাতে (মদীনায়) নিয়ে আসেন এবং নিজের সম্পদ দ্বারা বিলালকে দাস মুক্ত করেন। আল্লাহ উমারকে দয়া করুন। তিক্ত হলেও তিনি হক (সত্য) কথা বলেন। তার সত্য ভাষণই তাকে বন্ধুহীন করেছে। আল্লাহ উসমানের প্রতি অনুগ্রহ করুন। সে এত অধিক লাজুক যে, ফেরেশতারা পর্যন্ত তাকে সমীহ করেন। আল্লাহ আলীকে অনুগ্রহ করুন। হে আল্লাহ সে যেখানেই থাকুক, সত্যকে তার নিত্যসঙ্গী করুন।-(তিরমিযী)।
আল-মুসবির আল-হিময়ারী (রা.) থেকে তার মাতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উম্মু সালামা (রা.)-র নিকট প্রবেশ করে তাকে বলতে শুনলাম, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতেন : কোনো মুনাফিক আলীকে মুহাব্বত করতে পারে না এবং কোন মুমিন তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে পারে না। (মুসনাদে আহমদ) হুবশী ইবনে যুনাদা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আলী আমার থেকে এবং আমি আলী থেকে। যদি আমার কোন কর্তব্য উপস্থিত হয়, আমি নিজেই সম্পন্ন করি অথবা আমার পক্ষ থেকে তা আলী-ই সম্পন্ন করে।-(তিরমিযী)
সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী করীম (সা.) এর নিকট পাখির ভুনা গোশ্ত উপস্থিত ছিল। তিনি বলেন: ইয়া আল্লাহ! তোমার সৃষ্টির মধ্যে তোমার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তিকে আমার সঙ্গে এই পাখির গোশ্ত খাওয়ার জন্য উপস্থিত করে দাও। ইত্যবসরে আলী (রা.) এসে উপস্থিত হন এবং তাঁর সঙ্গে আহার করেন।-(হাকেম)। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী তার রাজতোরণ। আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আল হাসান আল হুসাইন উভয়ে জান্নাতী যুবকদের নেতা। (মুসনাদে আহমদ)।
হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন, আমার কোনো প্রয়োজনে এক রাতে আমি নবী করীম (সা.) এর কাছে গেলাম, অতএব নবী করীম (সা.) এমন অবস্থায় বাইরে এলেন যে, একটা কিছু তার পিঠে জড়ানো ছিল যা আমি জ্ঞাত ছিলাম না। আমি আমার প্রয়োজন সেরে অবসর হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার দেহের সঙ্গে জড়ানো এটা কি?
তিনি পরিধেয় উন্মুক্ত করলে দেখা গেল তাঁর দুই কোলে হাসান ও হুসাইন (রা.)। তিনি বলেন, এরা দুজন আমার পুত্র (নাতি) এবং আমার কন্যার পুত্র। হে আল্লাহ! আমি এদের দুজনকে ভালোবাসি। সুতরাং তুমিও তাদের ভালোবাস এবং যে ব্যক্তি এদেরকে ভালোবাসবে, তুমি তাদেরকেও ভালোবাস।-(মুসতাদরাক হাকেম)। (সমাপ্ত)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]