ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আরব লীগ

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৯ জুন ২০২৪

আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আরব লীগ

আরব লীগ হলো আরব রাষ্ট্রগুলোর সংহতিমূলক সংগঠন

আরব দেশগুলোর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার অঙ্গীকার করা হয়েছিল আরব লীগের সংবিধানে। তাতে বলা হয়েছে, যে কোনো বিদেশী আগ্রাসন রোধে সদস্য দেশগুলোর পাশে থাকবে আরব লীগ। নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটেও শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কয়েক দশক ধরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত আরব রাষ্ট্রগুলোকে অন্তত ফিলিস্তিনের অধিকার প্রশ্নে এক রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুর বাইরে আরও তিনটি ইস্যুতে আরব রাষ্ট্রগুলোর অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এগুলো হলো- ইরানের কার্যকলাপে উদ্ভূত হুমকিমূলক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ও রাজনৈতিক ইসরাইলের উত্থান। এসব কারণে আরব দেশগুলোর মধ্যকার ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে

আরব লীগ হলো আরব রাষ্ট্রগুলোর সংহতিমূলক সংগঠন। আরব লীগের পূর্ব নাম ছিল ‘লীগ অব আরব স্টেটস’। এটি আরব দেশগুলোর সবচেয়ে বড় সংস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের বহুপক্ষীয় কার্যক্রম প্রসারে ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এটি আরব রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি সংক্রান্ত একটি প্রভাবশালী পর্ষদ।  দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের ২২ মার্চ নিজেদের নিরাপত্তা ও আর্থিক উন্নয়নে পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকারে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। ১৯৪৪ সালের ৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত আলেকজান্দ্রিয়া প্রটৌকল আরব লীগের ভিত্তি। প্রতিষ্ঠাকালীন এর সদস্যসংখ্য ছিল ৭।

বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২২। ১৯৭৮ সালে মিসর-ইসরাইল শান্তি চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আরব লীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। মিসর আরব লীগ ত্যাগ করে এবং এর সদর দপ্তর কায়রো হতে তিউনিসিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালে মিসর পুনরায় আরব লীগে যোগ দেয় এবং এর সদরদপ্তর কায়রোতে স্থাপিত হয়। আরব লীগের উদ্দেশ্যসমূহ হলো- ১) আরব রাষ্ট্রগুলোর ভৌগোলিক সংহতি রক্ষার জন্য সমষ্টিগতভাবে কাজ করা, ২) বিদেশী শক্তির দখল থেকে আরব জনগণ তথা আরব ভূখ-কে মুক্ত করা, ৩) আরব রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ত্বরান্বিত করা এবং ৪) আরব রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ বিরোধসমূহ শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করা। আরব লীগের সংবিধানে ২০টি ধারা ও ৩টি সংযুক্তি রয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়নে তাদের রাজনৈতিক কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে আরব লীগ।

আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সাধারণ স্বার্থ রক্ষা করাও আরব লীগের দায়িত্ব। এছাড়াও আরব লীগ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। সেগুলো হলোÑ ক) কৃষি, শিল্প, মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসমূহ, খ) রেলপথ, সড়কপথ, নদীপথ ও আকাশপথে যোগাযোগ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, গ) জাতীয়তা, পাসপোর্ট, ভিসা এবং ঘ) সমাজ কল্যাণ, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি। 
আরব দেশগুলোর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার অঙ্গীকার করা হয়েছিল আরব লীগের সংবিধানে। তাতে বলা হয়েছে, যে কোনো বিদেশী আগ্রাসন রোধে সদস্য দেশগুলোর পাশে থাকবে আরব লীগ। নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটেও শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কয়েক দশক ধরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত আরব রাষ্ট্রগুলোকে অন্তত ফিলিস্তিনের অধিকার প্রশ্নে এক রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুর বাইরে আরও তিনটি ইস্যুতে আরব রাষ্ট্রগুলোর অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন ছিল।

এগুলো হলো- ইরানের কার্যকলাপে উদ্ভূত হুমকিমূলক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ও রাজনৈতিক ইসরাইলের উত্থান। এসব কারণে আরব দেশগুলোর মধ্যকার ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে পশ্চিমাদের নীতি হলো, এই বিষয়গুলোকে উসকে দিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেওয়া।  কিন্তু ইরাক ও লিবিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর হামলার সময় অন্য সদস্য দেশের সহযোগিতা, ইয়েমেনে সৌদি জোটের হামলা, সিরিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ প্রভৃতি সংকটে আরব লীগের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব রোধের নামে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিতে আরব লীগকেও দায়ী করা হয়।

কয়েকটি আরব দেশের সরকার ইরানের হুমকি সামাল দেওয়ার নামে ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা যত বৃদ্ধি পাবে, ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর এই সম্পর্ক আরও গভীর হবে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণার পর আরব লীগ প্রথম বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ে। এ সময় ইসরাইলের সঙ্গে কয়েকটি সদস্য দেশও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। আরব দেশগুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়।

এর মধ্যেই অখ- ফিলিস্তিনের দাবি থেকে জর্দান সরে আসে। আরব রাষ্ট্রগুলোর মতামত উপেক্ষা করে রাষ্ট্রটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে সমর্থন দেয়। সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলো ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবকে তাদের স্বার্থের প্রতি হুমকি বলে মনে করে। একদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বাকি সব রাষ্ট্রের বৈরিতা। এই দুই ধরনের দ্বন্দ্বের কারণে আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যে ফাটল ধরেছে। এর ফলে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে রুখে দাঁড়ানো তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
সিরিয়া ও লিবিয়ায় চলতে থাকা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো অপতৎপরতা চালাচ্ছে। মিসর, তিউনিসিয়া, জর্দান এবং আরও অনেক দেশে হামলা চালিয়েছে তারা। সন্ত্রাসীদের এই অপতৎপরতার জের ধরে আরব লীগের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ বেড়েছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ চাঙা হওয়ার পর আরব লীগ লিবিয়াকে বহিষ্কার করে। সংগঠনটি গাদ্দাফিকে উৎখাতকারী ন্যাটো বাহিনীকে সমর্থন দেয়। গাদ্দাফির পতনের পর বিদ্রোহী বাহিনীকেও আরব লীগ সমর্থন দেয়। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে আরব লীগ সিরিয়াকেও বহিষ্কার করে।

সিরিয়ার সদস্যপদ থাকা বা না থাকা নিয়ে আরব লীগের সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত। কয়েকটি সুন্নি আরব সরকার সিরিয়ার সদস্য থাকার বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করছে। তবে ইরাক ও তিউনিসিয়া সিরিয়াকে পুনরায় আরব লীগের সদস্য করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। আবার আরব বসন্তের মধ্যেই গোটা মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানও রাষ্ট্রগুলোর আন্তঃকোন্দল বৃদ্ধি করেছে। মিসর ও তিউনিসিয়ায় নির্বাচনে ইসলামপন্থিদের জিতে যাওয়া আঞ্চলিক বিভক্তি বাড়িয়েছে।

মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করার প্রশ্নে আরব লীগের মধ্যে বিভক্তি বৃদ্ধি করেছে। আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মতো দেশগুলো ইসরাইলকে এক ধরনের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। প্রকারান্তরে ফিলিস্তিনিদের সমস্যাকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে তারা। 
১৯৬১ সালে মিসর ও সিরিয়ার সমন্বয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র ভেঙে যাওয়ার পর আরব বিশ^কে অনেক আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে কুয়েতের ওপর ইরাকের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিকে কেন্দ্র করে ১৯৬০ সালে ইরাক-কুয়েত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, ১৯৬২-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ, যাতে মিসর এবং সৌদি আরবও জড়িয়ে পড়েছিল, ১৯৭০ সালে জর্দান ও ফিলিস্তিনি গেরিলাদের মধ্যে সংঘর্ষ, যা সিরিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে জটিল আকার ধারণ করে, ১৯৭২-১৯৭৬ পর্যন্ত দক্ষিণ ইয়েমেন এবং ওমানের মধ্যে দীর্ঘ সংঘর্ষ, ১৯৭৭ সালে মিসর ও লিবিয়ার মধ্যে সংঘটিত সীমান্ত সংঘর্ষ, ১৯৭৬ সালে স্পেনীয় সাহারার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে একদিকে আলজিরিয়া এবং অন্যদিকে মরক্কো ও মৌরিতানিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ, ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া লেবাননের গৃহযুদ্ধ, যাতে পরবর্তী সময়ে পিএলও এবং সিরিয়া জড়িয়ে পড়ে। তবে ১৯৬১ সালে সংঘটিত ইরাক-কুয়েত সংঘর্ষে প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে আরব লীগের সেনাবাহিনী যথাসময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে এবং তা প্রশমিত করতে সক্ষম হয়। এছাড়া আর কোথাও আরব লীগ এসব আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। 
১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকটের সময় আরব লীগ মিসরের পক্ষ হয়ে ইসরাইলের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি তারা ইসরাইলের অংশগ্রহণ রয়েছে এমন আন্তর্জাতিক সম্মেলনও বর্জন করে। ১৯৫৮ সালে লেবানন সংকট মোকাবিলা এবং ১৯৬২ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিসরের রাজধানী কায়রোতে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) প্রতিষ্ঠাকে আরব লীগের অন্যতম সাফল্য বিবেচনা করা হয়। আরব লীগ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ১৯৯৬ সালে আরব লীগের পূর্ণ সদস্যপদ অর্জন করে ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করলেও ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে আরব লীগের ভূমিকা প্রশ্নবিব্ধ। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় আরব লীগ আরবদের পক্ষে অবস্থান নেয়।

আরব অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতা অর্জনে আরব লীগের ভূমিকা প্রশংসনীয়। লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও পারস্য উপসাগরীয় শেখ শাসিত অঞ্চলসমূহের স্বাধীনতার বিষয়ে আরব লীগ সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি পাশ্চাত্য দেশসমূহের সহানুভূতি অর্জনের মাধ্যমে পরাধীন আরব অঞ্চলসমূহ মুক্ত করে। ১৯৫৭ সালে লীগের অর্থনৈতিক কাউন্সিল যৌথ আরব উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য Arab Financial Institution for Economic Development; যা আরব উন্নয়ন ব্যাংক নামে পরিচিত। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকার, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সহযোগিতা করা এই ব্যাংকের উদ্দেশ্য ছিল।

লীগের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন, খেলাধুলা ও যুব উন্নয়ন, আরব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রসার; সাহিত্য, বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ে উৎসাহ প্রদান, বিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলোর অনুবাদ, গ্রন্থাগার ও জাদুঘর স্থাপন, পেশাজীবী সংগঠন এবং গণমাধ্যমের উন্নয়ন। আর সামাজিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠানাদির উন্নয়ন, সামাজিক সমস্যাসমূহ অধ্যয়ন, সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণ, জনস্বাস্থ্য, ঔষধ, অপরাধ বিজ্ঞান ও শ্রম বিষয়ক কার্যক্রম। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উভয়ক্ষেত্রে আরব লীগ জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা যেমন- UNESCO, FAO, WHO, ILO প্রভৃতি সংস্থাকে সহযোগিতা করে।

আরব লীগের উদ্যোগে ১৯৫৩ সালে প্রথম আরব বিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৫৪ সালে আরব বিজ্ঞান ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ফেডারেশনের উদ্যোগেই ক্রমান্বয়ে অনেক আরব প্রকৌশল সম্মেলনসহ অনেক বিজ্ঞান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে লীগ সচিবালয় অধিভুক্ত আরব টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন এবং আরব পোস্টাল ইউনিয়নের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ বিশেষায়িত সংস্থাগুলোর কাজ হচ্ছে, আরব দেশগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত তথ্য ও পরামর্শ বিনিময় এবং সদস্য দেশগুলোর ডাক ও টেলিযোগাযোগ কার্যক্রমের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করা।

আরব লীগের প্রতি মুসলিম বিশে^র বিশেষত আরব মুসলিমদের ব্যাপক প্রত্যাশা থাকলেও শীর্ষ সম্মেলনগুলোতেও তার কোনো প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় না। কিছু নিন্দা প্রস্তাব ও অঙ্গীকারসর্বস্ব ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রতিটি শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়। আবার ঘোষণা ও অঙ্গীকার থাকলেও তা বাস্তবায়নের রূপরেখা কেমন হবে তার উল্লেখ থাকে না। আরব রাষ্ট্রগুলোকে বুঝতে হবে যেমন নিজেদের মধ্যকার এই দূরত্বে তারা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ঠিক ততটাই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ^ ও ইসরাইল লাভবান হবে। 
আরব লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রথমদিকে আরবদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী সময়ে তা খুব একটা পরিলক্ষিত হয়নি। অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংগঠনটির সফলতা সীমিত। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত ও বংশীয় শত্রুতা ইত্যাদি মোকাবিলায় আরব লীগের অসহায়ত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় নীতি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে আরব লীগের নীতি ও উদ্দেশ্যের ব্যাপক ব্যবধান ছিল। বিদেশী শাসনাধীন থাকার ফলে রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে।

এই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রগুলোকে আরব লীগের নীতি ও উদ্দেশ্যের পথে পরিচালিত করাও ছিল কষ্টসাধ্য বিষয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দ্বন্দ্ব নিরসন ও একটি অভিন্ন আরব বাজার প্রতিষ্ঠায় আরব লীগের ব্যর্থতা লক্ষ্য করার মতো। তবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরব লীগের সফলতা রয়েছে। আরব বিশে^র উন্নয়ন, সংহতি এবং ঐক্যের জন্য আরব লীগকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় আরব রাষ্ট্রগুলো যদি একসঙ্গে কাজ করে এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। 
লেখক : অধ্যাপক,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×