ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল কাদের

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

প্রকাশিত: ২১:১৫, ১৩ জুন ২০২৪

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল কাদের

মোহাম্মদ নুরুল কাদের

১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে স্বাধীনচেতা নুরুল কাদের ব্যবসা শুরু  করেন। কঠিন পরিশ্রম ও উন্নয়নের পথে একনিষ্ঠ বিশ্বাস নিয়ে তিনি এগিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ো কর্পোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তিনি তৈরি পোশাকের উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান দেশ গার্মেন্টস স্থাপন করে বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থায় নতুন দিকনির্দেশনা দেন। তার প্রদর্শিত পিঠাপিঠি ঋণপত্র ব্যবহারভিত্তিক আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়া ধরে দেশের 
তৈরি পোশাক উৎপাদনের শিল্প দ্রুত স্থাপিত ও প্রসারিত হয়

নুরুল কাদেরের (ঝিলু ভাই) জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ ডিসেম্বর। তার বাবা আব্দুল লতিফের কর্মস্থল ছিল বিক্রমপুরের টঙ্গীবাড়ীতে। তার ¯েœহময়ী মা ছিলেন কুলসুম বেগম। ঢাকার আরমানীটোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৫০ সালে। তারপর ঢাকা কলেজ ধরে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ নেন পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুরে।

১৯৫৪ সালে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বিমান বাহিনী ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন বাণিজ্য বিভাগে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি পদে। তারপর ১৯৬১ সালে সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যশোরে সহকারী কমিশনার হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।

১৯৭৬-৭৯ সালে কাজ করেছি যশোরের জেলা প্রশাসক পদে। তখন শুনেছি এককালে সে জেলার সহকারী কমিশনার নুরুল কাদেরের সপ্রতিভ একাগ্রতার কথা। ঘটনাক্রমে আমিও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ঢোকার আগে পড়াশোনা করেছিলাম আরমানীটোলা সরকারি বিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজে। ১৯৬৮ সালে রিসালপুরের লাগোয়া নওশেরায় সহকারী কমিশনার হিসেবে পদায়িত ছিলাম।

তখন রিসালপুরের বিমান ঘাঁটিতে ২য় প্রধান হিসেবে কর্মরত বাঙালি আব্দুল গাফ্ফার মাহমুদের (জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়কার উপসামরিক আইন প্রশাসক) কাছ থেকে শুনেছি নুরুল কাদেরের অদম্য স্বাধীন আচরণের কাহিনী। 
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ১৭ পর্যন্ত সময়কালে নুরুল কাদের সর্বাত্মক নিপুণতা ও দেশাত্মবোধের সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সুযোগ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ভারত সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ যোগাযোগ রক্ষা করা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম ও দায়িত্বাদি সমন্বয়করণ, মুক্তিযুদ্ধের দার্শনিক ও প্রায়োগিক প্রচার, বাংলাদেশী ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকরণ ও সমন্বয় সাধন, বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ স্থাপন ও বাড়ানো, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ রক্ষাকরণ ইত্যাদি বিষয় ও ক্ষেত্রে নুরুল কাদের সরকারের সমন্বয়কারী, মুখপাত্র ও পরামর্শদাতা হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা অতুলনীয় মেধা, দেশপ্রেম, সপ্রতিভাবান ও কর্মতৎপরতার পরিচায়ক।

নুরুল কাদেরের সুপারিশ অনুযায়ী ৭১ সালের জুন মাসে প্রবাসী সরকার দেশের সকল এলাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রম সমন্বয় করার জন্য ১১টি আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করে। এসব কাউন্সিলে দক্ষ আমলাদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে সকল জনশৃঙ্খলা ও জনহিতকর পদক্ষেপাদি নেওয়া শুরু হয়।

বিজয়ের অল্প কদিন আগে আগরতলা ষড়যন্ত্রের তথাকথিত আসামি রুহুল কুদ্দুসকে (সিএসপি ৪৯) প্রবাসী সরকারের মহাসচিব হিসেবে কলকাতায় সসম্মানে শিলং থেকে নিয়ে আসেন নুরুল কাদের। সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকায় খন্দকার মোশতাক ও পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর অনাকাক্সিক্ষত কার্যাদির ওপর নজর রেখেছিলেন নুরুল কাদের।

যার ফলে ৭১ সালের নভেম্বরেই তাদের তাদের স্ব স্ব পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল। নুরুল কাদেরের এসব ক্ষেত্রে সফলতার প্রাণশক্তি হিসেবে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। 
বিজয়ের পর ১৮ ডিসেম্বর নুরুল কাদের কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে ঢাকায় পৌঁছেন। ঢাকায় হেলিকপ্টার থেকে নেমে দু’হাতের মুঠোয় দেশের মাটি তিনি কপাল ছুঁইয়ে চলে যান সকল বাঙালির স্বপ্নসাধকে পূর্ণতা দেওয়ার উৎস শহীদ মিনারে।

পরে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সফল নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তিনি গেলেন সচিবালয়ে। সেখানকার ৬ নং ইমারতের ডাকঘরের সামনে পশ্চিমমুখী হয়ে পরাজিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সরকারের অতিরিক্ত সচিব নুরুল ইসলামকে (সিএসপি, ১৯৫০) পাশে নিয়ে শ’তিনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সংগ্রামী দাড়িশোভিত সুদর্শন নুরুল কাদের গর্বের সঙ্গে বিজয়ের অভিনন্দন জানালেন।

বললেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সবাই মিলে দেশকে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বললেন, বিদ্যমান সকল সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী স্বাধীন দেশের কর্মী হিসেবে দেশ গড়ার সুযোগ ও স্বীকৃতি পাবেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে শুনলাম তার আহ্বান। আমি তখন ছিলাম ঢাকায় অর্থ বিভাগের উপসচিব। আমাদের সঙ্গে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সহকর্মী খালেদ শামস (সিএসপি), হারুনুর রশিদ (সিএসপি) ও আখতার আলী (সিএসপি)।

জয় বাংলা ধ্বনিতে মুহ্যমান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মূলমন্ত্র নিয়ে জনতার সেবা ও দেশের উন্নয়নের সর্বাত্মক দায়িত্ব পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম আমরা। মুগ্ধ হলাম এতদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব নুরুল ইসলামের প্রতি বীর বিক্রমে বিজেতা বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন সচিব তথা প্রধান প্রশাসনিক অধিকর্তা নুরুল কাদেরের বিন¤্র ও সশ্রদ্ধ আচরণে।

অতিরিক্ত মুখ্য সচিব নুরুল ইসলামের আহ্বানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব ও প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নুরুল কাদের সচিবালয়ে মুখ্য সচিবের কক্ষে আসীন হলেন। সপ্রতিভ তৎপরতার সঙ্গে ফারুক চৌধুরীকে (পিএফএস) নিযুক্তি দিলেন পররাষ্ট্র সচিব, মোকাম্মেল হককে (সিএসপি)  ঢাকার জেলা প্রশাসক এবং খালেদ শামসকে (সিএসপি) রাজধানীর পৌরসভার প্রধান পদে। সকলকে সম্মান ও বিশ^াস নিয়ে স্বাধীন সরকারের সপক্ষে টেনে আনলেন নুরুল কাদের।
প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে প্রবাসী সরকার নুরুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি রূপরেখা তৈরি করে রেখেছিল। এই রূপরেখা অনুযায়ী সারাদেশে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য নুরুল কাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে গঠন করেন একটি কমিটি। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান  মাহবুবজামানকে (সিএসপি) এই কমিটির সভাপতি ও আমাকে সদস্য সচিব করা হলো।

দ্রুততম এক মাসের মধ্যে এই কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন কারার পর এর সুপারিশমতো সারাদেশে প্রশাসনিক বিন্যাস সাধন করা হলো। জেলা ও মহকুমা প্রশাসনকে সহায়তা ও সমর্থন দেওয়ার জন্য রাজনীতিক ও সুশীল সেবক সমন্বয়ে এই দুই স্তরে প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করা হলো। সংশ্লিষ্ট এলাকায় এসব প্রশাসনিক কাউন্সিলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এতদিন পর্যন্ত পরাজয়ী সরকারের লৌকিক অধীনে থাকা সুশীল প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিজয়ী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে চলে এলেন।

সন্তুষ্টির সঙ্গে এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী নবতম উদ্যমে স্বাধীন সরকার গঠন ও পরিচালনা করতে এগিয়ে আসলেন। স্বাধীন সরকার লক্ষ্য করল এতদিন পর্যন্ত এ কর্মকর্তারাই প্রায় সকল ক্ষেত্রে ও সময়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী কোনো কর্মকর্তার সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব বাজেয়াপ্তের হুকুম তামিল, দখলদার সরকারের সমর্থনে জনসমর্থন ও উন্নয়নের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেননি, প্রদেশে কর্মরত কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির কার্যত অবসায়ন করেননি, কোনো পুলিশ সদস্যকে দিয়ে মুক্তির পথে যাত্রী কোনো যুবককে সহজে শাস্তি দিতে তৎপর হননি।

বিজয়ের প্রাক্কালে ঢাকায় কর্মরত প্রবীণ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অফিসারদের প্রাদেশিক গভর্নরের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে বন্দি বা হত্যা করার ষড়যন্ত্রও বিফল করেছিলেন বেসামরিক প্রশাসনে কর্মরত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এক্ষেত্রে সারথির ভূমিকায় ছিলেন নুরুল ইসলাম অনু (সিএসপি ১৯৬৩)। তাকে সহায়তা করার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।
১৯৭৪ সালে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে স্বাধীনচেতা নুরুল কাদের ব্যবসা শুরু  করেন। কঠিন পরিশ্রম ও উন্নয়নের পথে একনিষ্ঠ বিশ^াস নিয়ে তিনি এগিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ো কর্পোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তিনি তৈরি পোশাকের উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান দেশ গার্মেন্টস স্থাপন করে বাংলাদেশের অর্থ ব্যবস্থায় নতুন দিকনির্দেশনা দেন।

তার প্রদর্শিত পিঠাপিঠি ঋণপত্র ব্যবহারভিত্তিক আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়া ধরে দেশের তৈরি পোশাক উৎপাদনের শিল্প দ্রুত স্থাপিত ও প্রসারিত হয়। তার অনুসৃত পথ ধরে শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প দেশে শিল্প বিপ্লব সূচিত করে, কর্মসংস্থানের নতুনতর ক্ষেত্র প্রসারিত ও বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পায়নের পন্থা প্রদর্শিত করে।

পথিকৃৎ অবদানের জন্য তিনি দেশের পোশাক শিল্পের জনক বলে সর্বমহলে স্বীকৃত হন। সে সময় আন্তর্জাতিক পত্রিকা ঞযব ঊপড়হড়সরংঃ ও ঋধৎ ঊধংঃবৎহ ঊপড়হড়সরপ জবারবি দেশ গড়ার কারিগর ও শিল্পায়নের পথিকৃৎ হিসেবে নুরুল কাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
মোহাম্মদ নুরুল কাদের ১৯৯৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। স্বাধীনতার সংগ্রামে একনিষ্ঠ অবদানের জন্য প্রতিবছর ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি স্মরণীয়। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসনিক কাঠামো বিনির্মাণে তার ভূমিকা বিভ্রান্তির এই ক্রান্তিলগ্নে অনুসরণীয়।

এ জাতির জন্য লজ্জার কথা যে, আমরা এখনো নুরুল কাদেরকে অদম্য মুক্তিযোদ্ধা ও সফল প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিতে অপারগ রয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ গঠনে বিরাট ও অনুসরণীয় অবদানের জন্য তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিতকরণ জাতির জন্য অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচনীয়।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী

×