ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

যাপিত জীবনযাত্রার পরিবর্তন

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১২ জুন ২০২৪

যাপিত জীবনযাত্রার পরিবর্তন

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

আজ ১৩ জুন গ্লোবাল ফ্যাটি লিভার দিবস। সবার অজান্তেই ফ্যাটি লিভার নামক প্যান্ডেমিকটি গোটা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বেশ কয়েক দশক ধরে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর ১৫ শতাংশের মতো মানুষ এই ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত, যা থামার কোনো লক্ষণ আপাতত আমাদের সামনে দৃশ্যমান নয়।

কোভিড এসে চলে গেলেও, কিন্তু জটিল সব অঙ্ক, বিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম ম্যাথেমিটিক্যাল মডেলিং বলছে- ২০৩০ সাল নাগাদ কমার বদলে ফ্যাটি লিভার বিশ^ব্যাপী বৃদ্ধি পাবে ৬০ শতাংশের মতো। বাংলাদেশেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটছে না। একটা সময় ছিল যখন হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস ছিল এদেশে লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সারের মতো লিভারের জটিল যত রোগের এক নম্বর কারণ।

এখনো তাই। পরিবর্তনের ছোঁয়াটা লেগেছে দ্বিতীয় স্থানটিতে। হেপাটাইটিস সি-ভাইরাসকে হটিয়ে এখন এই জায়গাটি ফ্যাটি লিভারের দখলে।
প্রশ্ন দাঁড়ায়, লিভারের চর্বিকে আমরা কখন ফ্যাটি লিভার বলব? আর ফ্যাটি লিভার মানেই বিনা মেঘে বজ্রপাত কি না? লিভারে এমনিতেই অল্পস্বল্প কিছু চর্বি জমা থাকে। শরীরের প্রয়োজনে সেই সঞ্চিত চর্বি থেকে শরীরকে শক্তির যোগান দেয় লিভার। কিন্তু বাংলায় যেমনটি বলে ‘বেশি ভালো, ভালো না’, ঠিক তেমনি বাড়তি চর্বিও লিভারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লিভারে বাড়তি চর্বি যেমন জমতে পারে অতিরিক্ত শর্করা বা চর্বি জাতীয় খাবার খেলে, তেমনি চর্বি জমতে পারে যারা মেদবহুল তাদের লিভারেও। পাশাপাশি ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডিমিয়া, হাইপোথাইরয়েডিজম, পলিসিস্টিক ওভারি আর হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোগীদের লিভারেও চর্বি জমে।

এই যে যাদের লিভারে জমল বাড়তি চর্বি, অর্থাৎ যারা ফ্যাটি লিভারের রোগী, তাদের সবার না হলেও কারও কারও লিভারে ওই বাড়তি চর্বির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে প্রদাহ বা ক্রনিক হেপাটাইটিস দেখা দিতে পারে, যার গাল ভরা নাম ‘নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিস’, সংক্ষেপে ‘ন্যাশ’। এই ন্যাশের রোগীদেরই কারও কারও লিভার একটা সময় পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়, যাকে আমরা লিভার সিরোসিস বলি। যাদের লিভার সিরোসিস হয় তাদের কারও কারও হতে পারে লিভারের ক্যান্সারও। 
ফ্যাটি লিভারের সবচেয়ে কার্যকর বা ধন্বন্তরী চিকিৎসাটির নাম ‘লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন’ বা ‘যাপিত জীবনযাত্রার পরিবর্তন’। অতিরিক্ত শর্করা আর চর্বি জাতীয় খাবার না খেয়ে পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত পাঁচটি দিন আধ ঘণ্টা করে হেঁটে আমরা লিভারটাকে ফ্যাটমুক্ত রাখতে পারি। পাশাপাশি যেসব রোগের কারণে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমে সেসব রোগেরও চিকিৎসা করতে হবে।

সঙ্গে ব্যবহার করা যায় ওবিটাকলিক এসিড, সারোগ্লিটাজার, সিমাগ্লুটাইড, টিরজাপেটাইড, রেজমেটেরন, ভিটামিন-ই, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের মতো ওষুধ যা রোগ আর রোগীর অবস্থাভেদে ভালোই কাজ করে। চিকিৎসার আগে যেহেতু রোগ নির্ণয়টা জরুরি, সে জন্য একটা ভালো এবডোমিনাল আল্ট্রাসাউন্ড আর ফাইব্রোস্ক্যান খুবই কার্যকর।
তবে মনে রাখতে হবে, আর দশটি রোগের মতোই ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রেও চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। এর জন্য চাই জনসচেতনতা। আমরা বারবার মার খেয়ে যাই এই জনসচেতনতার জায়গাটায় এসে।  কথাটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং সারা বিশে^র বেলায়ই প্রযোজ্য।

এই প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালের ৫ জুন গ্লোবাল লিভার ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে সারা বিশ্বের ১৫০ লিভার বিশেষজ্ঞের স্বাক্ষরিত একটি প্রেস রিলিজ ওয়াশিংটন, প্যারিস ও লন্ডন থেকে একযোগে প্রচারের মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবসের’ যাত্রা শুরু। যা এ বছর থেকে নাম পালটে পালিত হচ্ছে ‘গ্লোবাল ফ্যাটি লিভার দিবস’ হিসেবে। বাংলাদেশ থেকে আমার সুযোগ হয়েছিল এই ১৫০ জনের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে প্রেস রিলিজটিতে স্বাক্ষর করার। 
সেই থেকে প্রতিবছর বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ২০২০ ও ২০২১ সালে পর পর দুই বছর দিবসটি উদযাপিত হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস’ হিসেবে।

এ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হেপাটোলজি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আর ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশের মতো লিভার বিশেষজ্ঞদের পেশাভিত্তিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোসহ নানা সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্যাটি লিভার দিবস পালন করছে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, মানুষকে লিভারের এই নীরব ঘাতকটি সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা এবং দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য আরও ভালোভাবে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া।

লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন,  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশ

×