ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রসঙ্গ ইসলাম

শিক্ষার গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ১৮ জানুয়ারি ২০২৪

শিক্ষার গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা

প্রসঙ্গ ইসলাম

স্বভাবতই শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। মহান আল্লাহ তায়ালাও শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষক মাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী

শিক্ষা ও শিক্ষকের মর্যাদা চিরন্তন। মানব জাতির সমস্ত জুলমাত অন্ধত্ব আর বিভ্রান্তির পেছনে শিক্ষাহীনতা বা কু-শিক্ষাই দায়ী। ইসলাম ইমানের আগেই ইলমের ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শিখ। যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর, তাকে সম্মান কর।’ (আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস ৬১৮৪)। শিক্ষা অনুযায়ী, মানবচরিত্র গঠন ও কর্মের সমন্বয় সাধনই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তাগিদ।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর পরে, রাসূলের পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে জ্ঞান অর্জন করে ও পরে তা প্রচার করে’ (মিশকাত)। স্বভাবতই শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। মহান আল্লাহ তায়ালাও শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষক মাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। এক কথায় বলা যায়, শিক্ষক মানুষ চাষ করেন।

যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয়ে একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা জাতিসংঘের শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও সনদেও স্বীকৃত। যারা শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত বা শিক্ষাদান করেন তাদের জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও যৌথ উদ্যোগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদাবিষয়ক সনদ তৈরি করেছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই মর্যাদাবিষয়ক সনদটি গৃহীত হয়।

মহানবী (সা.) ঐশী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানবজাতিকে সৃষ্টিকর্তা, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিমালা শিক্ষাদান করেছেন। তিনি নিজেই এ পরিচয় তুলে ধরে ঘোষণা করেছেন-‘শিক্ষক হিসাবে আমি প্রেরিত হয়েছি (ইবনু মাজাহ : ২২৫)।’ একজন প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সত্যিকার শিক্ষক সমাজ বদলে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। আদর্শ শিক্ষকই শুধু আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করতে পারেন। জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ দিতে পারে।

এ মর্মে নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দুই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও পদ গৌরবের ও লোভনীয় নয়। তা হলো-১. ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধনসম্পদ দান করেছেন এবং তা সৎপথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন ২. ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ বিদ্যা দান করেছেন এবং সে অনুসারে সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয় (বুখারি : ৭১)। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন কর।’ উমর (রা.) ও উসমান (রা.) তাদের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা শিক্ষক ও ধর্ম প্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। হজরত উমর (রা.), ওসমানের (রা.) যুগে মুয়াজ্জিন, ইমাম ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো (কিতাবুল আমওয়াল, ১৬৫)। শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে, শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। 
কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি শিক্ষকের সম্মানের বিষয়ে এখন রূপকথামাত্র। আগে বলা হতো শিক্ষকের সেবা করলে উন্নতি হয়। আর এখন সমাজের কোনো কোনো স্থানে হর হামেশাই শিক্ষকরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। বাদশাহ আলমগীরের ছেলে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন। একদিন বাদশাহ দেখলেন তার সন্তান শিক্ষকের চরণে শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছেন। এটা দেখে বাদশাহ শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন। শিক্ষক ভয়ে কাতর, বাদশাহর ছেলেকে দিয়ে চরণে পানি ঢালার সেবা নিয়েছেন। গর্দান বুঝি যায় এবার।

চরণে শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছে, হাত দিয়ে কেন পা ধুয়ে দিচ্ছে না, তা সন্তানের শিক্ষার মধ্যে আনা উচিত ছিল, এটা বোঝানোর জন্যই তিনি শিক্ষককে ডেকেছিলেন। শিক্ষকের প্রতি সন্তানের এটুকু অবহেলাও মেনে নিতে পারেননি বাদশাহ আলমগীর। কিন্তু এখন শিক্ষকের পুরো গা ধুয়ে দিচ্ছে, পাঁজাকোলো করে পুকুরে ফেলে দিচ্ছে। 
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা কাঠামোর একটি ভিন্ন চিত্র ছিল। শিক্ষকের অপরিসীম মর্যাদা ছিল। তখনও বইপত্রের যুগ শুরু“হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষার একটি ধারা ছিল গুরুগৃহে জ্ঞানচর্চা। রাজা-মন্ত্রীর ছেলেরা গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চা করতেন। গুরুরা বনের ভেতর কুটিরে জীবন-যাপন করতেন। ধর্মচর্চা করতেন। রাজা-মন্ত্রী তাদের ছেলেদের নিয়ে এসে করজোড়ে প্রার্থনা জানাতেন। অনুনয় করতেন গুরু যাতে তাদের সন্তানদের দায়িত্ব নেন। রাজপুত্র, মন্ত্রিপুত্ররা গুরুর কুটিরে থেকে গুরুর সেবা করে জ্ঞানার্জন করতেন।

এখন সেই যুগও নেই, শিক্ষকের মর্যাদাও নেই। ইমাম আযম আবু হানিফা (র.) শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার শিক্ষক ইমাম হাম্মাদ (র.) যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন আমি তার বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি। আমার মনে হতো, এতে যদি শিক্ষকের প্রতি আমার অসম্মান হয়ে যায়।’
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুও শিক্ষকদের সম্মানের চোখে দেখতেন। প্রসঙ্গক্রমে ১টা ঘটনা উল্লেখ করছি। চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান প্রফেসর ইন্নাস আলী স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু উপাচার্যদের প্রায়ই ডাকতেন।

বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত চাইতেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব সম্মান দেখাতেন। ওনার রুমে ঢুকলেই দাঁড়িয়ে যেতেন। অনেক সময় হয়তো মিটিং চলছে তখনও এ রকম দাঁড়িয়ে সম্মান করতেন।’ প্রকৃত শিক্ষাবিদরা কখনও আদর্শ শিক্ষা বিকাশে আপোস করতেন না। ১৮৫০-এর দশকে বাঙালিদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন, বিদ্যাসাগর তাদের অন্যতম। তা সত্ত্বেও কেবল শিক্ষানীতিতে সরকারের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না বলে, আদর্শের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাধারণ লোকেরা তখন নাকি তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়লে খাবেন কি করে?’

তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তিনি আলু, পটোল বিক্রি করবেন, তা-ও ভালো। কিন্তু আপোস নয়। বলাবাহুল্য, একটা সময় ছিল যখন অন্যের সন্তানকে মানুষ করার অদম্য প্রয়াস ছিল শিক্ষকের মাঝে। পেশা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। পেশাই ছিল ধ্যান-জ্ঞান আর নেশা। তাদের নীতি ও আদর্শ সব কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল। বই-পুস্তকে সর্বদা ডুবে থাকতেন। জানার পরিধি বাড়ানোর এক অনমনীয় নেশায় ব্যস্ত থাকতেন। ছাত্রের মাঝে নিজের জ্ঞানটুকু ছড়িয়ে দিতে কত না আন্তরিক ছিলেন।

দিনে দিনে শিক্ষককে নানা দুর্নাম পেয়ে বসেছে। নোট-গাইডের বদনাম। কোচিং-বাণিজ্যের বদনাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বদনাম। প্রশ্নফাঁসের বদনাম। বই-পুস্তকের সঙ্গে অনেক শিক্ষকের কোনো সখ্যই নেই। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটুকু পড়ে এসেছেন, তা দিয়েই শিক্ষকতা চালিয়ে নিতে চান। খুব কম শিক্ষক পাওয়া যায় যারা বই পুস্তকে লেগে থাকেন।
লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×