
ছবি: সংগৃহীত
উচ্চশিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা যেমন ব্যবহার করছেন, তেমনি অনেক শিক্ষকও এখন চ্যাটজিপিটির মতো টুল ব্যবহার করছেন কোর্স তৈরির কাজে। কিন্তু এ ব্যবহার নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক।
নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের শিক্ষার্থী এল্লা স্ট্যাপলেটন গত ফেব্রুয়ারিতে তার “অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার” কোর্সের লেকচার নোটে একটি অদ্ভুত বাক্য খুঁজে পান: “এক্সপ্যান্ড অন অল এরিয়াস. বি মোর ডিটেইল্ড এন্ড স্পেসিফিক.” - যেটি মূলত চ্যাটজিপিটিকে দেওয়া একটি নির্দেশনার মতো ছিল।
আরও খতিয়ে দেখে তিনি দেখতে পান, স্লাইডে ব্যবহৃত ছবিগুলোয় মানুষের অতিরিক্ত অঙ্গ রয়েছে এবং অনেক জায়গায় বানান ভুল- যেগুলো সাধারণত এআই দ্বারা তৈরি কনটেন্টে দেখা যায়। বিষয়টি তাকে বিস্মিত করে তোলে, কারণ কোর্সের সিলেবাসে শিক্ষক রিক অ্যারোউড স্পষ্টভাবে শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহারে নিষেধ করেছিলেন।
স্ট্যাপলেটন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “তিনি নিজে ব্যবহার করছেন, অথচ আমাদের নিষেধ করছেন - এটা দ্বিচারিতা।”
ঘটনার প্রেক্ষিতে স্ট্যাপলেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেন এবং কোর্সটির জন্য দেওয়া ৮,০০০ ডলারেরও বেশি টিউশন ফির রিফান্ড দাবি করেন। তবে সম্প্রতি, তার গ্র্যাজুয়েশনের ঠিক পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে।
অধ্যাপক রিক অ্যারোউড নিউ ইয়র্ক টাইমসকে স্বীকার করেন যে, ‘তিনি তার ক্লাসের কনটেন্ট চ্যাটজিপিটিতে দিয়ে তা “পরিশোধিত” করেছিলেন। তবে এ ঘটনার পর তিনি এআই ব্যবহারে আরও সতর্ক হচ্ছেন এবং এখন শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে তিনি কখন এআই ব্যবহার করছেন।’
এই ঘটনার পটভূমিতে উঠে এসেছে উচ্চশিক্ষায় এআই ব্যবহারের বিস্তৃত চিত্র। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টাইটন পার্টনার্সের ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, তখন ২২% শিক্ষক নিয়মিত জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করতেন। ২০২৪ সালের জরিপে দেখা যায়, এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশে।
শুধু শিক্ষকই নন, শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই। ওপেনএআই-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের এক-তৃতীয়াংশ নিয়মিত চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে এবং তাদের ২৫ শতাংশ মেসেজ থাকে পড়ালেখা ও শিখনসংক্রান্ত।
শিক্ষকরা এখন এআই ব্যবহার করছেন ক্লাস অ্যাকটিভিটি তৈরি, সিলেবাস লেখা, মূল্যায়নের রুব্রিক তৈরি এবং কুইজ-পরীক্ষা তৈরির কাজে। আর শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছে হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট এবং লেকচার নোট তৈরি করতে।
এই প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নতুন নীতিমালা তৈরি করেছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি যেমন শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহারে ব্যক্তিগত ও গোপনীয় তথ্য রক্ষা এবং তথ্য যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি আবার চ্যাটজিপিটি ব্যবহারে শিক্ষকের অনুমতি বাধ্যতামূলক করেছে।
তবে এআই-চিহ্নিতকরণ সফটওয়্যারের ফাঁকিও দিচ্ছে কিছু শিক্ষার্থী। নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের রিপোর্ট অনুযায়ী, অনেক শিক্ষার্থী এআই দ্বারা লেখা অ্যাসাইনমেন্টে ইচ্ছাকৃত বানান ভুল রেখে তা ‘মানবীয়’ করে তোলে, যাতে চিহ্নিত না হয়।
এআই-এর প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকেরা। মাইক্রোসফট ও কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, এআই ব্যবহারকারীরা যদি খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, তাহলে তারা কম সমালোচনামূলক চিন্তা করেন।
গবেষকদের ভাষায়, “যদি ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে প্রযুক্তি মানুষের মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় দক্ষতা নষ্ট করতে পারে।”
এই ঘটনা ও গবেষণাগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এআই ব্যবহারের সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতা-উভয়দিক নিয়েই নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
সূত্র: https://shorturl.at/AhY5D
মিরাজ খান