ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

নারী মুক্তির অগ্রদূত

রাশেদা খালেক

প্রকাশিত: ২১:০৪, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

নারী মুক্তির অগ্রদূত

বেগম রোকেয়া

ভাবতে অবাক লাগে শত বছরেরও অধিক সময় আগে তৎকালীন মুসলিম সমাজে অবরুদ্ধ পরিবেশের মাঝে থেকেও বেগম রোকেয়া এমন ভাবনা কিভাবে ভেবেছিলেন। এমন কথা কিভাবে বলেছিলেন। কারণ আমরা তো জানি রোকেয়ার মানস গঠনে তার পারিবারিক পরিবেশ সহায়ক ছিল না।বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অতি রক্ষণশীল ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জহির মোহাম্মাদ আবু আলী সাবের। তার দুই পুত্র আবুল আসাদ ইব্রাহীম সাবের ও খলিল সাবের। তিন কন্যা করিমুন্নেসা, রোকেয়া ও হোমায়রা। পরিবারে মেয়েদের জন্য ছিল কঠিন পর্দা প্রথা। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই বাইরের স্ত্রী লোকদের কাছ হতেও পর্দা করতে হতো।

পিতা ছিলেন স্ত্রী শিক্ষার ঘোর বিরোধী। ছেলেদের শিক্ষার বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। দুই পুত্র কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। বড় ভাই ইব্রাহীম সাবেরের তত্ত্বাবধানে বেগম রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজি শেখেন অতি সংগোপনে গভীর রাতে মোমের আলোতে। পরবর্তীতে ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের অবাঙালি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। এই বিয়ে পারিবারিক অবরুদ্ধ পরিবেশ থেকে রোকেয়াকে মুক্তি দেয়। মুক্ত পরিবেশে উদারচেতা স্বামীর সাহচর্যে রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা যেমন মিটতে থাকে তেমনি বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায়ও তিনি পারদর্শী হয়ে ওঠেন। স্বামীর জীবদ্দশায় একের পর এক মূল্যবান জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। রোকেয়া লিখেছিলেন দেশ ও মানবজাতির মঙ্গল সাধনের জন্য। রোকেয়ার সমস্ত রচনার পেছনে রয়েছে সমাজ সংস্কার বা সমাজ কল্যাণের নির্দেশ। 
নারী জাগরণ ও বাঙালি মুসলমানদের জাগরণ ছিল রোকেয়ার প্রধান লক্ষ্য। সমগ্র সমাজ সম্পর্কেই ছিল রোকেয়ার সমাজসচেতনতা। রোকেয়ার সামাজিক মানবিক দ্রোহের পেছনে ছিল তখনকার বাঙালি মুসলমান সমাজের বিশেষ অবস্থা এবং অবস্থান। অধঃপতিত বাঙালি মুসলিম সমাজ তখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দিক থেকে বঞ্চিত হয়ে রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে-অভিমানে-হতাশায় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। সমস্ত প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্ম থেকে বিরত থেকেছিল। আর এর প্রধান শিকার হয়েছিল নারী সমাজ। মুসলিম নারী সমাজ হয়েছিল অবরোধবাসিনী। তারা ছিল ঘোর অন্ধকারে। রোকেয়াই প্রথম ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নারী জাতির কথা ভাবেন এবং তাদের আলোর পথে ডাক দেন। মুক্তির বাণী শোনান। 
মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন রোকেয়া ছিলেন গোঁড়ামি হতে বহুদূরে। তার দৃষ্টি ছিল জীবন ও সমাজের সর্বস্তরে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় রচিত হয়েছে তার ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসটি। উপন্যাসে বর্ণিত ‘তারিনীভবনে’ আমরা দেখতে পাই হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সর্বধর্মের নির্যাতিতা নারীর একত্রবাস। রোকেয়া শুধু ভারতবাসীর অভাব আর সমস্যার কথা তুলে ধরেননি, তার সমাধানের সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিতও দিয়েছেন। রোকেয়ার সামাজিক চিন্তা সব সময়ই সামাজিক কর্মে উদ্বোধিত। 
বুদ্ধিজীবী, লেখিকা, সমাজকর্মী এই তিন রূপেই তার বিকাশ। লেখিকা হিসেবে প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রম্যরচনার মধ্য দিয়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন। লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন নারী জাগরণের কথা, সমাজ উন্নয়নের কথা, অবরোধবাসিনীদের দুঃখময়-গ্লানিময় জীবনযাত্রার কথা, বাঙালি মুসলমানের জাগরণের কথা। লক্ষণীয় এই বিষয়গুলো একে অপরের পরিপূরক। রোকেয়ার চিন্তার কেন্দ্র নিঃসন্দেহে  নারী মুক্তি, নারী জাগরণ, নারীর মানবাধিকার ও নারীর পুরুষতুল্য প্রতিষ্ঠা। 
উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম পাদে যে সমস্ত লেখিকা সাহিত্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছেনরোকেয়া তা থেকে ভিন্নতর। রোকেয়ার মতো চিন্তাশীল গদ্য লেখিকা তখন বা এখন আর নেই বললেই চলে। সুদীর্ঘকালব্যাপী সমাজে প্রচলিত নারীর প্রতি অবমাননাকর যে সমস্ত নেতিবাচক কুসংস্কার প্রোথিত রয়েছে তার মূলোৎপাটনে তিনি যেমন সচেতনভাবে কলম ধরেছিলেন, তেমনি নারী শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে আজীবন প্রধান শিক্ষয়িত্রীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সমস্ত সংগ্রামশীলতার পরে রোকেয়াকে শেষ বয়সে আক্রমণ করে এক তীব্র নিঃসঙ্গ, একাকিত্ব ও ব্যর্থতাবোধ।

বৈধব্য, দুই কন্যা সন্তানের অকাল মৃত্যু, সমাজের বিরামহীন কটূক্তি, স্কুল বিষয়ে সহযোগিতার অভাব- এসবই তাকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল। পরিত্রাণ পাবার জন্য তিনি বিধাতার কাছে মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেছিলেন। রোকেয়ার  প্রার্থনা যেন আল্লাহ মঞ্জুর করেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে ১৯৩২ সালে ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মাত্র ৫৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও রাত এগারোটা পর্যন্ত স্কুলের কাজ করে গেছেন। সেইসঙ্গে বাঙালি মুসলিম নারী সমাজকে চিরঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। 
নারী জাগরণের পথিকৃৎ এই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তার আরব্ধ কাজ, মত, পথ, ভাবনা ও আদর্শ। তারই আদর্শায়িত পথ ধরে বাঙালি মুসলিম নারী সমাজ আজ অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে। পথ পরিক্রমায় নারী আজ বহু প্রতিকূলতাকে জয় করে শিক্ষায়-দীক্ষায়, চিন্তা-চেতনায়, কর্মে-স্বাবলম্বনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একুশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সহঅবস্থান, সমমর্যাদা, সমঅধিকার- ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নারীকণ্ঠ আজ বিশ্বব্যাপী সোচ্চার।

দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রোকেয়া ধর্মান্ধদের নিয়ে যে ভাবনা ভেবেছিলেন শতবর্ষ পরেও সেই একই ভাবনায় নারী জাতিকে বিচলিত হতে হচ্ছে। তাই বলছিলাম, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিল করে নারীকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। নারীর এই চলার পথে  রোকেয়া আজও আলোকবর্তিকা হয়ে পথ প্রদর্শকের কাজ করে যাবেন। রোকেয়ার তাই মুত্যু নাই, লয় নাই, ক্ষয় নাই। তিনি অজর, অমর, চিরঞ্জীব। তার পুণ্যস্মৃতির প্রতি জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা। 
লেখক : অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, চেয়ারম্যান -ট্রাস্টিবোর্ড , নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী 

×