ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ওয়ালিউর রহমান-বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কূটনীতিক

সীমা আক্তার

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩

ওয়ালিউর রহমান-বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কূটনীতিক

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর  রহমান  ঝিনাইদহ

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর  রহমান  ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপার কাঁচেরকোল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কর্মজীবনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাষ্ট্রদূত, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জেনেভা, বার্ন, নিউইয়র্ক, জাকার্তা, রোম, জেদ্দা এবং তিউনিসিয়ায় একজন কূটনীতিক হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সাল থেকে মৃত্যু অবধি তিনি তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। একাধারে তিনি ছিলেন একজন লেখক ও গবেষক। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শহর প্রিটোরিয়ার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে বাংলাদেশের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আমন্ত্রণ জানাতে দেখা করেন।
১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে মুজিবনগর সরকারে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ ও নেতৃত্বে ওয়ালিউর রহমান বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্যপদ অর্জন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ’৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর তিনি জিয়াউর রহমানের রোষানলে পড়েন এবং একপর্যায়ে তাকে ওএসডি করা হয়। প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়, তিনি বঙ্গবন্ধু নৃশংস হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ এবং ১৭ তারিখে বিলিয়ায় দুটি সেমিনারের আয়োজন করেন।

‘জেনারেলদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক হত্যাকা-’ শীর্ষক  ওই সেমিনারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। তিনি তখন বিলিয়ার আজীবন সদস্য। তখন বিলিয়ার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দিন আহমেদ। তাকে নিয়েই তিনি সেমিনারের আয়োজন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম ওএসডি হয়েছিলেন কূটনীতিবিদ হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী। দ্বিতীয় ওএসডি করা হয়েছিল ওয়ালিউর রহমানকে। সামরিক স্বৈরাচারী শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে ওএসডি করেছিলেন এবং পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে  মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অন্যায়, অনৈতিক এবং ব্যক্তি হিংসা চরিতার্থে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। এরপর তিনি আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফেরত পান।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই পাকিস্তানপন্থি সামরিক শাসকশ্রেণির দ্বারা নানাভাবে তাকে বিব্রত করা হয়েছিল। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানকে তার ধানম-ির ৫ নম্বর  বাসায় পাঠাতেন এই মামলার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। খালেদা জিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আমিনুল হক ওয়ালিউর রহমানের সঙ্গে এই অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে যোগ দেন। পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে যোগ দিতে তাকে লাহোরে যেতে হয় ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৮ সালে তার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল দিল্লি, পরে সিদ্ধান্ত হয় কলকাতা, অবশেষে পাঠানো হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ায়। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ধারক অভিযোগ তুলে তাকে ভারতে পাঠায়নি পাকিস্তান সরকার।
জাকার্তা গিয়ে তিনি সেখানে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও এসএএমএস কিবরিয়াকে পেয়েছিলেন। দুজনই তার জীবনে বড় রেখাপাত করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়া বসেই তিনি শুনতে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেছে পাকিস্তান সরকার। পরে জেনেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ, বঙ্গবন্ধু তখন রাওয়ালপিন্ডির কনফারেন্সে যাবেন বিষয়টি পাকিস্তান সরকার মাথায় রেখেছিল। জাকার্তা বসেই ওয়ালিউর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা কতটা বর্বর এবং তারা কিভাবে বাঙালি জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। ১৯৬৮ সালেই ইন্দোনেশিয়া থেকে তাকে ট্রান্সফার করা হয় সুইজারল্যান্ডে।

তাকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হলো জাকার্তায়। ফেয়ারওয়েলে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। ওয়ালিউর রহমান সুইজারল্যান্ডে গিয়ে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পেয়েছিলেন পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত আফজাল ইকবালকে।
এ সময় আইয়ুব খানের স্থলাভিশিক্ত হয়েছেন ইয়াহিয়া খান। ঢাকায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল টিক্কা খানকে। ইতোমধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করেছেন দুই বছর আগে। বাঙালি সমাজ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ধীরে ধীরেÑ সেটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তখনই। ১৯৬৯ সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকার সম্পর্কে ধারণা ছিল স্পষ্ট। এদিকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা তারা সুইজারল্যান্ডে বসেই জানতে পেরেছিলেন।
১৯৭১ সালের আগস্টের ২১ ও ২২ তারিখে জেনেভায় পাকিস্তান ইনভয়েস কনফারেন্সে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে রাষ্ট্রদূতরা সমবেত হয়েছিলেন। ওয়ালিউর রহমান কনফারেন্সে যোগদান করেন এবং কনফারেন্সের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, গোপনীয় বার্তা খুব দ্রুত মুজিবনগর সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই কনফারেন্সের পর মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে তিনি পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসের চাকরি থেকে নভেম্বরের ২ তারিখে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের দিন ২ নভেম্বর হোটেল ইবষষবাঁব চধষধপব–এ ইউরোপের প্রায় ১০০ সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। হোটেলে ইউরোপের প্রায় সকল সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল পরের দিন। যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস তিনি জেনেভায় পলিটিক্যাল রিফিউজি ছিলেন। বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরির প্রচেষ্টায় ছিলেন।

মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। তখন আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিম-লে কূটনীতিকদের একযোগে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং সেসব দেশের প্রশাসনের ওপর বিরাট চাপও সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, তাদের এ প্রয়াস যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে। সে সময় মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে  ওয়ালিউর রহমান ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুইস রেডক্রস, ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল। এর নেপথ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি ছিলেন ৭নং হেলভেশিয়া প্লাসে। সুইস পার্লামেন্টের সামনে হাজার হাজার সুইস নাগরিক সমবেত হয়ে একটি সমাবেশ করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। সমাবেশটি চিলড্র্রেন অব সুইজারল্যান্ড নামে খ্যাত। সেখানে তারা ৪০ হাজার ফ্রাঙ্ক ফান্ড তুলে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল। ওয়ালিউর রহমান সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন। আর ১৯৭২ সালের ২১ আগস্টে এখানেই বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন দীর্ঘ ২৪ দিনের জন্য গোটা পরিবারসহ। বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে অস্ত্রোপচারের পর আরোগ্য লাভের জন্য এসেছিলেন সুইজারল্যান্ডে। ওয়ালিউর রহমান তখন সুইজারল্যান্ডের হেড অব মিশন। তিনি তাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন।

জেনেভায় লারিজার্ভ হোটেলে বঙ্গবন্ধু ২৪ দিন ছিলেন পরিবারসহ। এরপর ১৯৭৩ সালের ১০ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আবার জেনেভায় আসেন  বাংলাদেশ ইনভয়েস কনফারেন্স করতে। ওই সময়গুলোতে ওয়ালিউর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। পাকিস্তানের কারাগার, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয়ে।
ওয়ালিউর রহমান ‘বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধ আদালত আইন-১৯৭৩’-এর মূল কারিগর ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক  আদিষ্ট হয়ে জেনেভায় কর্মরত অবস্থায় ১৯৭২ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট,’ ১৯৭৩ এর ড্রাফ তৈরি করেন। তিনি জেনেভায়, ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব ক্রিমিন্যাল ল’, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর Professor Jescheck, Professor Otto Von Triffterer., Ges Professor NialMcDermot (Head of the International Commission of Jurists (ICJ)) এর সঙ্গে দেখা করেন এবং ড্রাফ্ট তৈরি করতে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন। ট্রাইব্যুনালের  বিচারকগণ ও প্রসিকিউটররা ওয়ালিউর রহমানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। Forgotten War: Forgotten Genocide বইটি লিখেছেন তিনি এই ট্রেনিং-এর জন্য। ট্রাইব্যুনালের আইনের ওপর লিখেছেন, Brief History of the Framing of the International Crimes (Tribunals) Act, ১৯৭৩. তিনি বেশ কিছু গ্রন্থের রচয়িতা। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১টি । সর্বশেষ গ্রন্থ Pakistan on the Brink: A Civili“ational Quest তার মৃত্যুতে দেশ একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও গবেষককে হারিয়েছে।

লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড কাউন্টার-টেররিজম

×