
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৪০ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৪০ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। সংস্থাটির মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট। এই সংঘাতপূর্ণ সংকটের মধ্যে গত ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ইসরাইলে হামাসের অতর্কিত নজিরবিহীন হামলার পর প্রতিশোধ নিতে ওইদিন থেকেই গাজায় তীব্র বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। সেইসঙ্গে গাজায় পানি, খাবার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহও বন্ধ করে দিয়েছে তারা।
ফলে সেখানকার ফিলিস্তিনিরা তীব্র মানবিক সংকটে পড়েছে। জল, স্থল ও আকাশপথে গাজায় নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। হামলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। বলা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকাটির বাসিন্দারা এর আগে কখনো এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখেননি। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় জাতিসংঘের ৪৮টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে যে, গাজার ১৫ লাখ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই তাদের স্থাপনায় আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ইতোমধ্যে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ অবস্থান নিয়েছে।
পরিস্থিতি এমন যে, নতুন করে আর কাউকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় এসব স্থাপনার কাছাকাছি রাস্তাতেই বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ ঠাঁই নিয়েছে। অল্প জায়গায় এত মানুষ গাদাগাদি করে থাকায় গুরুতর স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে এবং সবাইকে সেবা দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৪০ লাখ। ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি সঠিকভাবে লক্ষ্য করেন যে, এটি বর্তমান বিশ্বের গুরুতর সংকটের একটি। এছাড়া মিয়ানমার থেকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে কয়েক বছর ধরে অবস্থান করছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী।
শান্তি ও নিরাপত্তা যখন বিঘিœত হয় তখন মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় অথবা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটে। নৃশংস যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা সংঘাতই এ বাস্তুচ্যুতির মূল কারণ। গত কয়েক সপ্তাহের সহিংসতা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুদ্ধের মৌলিক নিয়ম যেমনÑ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন উপেক্ষা করা ক্রমবর্ধমানভাবে আদর্শ হয়ে উঠেছে। এছাড়া ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামাসের হামলা এবং ইসরাইলি সামরিক অভিযানে নিহত নিরপরাধ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের সংখ্যা নজিরবিহীন। গাজা উপত্যকার অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও আলোচনার কমতি নেই।
এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের নেতৃত্বে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের দুর্দশা কমাতে সক্ষম এমন কোনো বাস্তবসম্মত ও টেকসই পদক্ষেপ নেই। ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনির মন্তব্যের দিকেও মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়, যিনি বিদ্যমান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে পৃথিবীতে নরক বলে অভিহিত করেছেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এ সভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তা হচ্ছে- মানবিক যুদ্ধবিরতি এবং গাজার অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তার উল্লেখযোগ্য সরবরাহ, যা ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং প্রাণহানির চলমান চক্র হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইউএনএইচসিআরে জাতিসংঘ মহাসচিবের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এতে আরও বলা হয় যে, চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এ শোচনীয় যুদ্ধ পরিস্থিতির পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। জাতিসংঘের হাই কমিশনার সুদানে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে এক সময় শান্তিপূর্ণ অনেক মানববসতি ছিল। তবে এখন দেশটিসহ তার আশপাশের অঞ্চলগুলো কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।
এ চলমান সংঘাত সুদানের জনগণের জন্য মর্মান্তিক পরিণতি বলে মনে করেন তিনি। বলাবাহুল্য, চলমান লড়াই কিংবা সহিংসতার পরিধি ও নৃশংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি সাধারণ মানুষকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। দেশটির প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। এর মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ নিকটবর্তী দেশগুলোয় পালিয়ে গেছে। কেউ কেউ এরই মধ্যে লিবিয়া ও তিউনেসিয়ায় প্রবেশ করেছে। অনেকে আবার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিসহ ইউরোপের অন্য দেশগুলোর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পরে শিগগিরই যুদ্ধবিরতি বা সংঘাত পরিস্থিতির সুরাহা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন জাতিসংঘের এই হাই কমিশনার।
এরপর লেবাননের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়। দেশটি অর্থনৈতিক পতন এবং সীমান্তে দুটি চলমান সংঘাতের মুখোমুখি। সেন্ট্রাল সাহেল এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার কথাও উঠে আসে আলোচনায়। বছরের পর বছর ধরে অঞ্চলগুলোয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ বেসামরিক নাগরিকদের আতঙ্কিত করে রাখা নৃশংসতা পুনরায় ফিরে আসছে, যার ফলে আরও বেশি মানুষ আফ্রিকার উপকূলীয় রাজ্যগুলোয় আশ্রয় নিচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশগুলোর সমস্যা আরও ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।
তাছাড়া জলবায়ু জরুরি অবস্থাসহ প্রয়োজনীয় তহবিল ঘাটতির কারণে এরই মধ্যে অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে তারা। এছাড়া মধ্য আমেরিকা, আর্মেনিয়া, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও ইউক্রেনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি বেসামরিক নাগরিকদের অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে এবং তাদের মধ্যে হতাশা দানা বাঁধছে বলে উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘের কাছ থেকে বিশ্বের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর, যা সনদের মাধ্যমে কাউন্সিলের ওপর অর্পিত আছে। দুর্ভাগ্যবশত সদস্য দেশগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিভাজনের কারণে এ কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর প্রায়ই শোনা যায় না। বিষয়টাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন ইউএন হাই কমিশনার। বিশেষত শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ভিকটিমদের পুনর্বাসন করতে রাজনৈতিক মূলধন ও তহবিলের ঘাটতি যখন বড় বাধা হিসেবে দাঁড়ায়। মানবিক কাজ করার জন্য তহবিল, জনশক্তি এবং উপকরণের প্রয়োজন হয়। আপাত দৃষ্টিতে ইউএনএইচসিআরের জরুরিভিত্তিতে এ বছর শেষ হওয়ার আগেই ৬০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
তহবিল সীমিত এবং আগামী বছরের জন্য সম্ভাবনা আরও হতাশাজনক। বড় দাতারা সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং অন্য যারা সহায়তা সরবরাহ করতে পারেন তারা বহুপক্ষীয় প্রচেষ্টায় অংশ নিচ্ছেন না। এখানে উল্লেখ্য, বিশ্লেষকরা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছেন যে, ইউএনআরডব্লিউএ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইউনিসেফ ও রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি দীর্ঘস্থায়ীভাবে স্বল্প অর্থায়নে রয়েছে। এসব সংস্থা আর্থিক সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে, যার দরুন মানবিক কার্যক্রমে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে তারা। এ মন্তব্যগুলো জাতিসংঘকে তার বর্তমান সমস্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে ইউএনএইচসিআরের সাহসী ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘের ইতিবাচক, নেতিবাচক মুহূর্ত, অনুপ্রেরণামূলক ও হতাশাজনক পরিস্থিতি, স্পষ্ট সংকল্পের সময়কালের পাশাপাশি বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার সময়সহ বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখযোগ্য। জাতিসংঘের অবদান লাখ লাখ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে ঠিকই, কিন্তু জাতিসংঘ বছরের পর বছর ধরে সংঘাত, মানবিক সংকট ও দারিদ্র্যসহ নানা সংকটেরও মুখোমুখি হয়েছে। দৃঢ়সংকল্প এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামোর প্রধান ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করেছে।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের ২৬ অক্টোবরের সম্পাদকীয় বিভাগে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের এক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে জাতিসংঘের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায়। কারণ এতে উল্লেখ ছিল জাতিসংঘ তার ৭৮তম জন্মদিন পালন করেছে, কিন্তু উদ্যাপনের তেমন কোনো কারণ ছিল না। অধিবেশনে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি অসম্মানজনক ও অকূটনৈতিক মনোভাব প্রদর্শনের জন্য জাতিসংঘে ইসরাইলি প্রতিনিধির সমালোচনা করা হয়। ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত যেভাবে মহাসচিবকে সম্বোধন করেছেন এটাকে অকল্পনীয় এবং পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য বলেও অভিহিত করা হয়।
এ মুহূর্তে বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে জাতিসংঘের কার্যকারিতা সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক পুনর্বিবেচনা করা অপরিহার্য। পরিস্থিতি বিবেচনায় বৈশ্বিক জটিলতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অত্যধিক রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর জন্য সনদ পরিবর্তন করা উচিত কি-না তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।
প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে সনদের শব্দগুলো কঠোরভাবে মেনে চলা সপরাজিত হওয়া এবং দায়-দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। জাতিসংঘকে আরও ভালোভাবে কাজ করতে সহায়তা করতে ভেটো বিলুপ্তির কথা প্রাধান্য পায়। কারণ ভেটো শুধু নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তকেই প্রভাবিত করে না, জাতিসংঘের সব কাজকেও প্রভাবিত করে, যার মধ্যে রয়েছে মহাসচিবের পদে কে বসবে সেই বিষয়টিও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক কৌশলগত বিশ্লেষক বেশ কিছুদিন ধরে একই রকম মন্তব্য করে আসছেন। ভেটো অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক এবং জাতিসংঘের সার্বভৌম সমতার নীতির প্রকৃত চেতনার পরিপন্থি।
সবার পর্যবেক্ষণে বারবার উচ্চারিত হয়েছে যে, ভেটো ক্ষমতার একটি নেতিবাচক দিক এবং এটি বিলুপ্ত করা উচিত। দীর্ঘদিন ধরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোগত দিকগুলোর সংস্কার হওয়া উচিত বলে দাবি করে আসছেন অনেকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি উপলব্ধি করে যে, তারা একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং বহুপক্ষীয়তাকে সমর্থন করার জন্য অবশ্যই সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। এতে প্রত্যেকেই পরামর্শ ও পর্যবেক্ষণ থেকে উপকৃত হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ অনেকেই বলেছেন, যুদ্ধ এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই সংঘাতের অবসান না হলে দুই দিকের আরও অনেক প্রজন্ম যুদ্ধের মুখোমুখি হবে এমন আশঙ্কাই থেকে যায় বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক