ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

কাগজ ও কালিবিহীন থ্রিডি প্রিন্টিং

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২১:০৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩

কাগজ ও কালিবিহীন থ্রিডি প্রিন্টিং

ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ বা থ্রিডি প্রিন্টিং তথ্যপ্রযুক্তির জগতে অবিশ্বাস্য এক আবিষ্কার

ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ বা থ্রিডি প্রিন্টিং তথ্যপ্রযুক্তির জগতে অবিশ্বাস্য এক আবিষ্কার। বই, পোস্টার, সিনেমা কিংবা ডিজিটাল মনিটর বা মুভিতে আমরা যেসব ছবি কিংবা গতিশীল দৃশ্য দেখতে পাই, সেগুলো প্রিন্ট করলে যে আউটপুট পাই তা দ্বিমাত্রিক প্রিন্ট। আবার বাস্তবে একটি ঘর বা দালান কিংবা গাছপালা ও নদী বেষ্টিত একটি গ্রাম দেখতে ত্রিমাত্রিক হলেও সাধারণ প্রিন্টারে প্রিন্ট করলে তা হয় দ্বিমাত্রিক। সাধারণ ছাপার যন্ত্রগুলো শুধু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ছাপতে পারে। অর্থাৎ, যন্ত্রগুলো টুডি প্রিন্টিং করে এবং কালি মূলত এক স্তরীয় ভাবেই কাগজ বা কাপড়ের ওপরে ফেলে। ফলে সেই কালির উচ্চতা হয় অতি নগণ্য।

এখন যদি কোনো প্রিন্টার বারবার, বহুস্তরীয় ভাবে ‘কালি’ ফেলতে থাকে তবে দেখা যাবে ছাপাটি অর্থাৎ, মুদ্রণটির উচ্চতাও তুলনামূলকভাবে (মুদ্রণটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের তুলনায়) বেড়েছে এবং মুদ্রণটি একটি থ্রিডি মুদ্রণে পরিণত হয়েছে। এভাবে যে সব প্রিন্টার এরকম ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ করতে সক্ষম সেগুলোকে থ্রিডি/ত্রিমাত্রিক মুদ্রক বলা হয়। কিভাবে সেটা সম্ভব– সেটাই এখন আলোচনা করা যাক। সাধারণ প্রিন্টারের কালি সাধারণত তরল (ইঙ্কজেটের জন্য) কিংবা পাউডারের মতো (লেজার প্রিন্টের জন্য) হয়ে থাকে। এ ধরনের কালির ড্রাম বা টোনারের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এখন ধরুন আপনার একটি ১০ তলা বিল্ডিংয়ের দ্বিমাত্রিক প্ল্যান আছে, যা একটি কাগজের ওপর অঙ্কন করা হয়েছে কাঠপেন্সিল কিংবা রঙিন কলম দিয়ে। এক্ষেত্রে কাঠপেন্সিল কিংবা রঙিন কলমের কালিকে কম্পিউটারের ইঙ্কজেট বা লেজার কালির পাউডারের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের কালি কেমন, তা এবার আলোচনা করা যাক। আমরা দেখি যে, ওই দ্বিমাত্রিক প্ল্যানটি হাতে নিয়েই ইঞ্জিনিয়ার এবং রাজমিস্ত্রি রড-সিমেন্ট, ইট-বালু, কংক্রিট ইত্যাদির সমন্বয়ে পিলার, বারান্দা, ছাদ এবং ক্রমান্বয়ে একতলা, দুইতলা, তিনতলা ইত্যাদি করে থাকেন। এক্ষেত্রে রড-সিমেন্ট, ইট-বালু, কংক্রিট ইত্যাদির সংমিশ্রণটিকে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের কালির সঙ্গে তুলনা করা যায়। এসবের সংমিশ্রণের ফলে যেভাবে অট্টালিকাটি হলো তাই থ্রিডি প্রিন্টিং।

পার্থক্য হলো দ্বিমাত্রিক প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে তরল ইঙ্ক বা লেজার জেটের পাউডারের পরিবর্তে এখানে (থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে) অন্য এমন এক ধরনের কালি সমৃদ্ধ ঘনবস্তু প্রিন্টার থেকে বের হয়, যা দিয়ে একটি বাস্তবভিত্তিক দৃশ্যমান থ্রিডি বস্তু তৈরি হয়। এই প্রযুক্তিতে প্রথমে কম্পিউটার সহায়ক সফটওয়্যার ‘কম্পিউটার এডেড ডিজাইন (ঈঅউ)’ এর সাহায্যে কাক্সিক্ষত বস্তুর স্ক্যান করত সেটাকে থ্রিডি মডেলিং প্রোগ্রামে পাঠিয়ে ডিজিটাল ফাইলে কনভার্ট করা হয়। অতঃপর মডেলটি শত-হাজার আনুভূমিক লেয়ারে বিভক্ত হয়ে যায় এবং প্রিন্টার প্রত্যেকটি লেয়ারের ডিজাইন পড়তে ও নির্ভুলভাবে প্রিন্ট করতে পারে।

তবে প্রিন্ট করার সময় প্লাস্টিক ফিলামেন্ট মোটরের মাধ্যমে একটি সরু মুখ (নজেল) দিয়ে আঠালো ঘনবস্তুর সাহায্যে লেয়ারগুলোকে জোড়া লাগিয়ে দেয়। সাধারণত কাগজ, কাঠের গুঁড়া, কেমিক্যাল জাতীয় ধাতব বস্তু/প্লাস্টিক ইত্যাদির মিশ্রণ অত্যন্ত শক্তিশালী তাপমাত্রার মাধ্যমে গলিয়ে এই আঠালো ঘনবস্তু তৈরি করা হয়। যা মডেলটি বা বাড়িটির নকশা অনুযায়ী আড়াআড়ি, উল্লম্ব, রৈখিক ইত্যাদি একের পর এক স্তর তৈরির সংযুক্তির মধ্য দিয়ে সত্যিকারের একটি কাঠামো গঠন করে। 
উল্লেখ্য, CAD এক ধরনের গ্রাফিক্স সফ্টওয়্যার, যা বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প, শিল্পের যন্ত্রাংশ, যানবাহন, সুউচ্চ ভবন ইত্যাদির আর্কিটেকচারাল ডিজাইন বা নকশা তৈরিতে সহায়ক। থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে কালি হিসেবে (আঠালো ঘনবস্তু) প্লাস্টিক (PLA, ABS, PETG, Nylon-based), ধাতু বা ধাতুসঙ্কর ব্যবহার করা হয়। যদিও এই টেকনোলজি ক্রমবিকাশের প্রথম পর্যায়ে শুধু প্লাস্টিক ব্যবহার করা হতো পিএলএ (চখঅ) মানে পলিল্যাকটিক অ্যাসিড, এটি থার্মোপ্লাস্টিক মনোমার যা পুনর্বিকীরণযোগ্য জৈব উৎস যেমন– কর্ন স্টার্চ বা আখ থেকে প্রাপ্ত বস্তু। এবিএস (অইঝ) হলো এন্টিলক ব্রেকিং সিস্টেম– যা সহজে কন্ট্রোল করা যায়।

আর PETG (পলিথিলেন টেরেপেথালেট গ্লাইকল) একটি বহুমুখী উপাদান, যা শক্তিকে একত্রিত করে টেকসই ও স্থায়িত্বের কাজে বিভিন্ন শিল্পে থ্রিডি প্রিন্টিং, প্যাকেজিং এবং উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের একটা অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই ছিল ধাতু বা ধাতুসঙ্কর দিয়ে মুদ্রণ করা, যাতে প্রিন্টগুলো যন্ত্রাংশরূপে শিল্পে ব্যবহার করা যায়। এ ধরনের প্রিন্টারগুলোকে এফডিএম (Fused Deposition Modeling) থ্রিডি প্রিন্টার বলা হয়, যা অতিবেগুনি রশ্মি ও সংবেদনশীল রেসিন দিয়ে প্রিন্ট করার জন্য স্টেরিওলিথোগ্রাফি টেকনোলজি প্রবর্তন হয়।

বর্তমানে থ্রিডি প্রিন্টিং খুব জনপ্রিয় এবং এর বহুবিধ ব্যবহার আছে। বাজারে শিশুদের যেসব খেলনা পাওয়া যায়, এগুলো সবই থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের কাজ। নাইকি বা এডিডাসের মতো ব্র্যান্ড অবিশ্বাস্য দ্রুততায় থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যবহার করে খুব অল্প সময়ে জুতা বাজারজাত করছে। গাড়ির রিপ্লেসের যন্ত্রাংশ তৈরিতে থ্রিডি প্রিন্টিং এখন খুব নির্ভরযোগ্য ভরসা। খরচ কম এবং ফ্লেক্সিবল হওয়ায় স্থপতিরা এখন থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের বাড়ির দিকে ঝুঁকছেন-  বিশ্বের অনেক দেশেই বাসায় এবং রেস্টুরেন্ট থ্রিডি প্রিন্টিং দিয়ে খাবার পরিবেশন, বিউটি পার্লারে মেকআপ, দর্জির দোকানে জামা-কাপড় তৈরি করা হবে।

এমনকি কৃত্রিম হাত-পা, ত্বক, হাড়, কান, কিডনি, হাড়ের অংশ, দাঁত, কোমর ও হাঁটুর জয়েন্ট, মাংসপেশির টিস্যু, খেলাধুলার সরঞ্জাম, শিল্প কারখানা ও রকেটের যন্ত্রাংশ, অতিসূক্ষ্ম ও উন্নত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে এখন ল্যাবরেটরিতে। বায়োটেক খাদ্যের উত্তরোত্তর গবেষণায় এখন ঘরেই তৈরি করা যাবে প্রাণীর মাংস। সম্প্রতি কেএফসি তাদের বিখ্যাত খাবার চিকেন নাগেট কৃত্রিমভাবে তৈরির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ল্যাবে তৈরিকৃত এসব খাবার মানে-গুণে পুষ্টি সমৃদ্ধ এবং তেল ও চর্বি কমিয়ে এর গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ানো যায়। এভাবে ভবিষ্যতের প্রতিটি ক্ষেত্রে থ্রিডি প্রিন্টিং আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ, সুন্দর ও সতেজ করে দেবে। পাল্টে দেবে জীবন ধারণের স্টাইল।
হয়তো খুব শীঘ্রই থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের টুলস গণমানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে। ফলে মেডিকেল সাইন্সে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। তবে অসুবিধাও কম নয়। জীবন দান করে কিডনি থেকে জীবন কেড়ে নেওয়া বন্দুক, কৃত্রিম হাত-পা, অলংকার, গাড়ি-বাড়ি সবই তৈরি হচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে। এটিএম কার্ড তৈরি করে টাকা পয়সা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক করতে পারে সহজেই। আবার প্রিন্ট করা প্লাস্টিকের বন্দুক অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, যা মেটালডিটেক্টরে ধরাও পড়বে না। আছে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার হুমকি। কারণ, ব্যবহার বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ খরচ আর প্লাস্টিক বর্জ্য অনেক পরিমাণে বেড়ে যাবে।

তাই ভবিষ্যতে যাতে এই থ্রিডি প্রিন্টিং মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার হয়, সেজন্য এর প্রাথমিক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, স্কুলের পাঠসূচিতেও থ্রিডি প্রিন্টিং থাকা উচিত। মানব কল্যাণের জন্য আবিষ্কৃত কাগজ ও কালি ছাড়া থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের আবিষ্কারক চার্লস হাল একজন মার্কিন প্রকৌশলী। এই কাজে তিনি গবেষণা শুরু করেন ১৯৮৩ সালে এবং সফল হন ১৯৮৬ সালে স্টেরিওলিথোগ্রাফি (এসএলএ) নামে একটি প্রোটোটাইপ তৈরির মাধ্যমে। আলট্রাভায়োলেট লাইট ব্যবহার করে তরল থেকে কঠিনে বিকশিত হওয়ার জন্য তিনি ফটোপলিমার ব্যবহার করেন, যা এক্রাইলিকভিত্তিক উপকরণ হিসেবেও পরিচিত। তার সেই এসএলএ পেটেন্ট-ই আজ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা অনুসরণ করে চলেছে থ্রিডি প্রিন্টিং হিসেবে। তাই চার্লস হালকে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের ‘জনক’ অভিহিত করা হয়।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

×