
সিডনির মেলব্যাগ
দেশে রাজনীতি নির্বাচন ভোট এসব নিয়ে যত হৈ চৈ বা মিডিয়ার সোরগোল, তার সিকিভাগও নেই প্রবাসে। মানুষ আনন্দে বাঁচার অবলম্বন হিসেবে শিল্প-সাহিত্য আর বিনোদনের দিকেই ঝুঁকে আছে। অবিচল স্বদেশপ্রেম আর শুভ ধারণা বা বোধই তার আসল শক্তি। সিডনি যেন ক্রমে তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে দাঁড়াতে চাইছে
সিডনি এখন বাংলা বাঙালির সাহিত্য শিল্প বিনোদনের এক বাতিঘর। ২৭ বছর আগে যখন এ দেশে আসি, তখন আর আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন আমরা যারা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বা তিরিশের তরুণ, তাদের কাঁধেই ছিল সব ভার। বয়সের নিয়মে আমরা এখন প্রৌঢ়। আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে আরও নবীন আরও তরুণরা। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে চলে গান বাজনার বড় আসর। চলছে সাহিত্য আড্ডা। এখন সেমিনার, জাতীয় অনুষ্ঠান বা মানসম্পন্ন আয়োজনও ব্যাপক।
দু’দুটো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের কথা না বললেই নয়। একটি গানের আসর। কিন্তু প্রথাগত কোনো গানের আসর বললে ভুল বলা হবে। মরমি সাধক হাছন রাজার নামে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে হাছন রাজা উৎসব। এমন আয়োজন যে শুদ্ধ ধারার সাতে প্রবাসের সংযোগ, তা বলার দরকার পড়ে না। সুলাইমান দেওয়ান ও শ্রাবন্তী কাজী প্রবাসের পরিচিত মুখ। যাদের অবদান আনুকূল্য সুবিদিত। তারা যখন আমন্ত্রণ জানালেন এবং অনুষ্ঠান বিষয়ে বললেন, সত্যি মুগ্ধ হয়েছি। তাদের শিল্পী নির্বাচনও চমৎকার। দেশের বিখ্যাত মরমি শিল্পী সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে দীপ্তি রাজবংশীর যুগল বা একসঙ্গে মঞ্চে গান গাওয়াটা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। প্রয়াত ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর দাদা ছিলেন দেশনন্দিত গায়ক।
তিনি যখনই সিডনি আসতেন, আমাদের সঙ্গে দেখা হতো। আমরা একসঙ্গে গান বাজনার আসরসহ আড্ডা দিতাম। এমন সরল-সহজ অথচ অসাধারণ গায়ক এখন বিরল। সে সূত্রে দীপ্তি রাজবংশীকেও চিনি। তার গান শুনেছি। একবার ঘরোয়া আয়োজনে লালন সাঁইজীর গান শুনে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলাম। বাঙালি নারী সংসার সামলাতে গিয়ে স্বামীর ক্যারিয়ার বড় করার তাগিদে গান থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখলেও তার কণ্ঠ অসাধারণ। এই অনুষ্ঠানে সিডনির দর্শকশ্রোতা এমন একজনকে খুঁজে পাবে যার মধ্যে রয়েছে গানের মুক্তা।
যে বিষয়টি আজকের মূল বিষয় তার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য লেখক। তাকে সবাই চেনেন। চিনতে হয়। তিনি শুধু লেখক নন, একজন মনস্তত্ত্ববিদ। মনোরোগ চিকিৎসক। বিদুষী সুন্দরী এবং স্বাধীনচেতা। চুরাশি বসন্ত পার করেও যিনি সমান জনপ্রিয় আর স্বনামে উজ্জ্বল। স্বনামে কথাটা বলার কারণ আছে। তার স্বামী প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক। যাকে আমরা ডাকি সব্যসাচী। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য, গান, নাটক ও সিনেমা জগতে এমন প্রভাবশালী প্রতিভা হাতে গোনা। লেখার প্রভাব কাকে বলে ও কি ধরনের তার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন সৈয়দ হক। কবিতা থেকে নাটক বা সিনেমার গান কোথায় তিনি নেই! বাংলাদেশের নাটকের গুণগতমান আর মর্যাদার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তার লেখা যুদ্ধ এবং যুদ্ধ, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কিংবা নূরলদীনের সারাজীবন নামের নাটক। এমন মানুষের সঙ্গে ঘর-সংসার করে তার ছায়ায় থেকে লেখক হিসেবে বেরিয়ে আসা বা বড় হওয়া সহজ বিষয় নয়। তিনি তা পেরেছেন।
৬৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ শেষ বয়সের প্রান্তে এসে পেয়েছেন একুশে পদক। নানা অর্জনে স্ফীত তার ভা-ার। তিনি মাটির কাছাকাছি এক মানুষ। যে কারণে বলতে পারেন, ‘আমি ভাবিনি আমাকে নিয়ে তোমরা এমন আয়োজন করবে। তোমরা বাংলা, বাঙালিত্বকে প্রবাসের মাটিতে যেভাবে ধরে রেখেছো, দেখে এবং শুনে আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছি।’ প্রশান্তিকর আয়োজনে ‘দুর্জয় প্রাণের আনন্দে, আনোয়ারা সৈয়দ হক’ সন্ধ্যার আয়োজনের পরে মুগ্ধতা জানালেন এভাবেই বর্ষীয়ান কথাসাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক আনোয়ারা সৈয়দ হক। পুরো অনুষ্ঠানে বক্তারা এবং তিনি নিজে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তার জীবনযাপন ও শিল্পসাহিত্যের গল্প বললেন।
অনুষ্ঠানে সকলকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রশান্তিকা সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ। আনোয়ারা হক ও সৈয়দ শামসুল হকের লেখা থেকে পাঠ করেন শহিদুল আলম বাদল, অপু, ওমর আয়াজ অনি এবং নেহাল নেয়ামুল বারী। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন ড. মোহাম্মদ আলী, ডা. শাফিন রাশেদ, ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, কামাল পাশা, শফিকুল আলম। ৬০ এর দশকে লেখালেখি শুরু করেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। প্রথম বই বের হয় ৮২ সালে। এতদিন লেগেছিল কেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ঘরের সাথী স্বামী সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক ততদিনে ফুলটাইম লেখক হয়ে গিয়েছেন। খুশি মনেই তিনি সংসার, চিকিৎসা পেশায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তারপরও হাল ছাড়েননি।
লেখালেখির কারণেই ৬৯ বছর বয়সে জুটেছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কয়েক বছর আগে ২০১৯ সালে সরকার তাকে ভূষিত করে একুশে পদকে। পেয়েছেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার এবং অন্য আরও পুরস্কার।
এসব আমাদের অজানা নয়। যে কথা বলছিলাম বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে আমাদের সিডনিতে যে নীরব বিপ্লব বা চেতনার বহির্প্রকাশ, তা এখন চোখে পড়ার মতো। এখন আর কারও জন্য বসে থাকার দরকার পড়ে না। কে এলো কে গেল সেসব নিয়েও মাথা ঘামায় না কেউ। যে কোনো আয়োজনে যে মানুষ আসে এবং ভালোবেসে আসে, সেটাই এখন চোখে পড়ার মতো। প্রশান্তিকার বড় অর্জন তারা সিডনিবাসীর আস্থা ধরে রাখতে পারছে। অকৃতজ্ঞতা আমাদের বাঙালিদের স্বভাব। সে দৃষ্টিকোণে সাবধানতার বিকল্প দেখি না। প্রবাসের ছোট গণ্ডি ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে।
এর আগেও আমরা ভালো অনুষ্ঠান বড় আয়োজন এমনকি নান্দনিক সব সভা সমিতি দেখেছি। কালের গর্ভে তাদের বিলীন হওয়া দেখে জেনেছি, অহংকার, অতি বাড়াবাড়ি আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এসবকে ধারাবাহিক হতে দেয়নি। এক সময় থেমে গেছে। কিন্তু প্রশান্তিকা এখনো তাদের বিনয় আর বিশ্বাস অটুট রেখে চলেছে। মাঝেমধ্যে দু’একটা দমকা হাওয়ার ঝাপটা ব্যতীত তাদের পথচলা নিঃসন্দেহে স্বস্তির।
দেশে রাজনীতি নির্বাচন ভোট এসব নিয়ে যত হৈ চৈ বা মিডিয়ার সোরগোল, তার সিকিভাগও নেই প্রবাসে। মানুষ আনন্দে বাঁচার অবলম্বন হিসেবে শিল্প-সাহিত্য আর বিনোদনের দিকেই ঝুঁকে আছে। অবিচল স্বদেশপ্রেম আর শুভ ধারণা বা বোধই তার আসল শক্তি। সিডনি যেন ক্রমে তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে দাঁড়াতে চাইছে।
[email protected]