
পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশেরই স্বাধীনতা দিবস আছে
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করতে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং তা এখনও চলমান। এ অপশক্তিকে যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে। বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তির দিক থেকে যে অকল্পনীয় সফলতা অর্জন করেছে তা বিশ^বাসীর নিকট বিস্ময়
পৃথিবীর প্রায় সব স্বাধীন দেশেরই স্বাধীনতা দিবস আছে। বিজয় দিবস নামে বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত এবং বিপুল গৌরবমণ্ডিত দিন সকল জাতির ইতিহাসে নেই। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতা ঘোষণার পর সফলভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনও সব জাতিকে করতে হয়নি। বাঙালি জাতি সেই অনন্য সাধারণ কাজটি করতে পেরেছে বলেই তাদের নিকট বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা অপরিসীম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পৈশাচিক হত্যালীলায় মেতে ওঠে।
অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন আর নারী নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সমগ্র দেশে চরম অরাজকতা ও ত্রাস সৃষ্টি করে। দুঃসহ এ জীবন-মরণ সংকটের মুখে বাঙালিকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ঘুরে দাঁড়াতে হয়। সম্মুখ যুদ্ধের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি এবং মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য জীবনবাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। পাকিস্তানি শাসকদের নিকট থেকে তথা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য, জাতির অধিকার আদায়ের জন্য, সর্বোপরি একটি পতাকার জন্য এদেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করে ১৬ ডিসেম্বর কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।
সে রাষ্ট্রের মূল অঙ্গীকার- অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। নিরস্ত্র বাঙালির ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সাহসিকতা ও প্রবল দেশপ্রেমের নিকট আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের।
১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির কেবল আত্মত্যাগের ইতিহাসই নয়, তা অসাধারণ সাহস এবং বীরত্বেরও গৌরবগাথা। এ গৌরবের কথা জানাতে পারলে তরুণ প্রজন্মের মনে দেশের জন্য গভীর দেশপ্রেম, মমতা ও গর্ববোধ জাগ্রত হবে। দেশকে গড়ে তোলার মহান প্রেরণা হৃদয়ে জন্ম নেবে। এ দেশের সম্ভাবনাময় বিশাল তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে হবে, যেন তারা দেশকে ভালবাসে এবং দেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ব্রতী হয়। কিন্তু বিবিধ কারণে এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এ প্রজন্মের নিকট সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও ইচ্ছাকৃত এবং বিভিন্নভাবে বিকৃত করেছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠের ব্যবস্থাও রাখেনি। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের অগ্রযাত্রায়ও তারা ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানছে না, আবার অনেকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত ইতিহাস দ্বারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি নির্বাচনে বিজয় লাভের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে।
বাংলাদেশের বিজয়ের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরে, ইতিহাস বিকৃতি রোধ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কার্যক্রম শুরু করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে, জঙ্গি উত্থান প্রতিহত করে, সংবিধান সংশোধন করে, নতুন প্রজন্মকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে ইতিবাচক স্বপ্ন দেখতে শেখায়।
২০০৯ সাল থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে গণতান্ত্রিক চর্চায় বিশ^দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ, পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস সংযোজন, খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক মানোন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করা হয়েছে।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করতে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং তা এখনও চলমান। এ অপশক্তিকে যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে। বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তির দিক থেকে যে অকল্পনীয় সফলতা অর্জন করেছে, তা বিশ^বাসীর নিকট বিস্ময়। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হচ্ছে প্রেরণাময় চালিকাশক্তি। এ বিজয় আমাদের কাছে একইসঙ্গে প্রেরণা ও গৌরবের।
জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনগণকে দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। যে কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, সে দেশের জনগণের পথচলার ক্ষেত্রে পাথেয় হয়ে থাকে। জাতিকে সামনে এগিয়ে যেতে হলে এ ইতিহাস আঁকড়ে ধরেই ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করতে হয়। তাই নিজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চর্চা করা যে কোনো জাতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
একাত্তরে বাংলাদেশ যে কঠিন মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তার সোনালি ফসল আজ ঘরে তুলছে। একদিন সাম্রাজ্যবাদীরা যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিল, তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অপমান করেছিল; আজ তারাই বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখার জন্য স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশসমূহকে পরামর্শ দিচ্ছে। বাংলাদেশ আপন দক্ষতায় স্বনির্ভর উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় ভূষিত। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্যসাধাণ নেতৃত্বে বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ বদলে গেছে।
আজ বাংলাদেশ এক দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির রাষ্ট্র। অনুন্নত, দারিদ্র্যপীড়িত, অনাহারক্লিষ্ট একটা ভূখ- কী ভাবে সচ্ছল, সমৃদ্ধশালী, তথা উন্নয়নের আলোয় আলোকিত, প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগের আধুনিকতম সমাজে পরিণত হতে পারে, আজকের বাংলাদেশ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আদর্শকে সামনে নিয়ে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এটিকে পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় হিসেবে সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অব্যাহত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বিস্মিত করেছে। এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ সমাজে বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসছে।
বাঙালির প্রেরণার উৎস গৌরবময় এ বিজয় দিবস বর্তমানে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিম-লে এবং বাঙালির জীবন চেতনায় গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এ বিজয়ের অনুপ্রেরণা থেকে বাঙালির আজকের দীর্ঘ পথচলা, যাবতীয় অর্জন। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির ৫২ বছরের যে শক্তি, তা হলো আপামর বাঙালির দেশপ্রেমের শক্তি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে প্রেরণা তা হলো দেশপ্রেমের প্রেরণা। বাংলাদেশ পাওয়ার যে সংগ্রাম, তা হলো আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেতনা, সর্বোপরি সঠিক সময়ে যথাযথ নির্দেশনায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা।
তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস ও তথ্যপ্রবাহ জানা এবং অনুধাবন অতীব প্রয়োজনীয়। একাত্তরের বিজয়গাথা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে তাঁরই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে শীর্ষে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি জনগণের শক্তির ওপর ভরসা করে, লড়াই করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায় আত্মমর্যাদা ও গৌরবে বলীয়ান জাতি হিসেবে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেশের জনগণসহ বিশ^বাসী প্রত্যক্ষ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একইসঙ্গে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তাদের জ¦ালাওপোড়াও এবং সহিংসতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখবে- এটাও প্রত্যাশা করতেই পারি। বাংলাদেশ স্বমহিমায় এগিয়ে যাক তার স্বকীয়তা নিয়ে- মহান বিজয়ের মাসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। একইসঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এবং তার দলীয় প্রতীক নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করাই হোক বিজয়ের মাসে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়