বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ২০ দিনের মাথায় ৩১ জানুয়ারি সর্বপ্রথম যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন সেটি হলো বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন। লক্ষ্য ছিল অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার, সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা, পুনর্বাসন দ্রুততর করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা- যাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সামাজিক সূচকে আমাদের কেমন অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, বিশ্বমানের মানবসম্পদ কীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব তার সবই রয়েছে জাতির পিতার অর্থনৈতিক দর্শনে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি, সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে রেখে গেছেন অর্থনৈতিক দর্শন। রক্তে ভেজা সংবিধানেই স্থান দিয়েছেন দারিদ্র্য মুক্তির পথনির্দেশনা। বৈষম্য তাড়াতে ব্যক্ত করেছেন প্রতিশ্রুতি। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ছিলেন নির্ভীক। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-বঞ্চনা দেখে ১৯৪৭ সাল থেকেই স্বাধীনতার বীজ বুনেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার হয়ে দেশকে স্বাধীন করার পর জাতির পিতা একটি শোষণ, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল সাধারণ মানুষের মুক্তি। স্বাধীনতার পর চার বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই নবগঠিত দেশকে মর্যাদার আসনে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা এবং কাজের সূচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ভাষায়, সত্তরের দশকের সেই বিশ্ব বাস্তবতায় এই বাংলার একজন সমাজতন্ত্রী না হয়ে ‘একজন প্রয়োগবাদী সাহসী অভিভাবক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতার আজীবনের সাধনা, আত্মত্যাগের রাজনীতির উপজীব্য এবং মোটা দাগে অর্থনীতির দর্শন। তিনি কখনো ধনতান্ত্রিক অবাধ বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি অনেকটা বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি খাত থাকবে, কিন্তু একটি কাঠামোগত পরিম-ল সেখানে নিয়ামক ব্যবস্থা থাকবে।
তিনি মানুষে মানুষে, নারী-পুরুষে, ধনী-নির্ধনে, গ্রাম-শহরে বৈষম্য পরিহারের কথা বলেছিলেন। শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন। দরিদ্র মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ‘অপরিসীম ভালোবাসার’ কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের সহচর আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রত্যেক ভাষণে বলতেন, আমার গরিব-দুঃখী মানুষ। তারা যদি হাসিমুখে বাঁচতে না পারে, তা হলে আমার এই রাজনীতি করার কোনো অর্থ হয় না।’
১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় যে ১১ দফা দেওয়া হয়েছিল সেখানে ব্যাংক, বীমা, পাটশিল্প ও বস্ত্র খাত জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছিল। দরিদ্র মানুষকে তার ন্যায্য পাওনা দেওয়ার জন্যই বঙ্গবন্ধু এসব করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করার পর একটি সাম্যের অর্থনীতি করতে চেয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি কীভাবে চলবে তার একটি নীল নকশা করে গিয়েছিলেন। সেই নকশা অনুযায়ীই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু এমন একটি অর্থনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন যাতে শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মানুষের মঙ্গল সাধনে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো তৈরির জন্য বঙ্গবন্ধু প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন, যাতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল পরিধায় মানুষের কল্যাণ সাধন করা যায়। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহার, সেখানে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছিল, যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা যায়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উৎসাহিত করা যায় এবং জনকল্যাণের লক্ষ্যে সর্বজনীন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় ও উন্নয়নের ফল বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সমভাবে বণ্টিত হয়। বঙ্গবন্ধু সব সময় শ্রমজীবী, মেহনতী মানুষের কথা ভেবেছেন। কৃষিজীবীদের প্রতি তাঁর ছিল সুগভীর ভালোবাসা। তিনি সব সময় চাইতেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত এবং নিরক্ষরতামুক্ত রাষ্ট্র গঠনের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে।
বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮) ঘোষণা করেন। এতে ৪৪৫৫ কোটি টাকার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দুঃখজনক হলো বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর পরবর্তী শাসকরা ইচ্ছা করেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অপতৎপরতা দেখান। অথচ প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করা গেলে তা দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখিত ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শীর্ষক বইয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘অন্যায়কে তিনি কোনো দিনই প্রশ্রয় দিতেন না। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে তিনি কখনো পিছপা হননি।’ বস্তুত দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। অর্থনৈতিক দর্শনে তিনি মানুষের মঙ্গলের জন্য যাতে দুর্নীতিমুক্তভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়, সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটি বড় বাধা। আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান নানা ফ্রন্টে একাধিক কার্যক্রম গ্রহণ করেন, যাতে করে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাস করা যায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কাঠামোতে যে বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা হলো, সাধারণ জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বোচ্চ জনকল্যাণ নিশ্চিত করা। যা আজকের সময়ের প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ তাঁরই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে। এই মধ্যম আয়ের দেশের অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সামাজিক সূচকে আমাদের কেমন অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, বিশ্বমানের মানবসম্পদ কীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব তার সবই রয়েছে মানবতার মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক দর্শনে।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ২০ দিনের মাথায় ৩১ জানুয়ারি সর্বপ্রথম যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন সেটি হলো বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন। লক্ষ্য ছিল অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার, সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা, পুনর্বাসন দ্রুততর করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা- যাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সামাজিক সূচকে আমাদের কেমন অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, বিশ্বমানের মানবসম্পদ কীভাবে গড়ে তোলা সম্ভব তার সবই রয়েছে জাতির পিতার অর্থনৈতিক দর্শনে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দারিদ্র্য মুক্তির লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনা শুধু বাংলাদেশেই প্রাসঙ্গিক তা নয়, পিছিয়ে পড়া অন্য জাতি ও রাষ্ট্রের জন্যও হতে পারে পথনির্দেশিকা।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুগ্ম সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি [email protected]