ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

সিন্ডিকেট প্রতিরোধ জরুরি

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২১:০১, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সিন্ডিকেট প্রতিরোধ জরুরি

দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে সিন্ডিকেট, যাতায়াত ভাড়া নির্ধারণে সিন্ডিকেট

দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে সিন্ডিকেট, যাতায়াত ভাড়া নির্ধারণে সিন্ডিকেট, সরকারি কাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট, নিয়োগ বাণিজ্যে সিন্ডিকেট– এ সকল বিষয় শুনে বাংলাদেশের মানুষ অভ্যস্ত। একটা সময় পরোক্ষভাবে সিন্ডিকেটের আধিপত্য শোনা গেলেও বর্তমানে সিন্ডিকেটের ব্যাপকতা প্রবল ও জঘন্য। সিন্ডিকেট এই অর্থে বলা হয় যে, নির্দিষ্ট পণ্যের যোগান থাকা সত্ত্বেও পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এ যাত্রায় যারা প্রকৃত অর্থে উৎপাদনকারী, তারা কখনো পণ্যের প্রকৃত মূল্য পায় না।

বাজার যখন কেজি প্রতি কাঁচা মরিচের দাম হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়, দেখা যায় যারা কৃষক তারা কিন্তু উচ্চমূল্যের সুবিধা পায়নি। যারা মধ্যস্বত্বভোগী, কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে জড়িত তারাই এর মুনাফা লুটে নেয়। ভুক্তভোগী হয় সাধারণ ক্রেতা ও উৎপাদনকারী কৃষক। কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। উৎপাদনকারী কৃষক এই অর্থে বঞ্চিত হয় তিনি পণ্যের সঠিক দাম পাননি, আবার চড়ামূল্যে ক্রয় করতে হয় সাধারণ ক্রেতাদের। 
সিন্ডিকেট প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যে সকল বিষয় জরুরি তা হচ্ছে অধিক তদন্ত সাপেক্ষে সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করতে হবে। তাদের মদদদাতা কিংবা কাদের প্ররোচনায় সিন্ডিকেট পরিচালিত হয় তাদেরকেও চিহ্নিত করতে হবে। সিন্ডিকেটে চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। জনসম্মুখে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে, যাতে পরবর্তীতে তারা বাংলাদেশে ব্যবসা করার কোনো অধিকার না পায়। দেখা যায় সিন্ডিকেট বন্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, কিন্তু কখনো মূল হোতাদের বের করে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। যে কারণে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না। দায়িত্বশীলগণ বিভিন্ন সময়ে সিন্ডিকেটের কাছে তাদের অসহায়ত্বের ব্যাপার তুলে ধরেছেন।

এ ধরনের বিষয় কখনো কাম্য হতে পারে না। সিন্ডিকেট দেশ ও জনগণের শত্রু। তাদেরকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। সামান্য কিছু মানুষের নিকট পুরো দেশের মানুষ জিম্মি থাকতে পারে না। 
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে তেল, চাল, ডাল, আটা, আলু, ডিম, দুধ, মাংস ইত্যাদি পণ্যে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য লক্ষণীয়। সিন্ডিকেটের কারণে মানুষের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সিন্ডিকেটের বেশি দৌরাত্ম্যের কারণে আলু, পেঁয়াজ, ডিম তিনটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবু দাম নিয়ন্ত্রণে রাখছে না ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন অজুহাতে সাধারণ ক্রেতাদের নিকট অধিক মূল্য নিচ্ছে তারা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে। কিছুটা হলেও দমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

তবে যারা ক্রেতাসাধারণ তাদেরও এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণত সমাজভিত্তিক কমিটি গঠন করে কর্মকা- ঘোষণা করতে পারে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে পণ্য ক্রয় না করার ব্যাপারে ঐকমত্যে আসতে হবে। তাহলে ব্যবসায়ীরা এলাকাভিত্তিক কোণঠাসা হয়ে পড়বে এবং নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে সম্মত হবে। 
দালালদের কারণে অনেক সময় কোনো কারণ ব্যতিরেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। একটি সংঘবদ্ধ চক্র একত্রিত হয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে মুনাফা আদায় করে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জায়গায় খুচরা বাজার কেন্দ্রিক দালালদের আধিপত্য দেখা যায়। সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করার সময় এসেছে। অন্যথায় পরিস্থিতি পরিবর্তন করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। দালালদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সাধারণত দেখা যায় বাজারে বিক্রির জন্য কোনো পণ্য নিয়ে এলে বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে পণ্য কেনাবেচা করতে হয়।

কিংবা দালালদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ প্রদান করতে হয়। এর জেরে পণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায়। কাজেই বাজার কেন্দ্রিক যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তার জরুরি সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। আবার বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দালালদের একটি সম্পর্ক রয়েছে, যেই সম্পর্কের সূত্র ধরে দালালদের কার্যক্রম বেগবান হয়। সুতরাং এ সকল জায়গায় দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশের পাইকারি বাজারগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সার্বক্ষণিক মনিটরিং-এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অতিরিক্ত পণ্য মজুতদারদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। নচেৎ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।

দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত ‘সিন্ডিকেটের কব্জায় আলুর বাজার’ শীর্ষক শিরোনামে উঠে আসে ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছে। সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা। হিমাগার থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়ে আলুর বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর হয়নি। তাহলে এ জায়গায় সংশ্লিষ্ট সকলের যথাযথ কর্তব্য ও দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়াও সামনে নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে সরকারবিরোধী গ্রুপ বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে ফেলতে পারে। এ জায়গায় সরকারকে আরও দায়িত্বশীল কঠোর ও কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে। তা না হলে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা গ্রুপটি বেকায়দায় ফেলতে পারে সরকারকে। 
কাগুজে শেয়ার বাজারের মতো আলুর বাজারেও চলছে ‘স্লিপ বাণিজ্য’। ব্যবসার ধরন অনেকটা ভোজ্যতেল ও চিনির বাজারের ‘এসও ও ডিও’ ব্যবসার মতোই। সংরক্ষণ করা আলু হিমাগার মালিক ও মজুতদাররা স্লিপ বাণিজ্যের মাধ্যমে বহুজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তুলে নিয়েছেন বিপুল অঙ্কের টাকা। আলুর বাজার জিম্মি হয়ে পড়ছে স্লিপধারী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাতে। হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করলে সবার মুনাফা থাকবে। বিশেষ করে হিমাগারে মজুতদারদের প্রতিকেজিতে ৭-৮ টাকা মুনাফা হবে। এরপরও তারা হিমাগার থেকে আলু ছাড়ছে না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিয়মিত অভিযানে আরও বেঁকে বসেছে হিমাগার মালিক ও মজুতদাররা। আলুর বাজারের শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভাঙতে পারবে না বলে মনে করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কাজেই এখনই সুযোগ এসেছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জোগার করে অসাধু ব্যবসায়ীদের যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করার, যাতে ভবিষ্যতে কেউই এ ধরনের অপকর্ম করার দুঃসাহস না দেখাতে পারে। 
নিজস্ব হিমাগারের বেশিরভাগ আলুর মালিক এখন স্লিপধারী মজুতকারী। হিমাগার মালিকদের এখন আর বেশি আলু নেই। অনেক পেশাজীবী ও চাকরিজীবী হিমাগার থেকে আলু কিনে স্লিপ নিয়ে গেছেন। এটাই ব্যবসা। এখন তারা যদি আলু বিক্রি না করে সেক্ষেত্রে হিমাগার মালিকরা কি করতে পারে? নিত্য প্রয়োজনীয় ও চাহিদা সম্পন্ন হওয়ায় আলু ব্যবসায় অনেক পেশাজীবী ও টাকার মালিক এসেছে। শুধু স্লিপ কিনে আলু মজুত করছে। স্লিপ বাণিজ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে। এসব ব্যবসায়ীর দিকে সরকারের নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুক্তারপুর এলাকার রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজ পরিদর্শন করেছেন। ওই সময় তিনি জানান, রসিদের মাধ্যমে আলু বিক্রির বিষয়টি মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেখবেন। মজুতদাররা এই দামে আলু বিক্রি না করলে প্রশাসন এ দামে আলু বিক্রি করে যার আলু তাকে টাকা দেবে। ডিমের মতো আলু আমদানির কথাও ভাবা হচ্ছে। আশা করা যায় আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাজার পরিস্থিতি ঠিক হবে। সরকার নির্ধারিত দামে আলু পেঁয়াজ ডিম বিক্রি হবে।

এ ছাড়াও বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছে অধিদপ্তর। দৈনন্দিন বাজার মনিটরিংয়ে স্থানীয় প্রশাসনকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে ব্যবসায়ীরাও কোনো আড়তে আলু পাঠাচ্ছে না। এতে করে বাজারে আরও সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ এবং সরকার নির্ধারিত দাম বাজারে কার্যকর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
যে সকল ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা লুটে নিচ্ছে, তারা হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। শাস্তিমূলক পরিচয়ের দিকে না তাকিয়ে তাদের কর্মকা- বিবেচনায় প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সাপেক্ষে রাষ্ট্রের অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে বাজারে আরও কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে এবং ভুক্তভোগী হবে সাধারণ জনগণ। যার রেশ পড়বে সরকারের ওপর। এতদসংক্রান্ত সাধারণ মানুষকেও তথ্য-উপাত্ত প্রদান করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সহযোগিতা করতে হবে। সর্বোপরি হোয়াহট কলার ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। 

লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়