
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট ট্রানজেকশন বা ক্যাশলেস লেনদেন চলছে সাফল্যের সঙ্গে
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট ট্রানজেকশন বা ক্যাশলেস লেনদেন চলছে সাফল্যের সঙ্গে, গত বছরের শেষের দিকে মতিঝিল ও তার আশপাশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কিউআর কোডের মাধ্যমে। মোবাইল ফোনে ক্যাশলেস লেনদেনে নতুন যুক্ত হয়, খরচও বেশ কম। অবশ্য, বিকাশ, নগদ, রকেট, ইউক্যাশ ইত্যাদির মাধ্যমে টাকা লেনদেনের প্রচলন আছে আগে থেকেই। তবে সাধারণ ব্যাংকিংয়ের চেয়ে এই পদ্ধতিতে খরচ বেশি হওয়া সত্ত্বেও এগুলো স্বচ্ছতা, দ্রুততা এবং ঝামেলামুক্ত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ সব রকম লেনদেনে ধনী-গরিব সব ধরনের গ্রাহকদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় অভ্যন্তরীণ এসব লেনদেনে এমন চমৎকার ক্যাশলেস লেনদেন সিস্টেম থাকলেও আন্তর্জাতিক লেনদেনে নিজস্ব কোনো পেমেন্ট গেটওয়ে নেই।
দেশে বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্যারিয়ার হিসেবে অনেকেই এই পেশাকে বেছে নিয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, যা দেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। বিদেশ থেকে টাকা আনা কিংবা আন্তর্জাতিক লেনদেনে পেপ্যাল পেমেন্ট গেটওয়ে পদ্ধতি খুব বিশ্বস্ত, স্বচ্ছ এবং নির্ভরযোগ্য। কিন্তু বিশ্বের প্রায় ২০০ এর অধিক দেশ বা অঞ্চলে পেপ্যালের সেবা থাকলেও বাংলাদেশে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই।
এই বিবেচনায় ব্যাংক এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল পেমেন্ট সলিউশন প্রতিষ্ঠান ‘পেওনিয়ার’ এর মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে সেবা চালু করে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত নিউ ইয়র্কভিত্তিক পেওনিয়ারের বর্তমানে ২০০টির বেশি দেশে কার্যক্রম রয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে পেওনিয়ার অ্যাকাউন্টধারী একজন ফ্রিল্যান্সার যে কোনো ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট থেকে পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকে পাঠানো টাকা সরাসরি তুলতে পারে। অবশ্য ব্যাংক এশিয়া ২০১২ সাল থেকে দেশে প্রথম অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে সেবা দিয়ে আসছে ‘পেইজা’ নামে পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে। সেই হিসাবে পেওনিয়ার সেবা ব্যাংক এশিয়ার দ্বিতীয় সংযোজন, যার মাধ্যমে দ্রুত, সহজ ও তুলনামূলক কম খরচে সেবা দেওয়া হচ্ছে।
এক সময় ফ্রিল্যান্সারদের পাওনা অর্থ আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। এখন তা লাগে না। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে পেওনিয়ারের সেবা চালু রয়েছে। এর ফলে যে কোনো দেশ থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক অগণিত ওয়েবসাইটের পেআউট মেথডে পেওনিয়ার তালিকাভুক্ত থাকায় এর গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বব্যাপী আরও বেড়েছে। নির্দিষ্ট ফি-এর বিনিময়ে অ্যাকাউন্টধারীরা ই-ওয়ালেট, বিভিন্ন মুদ্রায় ভার্চুয়াল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ইন্টারন্যাশনাল মাস্টারকার্ড, ডেবিট কার্ড ইত্যাদি ইস্যু করতে পারে, যা ব্যবহার করে টাকা তোলা কিংবা অনলাইনে খরচ করা যায়। এছাড়া পেওনিয়ারের নিজস্ব অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি ভার্চুয়াল ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও পেমেন্ট গ্রহণ করা যায়। এজন্য বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্সার ও আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে অর্থ আদান-প্রদানে পেপ্যালের বিকল্প হিসেবে বর্তমানে পেওনিয়ার ব্যাপক প্রশংসিত।
পেওনিয়ার বিভিন্ন দেশের ১৫০ টিরও বেশি স্থানীয় মুদ্রায় ওয়্যার ট্রান্সফার, অনলাইন পেমেন্ট এবং রিফিলযোগ্য ডেবিট কার্ড পরিষেবা প্রদান করছে। প্রাপ্ত অর্থ যে কোনো দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও উত্তোলন করা যায়। এয়ারবিএনবি, টুইটার, মাইক্রোসফট, টুইটার, মেটা, অ্যামাজন, গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে শত শত অর্থ প্রদানে পেওনিয়ার ব্যবহার করছে। এটি ওয়ালমার্ট এবং টোকিও ভিত্তিক ই-বাণিজ্য রাকুটেনের মতো বড় বড় ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস এবং ফাইভার ও ইনভাটোর মতো ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে যেহেতু পেপ্যালের ওয়ালেট সেবা নেই, তাই এখানেও আন্তর্জাতিক লেনদেনের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয় পেওনিয়ারকে।
তবে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নতুন পেমেন্ট গেটওয়ে পদ্ধতি জুম (ঢড়ড়স) সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ পরিচিতি হয়ে উঠছে। এটি ব্যবহার অনেকটা পেপ্যালের মতই। প্রতিষ্ঠানটি এখনো বিশ্বের সকল দেশে না থাকলেও ফিচারের দিক দিয়ে কোনো কমতি নেই সার্ভিসটিতে। বিশ্বের প্রায় ৩৮ টি দেশে সফলভাবে জুমের কার্যক্রম চলছে। আরও আছে স্ক্রিল, ওয়াইজ, নেটেলার, পেজা, ২চেকআউট ইত্যাদি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সার্ভিস। স্ক্রিল পেপ্যালের বিকল্প হিসেবে আরেকটি জনপ্রিয় পেমেন্ট সার্ভিস। শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং বিশ্বব্যাপী স্ক্রিলের জনপ্রিয়তা দিনদিন বেড়েই চলেছে। লো কারেন্সি কনভার্সেশন রেটের কারণে পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে স্ক্রিল বেশ জনপ্রিয়। প্রিপেইড মাস্টারকার্ড অফার করে থাকে স্ক্রিল, যা ব্যবহার করে বিশ্বের অসংখ্য অনলাইন ও অফলাইন স্টোরে কেনাকাটা করা যায়।
স্ক্রিল ব্যবহারকারীগণ কার্ড ইস্যু করা ছাড়াই ব্যাংকের মাধ্যমে যে কোনো দেশ থেকে টাকা লেনদেন করতে পারে। ২চেকআউট (২পযবপশড়ঁঃ) হলো একটি পেমেন্ট গেটওয়ে, যা ব্যবহার করে ভিসা, মাস্টারকার্ড বা অ্যামেক্স কার্ড থেকে পেমেন্ট একসেপ্ট করা যায়। ওয়াইজ, পেপ্যাল, ও পেওনিয়ার সাপোর্টেড মাস্টারকার্ড মার্চেন্ট পেমেন্ট সুবিধা প্রদান করে ২চেকআউট। এছাড়া পেওনিয়ার ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে ফান্ড উইথড্র করার সুযোগও প্রদান করে ২চেকআউট।
আন্তর্জাতিক পেমেন্টের জন্য পেপ্যালের আরেক ভালো বিকল্প হলো ‘ওয়াইজ’, যা আগে ট্রান্সফারওয়াইজ নামে পরিচিত ছিল। কারেন্সি এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে বেশ ট্রান্সপারেন্ট এই সেবা। ফলে, আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ সেন্ড ও রিসিভের ক্ষেত্রে এই সেবা বেশ জনপ্রিয়। আবার অ্যাপ ব্যবহার করে অনলাইনে ট্রান্সফারে কোনো হিডেন ফি কাটে না ওয়াইজ। অনেকেই এই সেবাকে পেওনিয়ারের চেয়েও বেশি সুবিধাজনক মনে করেন। অবশ্য পেপ্যালের বিকল্প হিসেবে ‘নেটেলার’-এর ‘নেট+কার্ড’ ফিচারটি মার্চেন্ট পেমেন্টের ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয়। কিছু কিছু অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মগুলোতেও নেটেলার সাপোর্ট রয়েছে। অ্যান্ড্রয়েড ও আইফোনের অ্যাপস দিয়ে সেবাটি ব্যবহার করা যায়, যা এর একটি আকর্ষণীয় ফিচার।
এদিকে দেশীয় প্রোডাক্ট ‘বিকাশ’ অর্থ আদান-প্রদানে অসংখ্য আধুনিক ফিচার যুক্ত করায় এটি দেশ-বিদেশে গ্রাহকদের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি আরও কিছু এক্সক্লুসিভ সুবিধা প্রদান করে পেওনিয়ারের সঙ্গেও পার্টনারশিপ করেছে বিকাশ। ওয়াইজ থেকেও বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা তোলা যায়। এসব সুবিধার কারণে দেশের সেরা এই ডিজিটাল ওয়ালেটকে পেপ্যাল ও পেওনিয়ারের বিকল্প হিসেবে মনে করছেন অনেকে।
দেশে ছয় লাখের বেশি ফ্রিল্যান্সার আছে। আগামী পাঁচ বছরে আরও পাঁচ লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সারের আগমন ঘটবে। ভারতসহ অন্যান্য দেশে যারা ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং নিয়ে কাজ করে, তাদের তুলনায় বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারের পারিশ্রমিক কিছু কম। কারণ, বাংলাদেশের পেপ্যালের মতো কোনো পেমেন্ট ব্যবস্থা নেই। এর ফলে কমিশন বাবদ বছরে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। অথচ নেপাল, কেনিয়া, ইথিওপিয়ার মতো দেশেও পেপ্যালের সুবিধা আছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পেপ্যাল, পেওনিয়ার, জুমের মতো বিকল্প পেমেন্ট পদ্ধতি থাকা বাঞ্ছনীয়।
এমনকি বিকাশ, নগদ, রকেটকেও মানে ও গুণে আন্তর্জাতিক লেনদেন উপযোগী করা উচিত। তথ্যপ্রযুক্তির সক্ষমতায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কোনো দেশ থেকেই পিছিয়ে নেই। তাই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা হলো ফ্রিল্যান্সার। আউটসোর্সিং কিংবা বিজনেস কমিউনিটি ছাড়াও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম রেজিস্ট্রেশন বাবদ, বিদেশে চিকিৎসা ইত্যাদি নানাবিধ কাজে অনেকেরই উপকার হবে। ইতোমধ্যেই প্রযুক্তির যতটুকু সুযোগ আছে, তা কাজে লাগিয়ে প্রতিমাসে হাজার হাজার ডলার আয় করছে দেশের অসংখ্য ফ্রীল্যান্সার তাদের হাতের মুঠোয় থাকা মাউসের এক ক্লিকেই। কিন্তু শুধু পেমেন্ট গেটওয়ের অভাবে এবং কমিশন বাণিজ্যের অজুহাতে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে বাংলাদেশ, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়