ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

ঢাকা কি হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে    

কাওসার রহমান

প্রকাশিত: ১৫:১০, ৭ জুন ২০২৩; আপডেট: ১৫:৫০, ৭ জুন ২০২৩

ঢাকা কি হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে    

বৃক্ষ নিধন। ইনসেটে লেখকের ছবি

একটি আদর্শ শহরের জন্য ১৫ শতাংশ সবুজ ভূমি থাকা প্রয়োজন। জলাভূমি থাকার নিয়ম কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। ঢাকার সবুজ ভূমির পরিমাণ বর্তমানে অর্ধেকেরও কম। বর্তমানে ঢাকায় সবুজ ভূমি রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। অন্যদিকে, জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২.৯ শতাংশে।

সবুজ ভূমি এবং জলাভূমির এই বিপর্যযকর অধোগতির অন্যতম কারণ গত ২৮ বছরের সমন্বয়হীন উন্নয়ন। নির্ধারিত এলাকায় উন্নয়নকালে সবুজ ভূমি সংরক্ষণ ও বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

যদি আয়তনের হিসাবে দেখি তাহলে বিষয়টি দাঁড়ায়, ঢাকায় এখন মাত্র ২৯.৮৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় গাছপালা বা ফাঁকা স্থান রয়েছে, যা ১৯৯৫ সালে ছিল প্রায় ৫২.৪৮ বর্গ কিলোমিটার। অন্যদিকে, জলাভূমি এলাকা ওই সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪.২৮ বর্গ কিলোমিটারে, যা ১৯৯৫ সালে ৩০.২৪ বর্গ কিলোমিটার ছিল। সবুজ ভুমি ও জলাশয়ের এই অবক্ষয়ের কারণে তীব্র তাপপ্রবাহে ঢাকার জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। 

বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

ঢাকাবাসীর জন্য এই উদ্বেগজনক তথ্য আমরা পেলাম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসানের ‘২৮ বছরে রাজধানীর জলাধার ও সবুজ নিধন: বাস্তবতা ও উত্তরণের পথনকশা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে। 

মূলত নগরীর উন্নয়নযজ্ঞ তথা আইল্যান্ড, ফুটপাত ও পার্কের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ঢাকায় কনক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠ দখল করে তৈরি হচ্ছে ক্লাব, মার্কেট, হাটবাজারসহ নানা স্থাপনা। ফলে ঢাকা একটি হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি, ঢাকায় সড়কের আইল্যান্ড উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন। ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডের আইল্যান্ড উন্নয়ন করতে গিয়ে গত ৩০ বছর ধরে বেড়ে উঠা বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকাবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা হয়েছে। সর্বশেষ দক্ষিণ সিটির নগভবন ঘেরাওয়ায়ের মতো কর্মসূচীতেও পরিবেশবাদীদের যেতে হয়েছে। 

বৃক্ষ নিধনঢাকা উত্তর সিটির সিটির আওতায় মিরপুর রোডেও একইভাবে আইল্যান্ডের উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন শুরু হয়েছিল। তবে উত্তর সিটি কিছুটা পরিবেশ সচেতন হওয়ায় তারা প্রতিবাদের মুখে সেটি বন্ধ করেছে। পরিবর্তে আইল্যান্ডের মাঝে গাছ রেখেই উন্নয়নের কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। আর গাছ কাটার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করেছে। কিন্তু উত্তর সিটি কর্পোরেশন মহাখালি থেকে গুলশান পর্যন্ত সড়কের আইল্যান্ডের ওপর বেড়ে উঠা অনেক বৃক্ষ ইতোমধ্যে নিধন করে ফেলেছে। 

রাজধানীর ইস্কাটনেও একইভাবে আইল্যান্ড উন্নয়নের নামে অনেকগুলো বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে। এখানে উন্নয়নের কাজ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত আইল্যান্ডে কোন গাছ লাগানো হয়নি। ফলে আইল্যান্ডটি ন্যাড়া অবস্থায় পড়ে আছে এবং গাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনকারী দোকানগুলোর আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। 

উত্তর সিটিতে আগেও মেয়রের সময়েও ফুটপাত উন্নয়নের নামে অনেক বড় বড় বক্ষ নিধন করা হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, একটি বৃক্ষ কাটলে দুটি বৃক্ষ লাগানো হবে। কিন্তু সেই বৃক্ষ আর লাগানো হয়নি। ফলে ফুটপাতগুলো বৃক্ষহীন ন্যাড়া ফুটপাতে পরিণত হয়েছে। 

কয়েক বছর আগেও আমরা দেখেছি, মোহাম্মদপুর এলাকার রাস্তা-ফুটপাতের উন্নয়ন করা হয়েছে। ওই সময়ে রাস্তার পাশে ফুটপাত বানাতে গিয়ে যত বৃক্ষ ছিল সব ঠিকাদাররা কেটে নিয়ে গেছে। আমরা মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও দেখেছি, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ফুটপাতে অনেক পুরোনো বিশাল বিশাল বৃক্ষ কেটে ফেলা হয়েছে। 

তবে উত্তর সিটি কর্পোরেশন হালে কিছুটা সচেতন হয়েছে। গাছ কাটার ব্যাপারে তারা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে এ কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে একজন হিট অফিসারও নিয়োগ করা হয়েছে। ডিএনসিসি  মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, অনুমতি ছাড়া নগরীর গাছ কাটলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাছ কাটলে কেউ শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না। আমরা ইতোমধ্যেই কোনো গাছ না কেটে উন্নয়ন কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছি। উত্তর সিটি ইতোমধ্যে দুই লাখ গাছের চারা রোপণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

বৃক্ষরোপণঅপরদিকে, বৃক্ষ নির্ধনের সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি বলছে, ‘আইল্যান্ডে গাছ লাগানো ভুল পরিকল্পনা ছিল।’ এই সিটি কর্পোরেশন গাছ লাগানোর ৩০ বছর পর ভুল বুঝতে পেরেছে। যদি ভুল পরিকল্পনা হয়ে থাকে তবে গাছ কাটার আগে যারা এই ভুল পরিকল্পনার জন্য দায়ি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। আবার বলা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় এলে আইল্যান্ডের গাছ পড়ে গিয়ে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। 

এটা ঠিক, তাই বলে সব বৃক্ষ নির্ধন করে ফেলা কোন যুক্তি হতে পারে না। ঘুর্ণিঝড়ে শুধু আইল্যান্ড কেন ফুটপাতের গাছও পড়ে যায় বা ভেঙে যায়। সেগুলো কেটে পরিস্কার করা সিটি কর্পোরেশনেরই কাজ। পৃথিবীর সব দেশেই এ ব্যবস্থা বিরাজমান। শহরে ঝড়ে কোন গাছ পড়ে গেলে সঙ্গে কর্পোরেশনের টিম সেখানে পৌছে গিয়ে ভাঙা গাছ অপসারণ করে যান চলাচল স্বাভাবিক করে। 

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লীতে শহরেই দেখা যায়, ফুটপাত ও আইল্যান্ডে বিশাল বিশাল বৃক্ষ। এসব বৃক্ষ এখন বেড়ে এমন ছায়াপথ তৈরি করেছে যে, ওই সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় সূর্য পযন্ত দেখা পাওয়া যায় না। কী সুন্দর নির্মল সবুজ পরিবেশ। এসব দেখেও আমাদের নীতি নির্ধারকদের হুশ হচ্ছে না। আসলে গাছ কাটা আমাদের ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দেশের যেখানেই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেখানে ঠিকাদাররা গিয়ে আগে সব গাছ কেটে বিক্রি করে ওই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। 

সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম রোড ও আসাদ এভিনিউ রোডের ওপর সরকারি কর্মচারীদের দুটি আবাসিক এলাকার  পুরোনো জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে এখন নতুন করে বহুতল ভবন করা হবে।  কিন্তু ভবন ভাঙতে গিয়ে আবাসিক এলাকার সীমানায় যত বড় বড় বৃক্ষ ছিল সব কেটে ফেলা হয়েছে। এসব গাছগুলো সীমানা দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া ছিল। এসব গাছ বাঁচিয়ে রেখেও ওই আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এই গাছগুলো কাটা হলো এজন্য কাউকে জবাবদিহিও করতে হয়নি। 

আসলে আমাদের দেশে একটি পরিবেশ মন্ত্রণালয় আছে, লোক দেখানো ছাড়া পরিবেশ রক্ষায় তার কোন ভূমিকা নেই। অথচ গাছ হচ্ছে -পরিবেশ রক্ষার অন্যতম নিয়ামক। গাছ তাপ শোষণ করে এলাকাকে উত্তাপ থেকে রক্ষা করে। নির্মল বাতাস বইতে সহায়তা করে। কিন্তু ইদানিং ঢাকার সঙ্গে ঢাকার বাইরের তাপমাত্রার বেশি পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। আশপাশের জেলাগুলোর তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা সব সময়ই ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকছে। ঢাকায় ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা হলেও বাস্তবে এটি অনুভব হচ্ছে আরও ৬-৭ ডিগ্রি বেশি। 

গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার সঙ্গে শহরের বাইরের গরমের অনুভূতির এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাপীয় দ্বীপ (হিট আইল্যান্ড)। ঢাকার মূল বসতি ও বাণিজ্যিক এলাকার একটা বড় অংশ তাপীয় দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ফলে ঢাকার ঠিক বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এলাকার সঙ্গে রাজধানীর তাপের পার্থক্য তৈরি হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সঙ্গে শহরের বাইরের শীতলতম স্থানের দিন-রাতের ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টি অনেকটা এমন, ঢাকার অদূরে সাভার বা মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে যখন তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে, তখন রাজধানীর তেজগাঁও-ফার্মগেট এলাকার ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার ঢাকার ভেতরেও ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়। 

যেমন দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে মিরপুরের চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকার তাপমাত্রা গুলশানের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। শাহবাগ মোড় থেকে ঠিক দুই বা তিনশ মিটার ভেতরে জাতীয় জাদুঘর। সেখানে গেলেই তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রির কম অনুভব হয়। ঢাকায় বেশি গরম অনুভূতের অন্যতম কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও স্থানীয় দূষণগুলো।

রাজধানীতে এয়ার টাইট উঁচু উঁচু ভবনগুলো কাচে আচ্ছাদিত। সঙ্গে উচ্চমাত্রার এয়ারকন্ডিশন লাগানো। এগুলো উল্টো তাপ উৎপাদন করে। আবার যেসব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয় সেগুরোও সৃষ্টি করে তাপ। তাপদাহে অতিষ্ঠ মানুষ গরম থেকে বাঁচতে এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করছে। এই এয়ারকন্ডিশনগুলো পাশের বাসায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে এখানেও সৃষ্টি হচ্ছে তাপমাত্রার বৈষম্য।

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিপরিবেশবিদেরা বলছেন, শহরে প্রাকৃতিক ভূরূপ যত কংক্রিটে ছেয়ে যায়, তত তাপ ধরে রাখতে শুরু করে। আর তার ফলে হয় এমনটা। এয়ার টাইট উঁচু উঁচু ভবন, অপরিকল্পিত ইট-কংক্রিটের স্থাপনা, যানবাহন ও জনসংখ্যার ঘনত্বের সঙ্গে নানা রকম দূষণ, বায়ু, মিথেন, পানি, নদী ও জলাশয় ভরাট করার ফলে শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে। রাজধানীকে কংক্রিটের শহর বানানো হয়েছে। এর ফলে কী ধরনের পরিস্থিতি হচ্ছে তা ঢাকার পরিবেশই বলে দিচ্ছে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. আনোয়ার খসরু ‘পারভেজ তাঁর ‘ঢাকার বড় অংশই যখন হিট আইল্যান্ডে পরিণত’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেছেন, অবাধে গাছপালা কেটে ফেলা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে নগরায়ণের জন্য কাঠামো বা স্থাপনা তৈরি, খোলা জায়গা না থাকার ফলে ভবন, কংক্রিট, পিচ, রাস্তা, ঘনবসতি, চুলা, পরিবহন প্রভৃতি থেকে ও মানুষের কর্মের কারণে নির্গত তাপ ক্রমশ ঢাকাকে এক একটি তাপীয় দ্বীপের ‘হিট বোম্বে’ পরিণত করছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

শুধুমাত্র কলকব্জা কিংবা গাড়ির ধোঁয়া বা কারখানার চিমনি থেকে নির্গত দূষিত পদার্থই শহরাঞ্চলে গরমের জন্য দায়ী নয়। কোনো কিছু তৈরিতে আমরা যে উপাদান ব্যবহার করে থাকি, সেই উপাদানগুলোর কারণেও গরম বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সবকিছু মিলে একটি জায়গায় যে উষ্ণতার সৃষ্টি হয় সেই উষ্ণতাপ্রবণ এলাকাকেই বলা হয় হিট আইল্যান্ড। ফলে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি হলেও ঢাকার গরম কমছে না। এর কারণ হচ্ছে, রাতের তাপমাত্রা ও বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে।  

শুধু তাপপ্রবাহেই নয়, রাজধানী বায়ুদূষণেও রেকর্ড করছে। গড় বায়ুদুষণের তুলনায় এবার এপ্রিল মাসে বায়ুদূষণ বেড়েছে প্রায় ২৬.৯৩ শতাংশ। গবেষণায় দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ঢাকা শহরেরপ ভূপৃষ্ঠ এলাকা ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ  সম্প্রসারিত হয়েছে। একই সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বসবাসের উপযোগিতার দিক থেকে ঢাকার অবস্থান ক্রমাগত তলানিতে নেমে যাচ্ছে। 

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৪০টি শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে শহরগুলোর বসবাস উপযোগিতার যে তালিকা করেছিল বছর দুয়েক আগে তাতে ঢাকার অবস্থান ছিল শেষ দিক থেকে চার নম্বরে। ওই তালিকায় ১৩৭ নম্বরে ছিল ঢাকার অবস্থান।

একটি আদর্শ শহরের জন্য কমপক্ষে ৪০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু রাজধানীতে ১০ শতাংশ জায়গা ছাড়ার প্রমাণ পাওযা যায়নি কোন গবেষণায়। সভ্যতা ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন জীবনযাত্রা যেমন সহজ করছে, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করা, নদী, সমুদ্র ইত্যাদি দূষণ করা আমাদের জীবনকে শঙ্কাগ্রস্ত করে তুলেছে। পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়ন না হলে মানুষ এবং অন্য সব জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস অনিবার্য। এজন্য আশু করণীয় ঠিক করার এখনই উপযুক্ত সময়। 

এক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), পরিকল্পনা কমিশন, এলজিইডি, পরিবেশ অধিদফতর, বন অধিদফতর, এনএইচএ, গণপূর্ত অধিদফতর, মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়, উন্নয়ন সহযোগীসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হবে। 

বৃক্ষকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টাড্যাপে বর্ণিত ‘নগর জীবনরেখা’ বাস্তবায়নের লক্ষে নগরের সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে। শহরের জলাধার ও সবুজ এলাকা রক্ষা করার উদ্দেশ্য জলাধার সংলগ্ন জায়গাগুলোতে পাবলিক স্পেস তৈরি করতে হবে। এছাড়াও ঢাকা কেন্দ্রিক উন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করে অবশিষ্ট সবুজ ভূমি রক্ষা করতে হবে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে পার্ক এবং খোলা জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। রাজউক যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ইমারত ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দিতে হবে। নির্মাণ অনুমতিপত্র ও অকুপেন্সি সার্টিফিকেট প্রদান করতে হবে।

বন অধিদপ্তরকে বনসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার সাথে জীববৈচিত্র্য ও জলাশয় ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ কাজে নিয়োজিত হতে হবে। সেক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে গাছ কাটার বিরুদ্দে তৎক্ষনাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

ন্যাশনাল হাউজিং অথোরিটিরকে হাউজিং প্রোজেক্টে সবুজ ভূমির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে গণপূর্ত অধিদফতরের কাজ হবে ঢাকা মহানগরে মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু পার্ক এবং খোলা জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ করা। পরিকল্পনা কমিশনকে অনুমোদিত নীতিমালা অনুযায়ী দেশের অর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। মধ্যমেয়াদি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তাত্তি¡ক কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।

এলজিইডিকে ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পাদক উন্নয়ন, উৎপাদিত কৃষি ও অকৃষি পণ্য পরিবহন ও এর সুষ্ঠু বিপণনে গ্রামীণ সঠিক অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। পরিবেশ অধিদফতর পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সক্ষমতা তৈরির লক্ষে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, মতবিনিময় সভা ইত্যাদি আয়োজন ‘গ্রিন গ্রোথকে’ উৎসাহিত করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল এনজিও এসডিজি নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা জরুরি। স্থানীয় এনজিও, এসডিজি ও দেশীয় টার্গেট নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

সামাজিক ও পরিবেশবাাদী সংগঠনগুরোকে  বাংলাদেশে পরিবেশের আরও অবনতির প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সোচ্ছার হতে হবে। গণমাধ্যমকে সবুজ ভূমি সংলগ্ন উন্নয়ন, অবনতি, পর্যবেক্ষণ করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতামত গ্রহণ এবং প্রচার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সবুজ ভূমির ব্যবহার সংরক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্য বিভিন্ন গবেষণা করা এবং পরামর্শ দিতে হবে।
যেকোনো আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের জন্য আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম থাকা উচিত। এক্ষেত্রে ‘হিট ওয়েভ আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ পদ্ধতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে নানান কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে গরমের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। দূষণ ও দখলের মতো কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে আমাদের প্রজন্ম পঙ্গু করে দেবে এই বোধের জাগরণ তৈরি করতে হবে। 

সর্বোপরি, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে। যে ভুলগুলোর কারণে এমনটি হয়েছে সেটা আর শোধরানোর কোনো উপায় নেই, কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা এবং পরিবেশ আইন প্রণয়ন করলে অনেকটাই ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে। 

লেখক: কাওসার রহমান, প্রধান প্রতিবেদক ও নগর সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ


 

এসআর

×