ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

শক্তি থাকতে হজ

মনরিুল ইসলাম রফকি

প্রকাশিত: ২০:৪১, ১ জুন ২০২৩

শক্তি থাকতে হজ

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে হাজি সাহেবান এবারের আসন্ন হজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য পবিত্র মক্কা নগরীতে গিয়ে সমবেত হচ্ছেন। সামনের জিলহজ মাসের প্রথমার্ধে কা’বা শরিফ কেন্দ্রিক হজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা সম্পন্ন হবে। হজ মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ইবাদত ও বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মেলন। সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। কুরআনুল কারীমে এসেছে : আল্লাহতায়ালার তরফ হতে মানুষের ওপর ‘হজে বায়তুল্লাহর’ দায়িত্ব রয়েছে; যারা পথের খরচ বহন করতে সক্ষম।

রাসুলে পাক (স.) ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তির হজ করতে এমন কোনো প্রকাশ্য বিশেষ প্রয়োজন কিংবা জালিম বাদশাহ অথবা প্রতিরোধক রোগ যদি প্রতিবন্ধক না হয় এবং সে হজ না করে মারা যায়; তবে সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হোক কিংবা নাসারা হয়ে মরুক (সে আমার জিম্মায় থাকবে না)।-আল হাদিস। তিনি আরও বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর রিজামন্দির উদ্দেশ্যে হজে গিয়ে কারও প্রতি অশালীন না হয়। কোনো ফাসেকি কাজ না করে তবে সে এরূপ নিষ্পাপ অবস্থায় ফিরে আসে, যেন ঐদিনই তাকে তার মা প্রসব করেছে। 
আল কোরআন ও আল হাদিসের উপরোক্ত মর্মবাণী অনুধাবন করে উম্মতে মুসলিমার এক বিরাট অংশ প্রতিবছর হজ সম্পন্ন করেন। হজ এমন এক অনুষ্ঠান যাতে রয়েছে বিভিন্ন পালনীয় কর্মসূচি। এখানে দৈহিক শক্তির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমাদের দেশে একটি রেওয়াজ আছে, একান্ত ‘বুড়ো লাগের’ হয়ে গেলে হজে যাওয়ার ইরাদা করা হয়। মানে ধারণটি এমন দাঁড়ায় : ‘দুনিয়ায় আরও একটু খাইয়া-দাইয়া লই, তারপর হজে যামুনে গুনাহ মাফ করবার লাগি।’ এমন ধারণাকারীদের জন্য তিনটি সমস্যা। এক : কোনো মানুষ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না তার আয়ুষ্কাল কতদিন অবশিষ্ট থাকবে।

অনেক সামর্থ্যবান মানুষকে দেখা যায় হজের আয়োজন সারতে সারতে ইহদাম ত্যাগ করতে হয় অতৃপ্ত মন নিয়ে। দ্বিতীয়ত: ইসলামে ধন-মালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর হজের বিধান প্রয়োগ করার দর্শন এটাই যে, হজ সমাপনপূর্বক একজন অনুতাপে দগ্ধ ও নিষ্পাপ মানুষ নিজেকে এবং সমাজকে সত্য ও সুন্দরের আদলে গড়ে নেবে। একেবারে বৃদ্ধ অবস্থায় হজ করে এসে তার সে স্পৃহা ও আবেদন থাকার কথা নয়। তৃতীয়ত: হজের হুকুম আহকাম পালনের সময় বেশ শক্তির প্রয়োজন হয়। যেমন: তাওয়াফ বা লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে কা’বা শরীফ প্রদক্ষিণের সময়, সায়ী বা সাফা-মারওয়ায় দৌড়াভিযানকালে, রমিল জিমার অর্থাৎ শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপের বেলায়, হাজরে আসওয়াাদ চুম্বনের সময়। 
আমাদের দেশ থেকে হজে গমনকারীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব কমই হয়ে থাকে। এর পেছনে রয়েছে আইনগত জটিলতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ইদানীং প্রচণ্ড আর্থিক অসংগতি। মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ার চিত্র এক্ষেত্রে আমরা সামনে আনতে পারি। মালয়েশিয়ার হজ ব্যবস্থাপনা এত সহজ ও পরিচ্ছন্ন যে, সেখানকার অধিবাসীরা অনায়াসে হজে যেতে পারে। এর ফলে আমরা দেখি, সে দেশে ঘরে ঘরে হাজি রয়েছে। শিশু হাজি, কিশোর হাজি, বৃদ্ধ হাজি। বিভিন্ন বয়স ও পেশার তারতম্য তাদেরকে হজ পালনে বাধা সৃষ্টি করে না। তারা সচরাচর নামের শুরুতে সবাই হাজি লিখতেও কার্পণ্য করেন না। কেননা, আজকাল সেদেশে সামাজিক মর্যাদার জন্য, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কামনার জন্য এমনকি বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও অন্যান্য গুণাবলীর সঙ্গে এটিও বিশেষভাবে গণনা করা হয়।

তাহলে কিভাবে তাদের জন্য এ সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হলো? আসলে তাদের এ সম্ভাবনাময় দিগন্তের উন্মোচন করেছে সেখানকার একটি হজ সংক্রান্ত সংস্থা বা ব্যাংক ‘তাবুং হাজি’। আপনি হজে যাওয়ার জন্য এ ব্যাংকে সাধ্যমত কিস্তিতে টাকা আমানত রাখবেন; আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে হজের আহ্বান জানানো হবে। আমাদের দেশে যেহেতু আজও তেমন কোনো সিস্টেম গড়ে উঠেনি, আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকে হজের জন্য পুতইরাদা পূরণের মানসে জমাজাতি করে রাখতে পারি। তাহলে একদিনকার কঠিন স্বপ্ন হয়তো সহজ পন্থায় বাস্তবায়নে সমর্থ হব। বিভিন্ন পেশার লোকজন এভাবেই হজ করছেন। অবশ্য ইদানীং চাকরির এক পর্যায়ে কেউ কেউ হজ অ্যাকাউন্টও খুলছে।
একজন মুসলমানকে প্রভুর নৈকট্যের চূড়ান্ত মনজিলে মাকসুদে উন্নীত করে হজ। এ জন্য হজের আয়োজন বছরের সমাপনী মাসে। মুহররম থেকে জিলকদ পর্যন্ত মুসলমানেরা ঈমান, নামাজ, রোজা, জাকাত; এ চারটিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে আঁ-হযরতে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সবশেষ পর্যায়ে হিজরি সালের আখেরি মাসে হজ পালন পূর্বক নিষ্পাপ জীবনলাভে ব্রতি হয়। মানুষের নিভু নিভু ঈমানী দ্বীপশিখাকে প্রজ্বলিত করে তোলে, হৃদয় স্পন্দিত হয় সত্য ও ন্যায়ের মন্ত্রে, ন্যায়বোধ শক্তির উদয় হয়। ইসলামের আদি বাস্তব ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিতালী করার মাধ্যমে জীবনে আসে বহু জিজ্ঞাসা ও তার জবাব, ব্যাপক অনুতাপ, অনুশোচনা। সর্বোপরি মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের মাধ্যমে একজন মুমিন ধন্য হয়ে ওঠে। আর এসব কামাই ও উপলব্ধির জন্য অবশ্যই শক্তি থাকতে অগ্রসর হতে হবে। 
এখন যারা পবিত্র মক্কা-মদিনায় হজের ময়দানে রয়েছেন বা আমরা যারা এখন হজের তামান্নায় পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে পবিত্র মক্কা শরীেেফ লাব্বায়েক ধ্বনিতে বিভোর হয়ে আছি, কি যে আনন্দ অনুভব করছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু দুনিয়াবী একটি পেরেশানী বারবার হৃদয়কে ছুরিকাহত করে। আপন ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে দেশের বাসাবাড়িতে রেখে এসেছি। তাদের কত আবদার, কত সুবিধা-অসুবিধা কিভাবে পিতামাতা ছাড়া মেনে নিতে পারছে। তবু বলি, একদিন তো পিতামাতাকে হারাতে হবেই। সেদিন নিজ পায়ে দাঁড়ানোর একটি সাহস অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে তাদের এ হজ মৌসুমে। আসলে হজ মানেই হারিয়ে যাওয়া, সর্বত্যাগী হওয়া। কিছুদিনের জন্য জীবনের প্রতিনিঃশ্বাসকে আল্লাহর পথে অতিবাহিত করার তালিম তারবিয়াত নেওয়া।

হজের খরচ বাড়াতে এ বছর আমাদের দেশ থেকে মাত্র সোয়া লাখের মতো হজযাত্রী রয়েছে। আগামী বছর এভাবে খরচ বাড়তে থাকলে এর পরিমাণ আরও কমতে পারে। সাধারণ মানুষের জন্য হজের ফরজিয়ত আদায় ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যা মোটেই সুখকর খবর নয়, পেরেশানি ও উদ্বিগ্নের। ২/১ বছরের মধ্যে বহু হজযাত্রী আর্থিক জোগান দিতে না পেরে তাদের হজের জন্য দাখিল করা টাকা তুলে নিয়েছে। আবার কেউ কেউ সামর্থ্যরে টাকার মধ্যে উমরাহ পালন করে আসছে। তাই বর্তমানে উমরাহ মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশীসহ উমরাহযাত্রীর কোলাহল লক্ষ্য করা যাচ্ছে পবিত্র হারামাইন শারীফাইনে।

হজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের জন্য কাল হয়েছে রহস্যজনক কারণে থার্ড ক্যারিয়ার ওপেন না করা এবং সারা বছরের বিমানের ভর্তুকি হজযাত্রীদের কাছ থেকে পুষিয়ে নেওয়ার মানসিকতা। অথচ সাদা শুভ্র দু’খানা ইহরামের কাপড় পরা ঐসব কাবা জিয়ারতকারীর সর্বপ্রকারের বাধা ও অসহযোগিতাগুলো দূর করতে পারলে ঢাকা-চট্টগ্রামের বিমানবন্দর ত্যাগের সময় তাদের অশ্রুগুলো আমাদের অনুকূলেই ঝরতো। 
আল্লাহুম্মার জুকনা হাজা বাইতিকাল হারাম... হে আল্লাহ পরওয়ারদিগার! আমাদের তোমার পবিত্র সম্মানিত ঘরের জিয়ারত নসীব করো, আর সৌভাগ্যমণ্ডিত কর তোমার প্রিয় নবী প্রিয় হাবীবের (স.) রওজা শরীফ জিয়ারতের।
 
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×