ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য

শতদল বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৪ মে ২০২৩

বুদ্ধ পূর্ণিমার তাৎপর্য

শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তথা বুদ্ধ পূর্ণিমা। দিনটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন

শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তথা বুদ্ধ পূর্ণিমা। দিনটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। কারণ এ তিথি ঘিরে রয়েছে তথাগত বুদ্ধের তিনটি স্মরণীয় ঘটনা। ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত এ তিথির তাৎপর্য অত্যন্ত বিশাল। সব পূর্ণিমা তিথি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য কোনো না কোনোভাবে গুরুত্ব বহন করে। তবে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথির সঙ্গে রয়েছে অন্য তিথিগুলোর বিস্তর ফারাক। আগে প্রায় দুই বছর করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশী বৌদ্ধরা কোনো পূর্ণিমা উৎসব উদ্যাপন করতে পারেনি সম্মিলিতভাবে বিহারে উপস্থিত হয়ে। কারণ সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে বৌদ্ধ পূর্ণিমা মহাসমারোহে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হচ্ছে। যেমন এবারে ঈদুল ফিতর বাংলাদেশে সবাই নিশ্চিন্তে পালন করেছে। যা দেশবাসীর জন্য এক সুখকর সংবাদ। আগামীতে আর কোনো করোনাভাইরাসের মতো মহামারিকে মোকাবিলা করতে হবে না। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এবারের বৌদ্ধ পূর্ণিমা এ অঙ্গীকার পালনে সচেষ্ট। 
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বৌদ্ধ সম্প্রদায় বৈশাখী পূর্ণিমার ঘটনাবহুল দিক নিয়ে এদিন থাকে উৎসবে মাতোয়ারা। এদিন সরকারি ছুটি থাকে। প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে কমিটি গঠন করে পনেরোদিন আগে থেকে বৈশাখী পূর্ণিমা পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমায় আমরা পুলকিত। জাতির ক্রান্তিকালে বুদ্ধ নির্দেশিত বাণীগুলো বড়ই অপরিহার্য বিষয়। জীবন সংগ্রামে আমরা নানাভাবে অত্যন্ত অসহায়। মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসতে পারাই হলো একজন মানুষের আসল বৈশিষ্ট্য। 
গভীর রাত, পুণ্যবতী মায়াদেবী রাজপালঙ্কে অঘোর নিদ্রায় মগ্ন। ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি স্বপ্ন দেখলেন। সেদিন ছিল কপিলাবস্তু নগরীতে আষাঢ়ী পূর্ণিমার উৎসব। রাণী সারাদিন উৎসবে মেতে ক্লান্ত শরীরে শেষ রাতে স্বপ্নে দেখলেন চারদিক থেকে চার দিকপাল এসে তাকে শয্যাসহ তুলে নিলেন। চাঁদের জ্যোৎস্না ছড়ানো রমণীয় এক হ্রদে রাণী দেখলেন সহস্রদল পদ্ম। লাবণ্য আর লালিমায় রক্তিম। এক সাদা হস্তী সেই হ্রদে জলকেলী করছে। হস্তীটি মায়াদেবীর আগমনে সামনে এগিয়ে এলো। একটি বর্ণময় পদ্ম মায়াদেবীর ডান কুক্খিতে প্রবেশ করিয়ে দিল হস্তীটি। এতে রাণীর দেহমনে এক অপূর্ব শিহরণ জাগ্রত হলো। মায়াদেবীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি পালঙ্কে উঠে বসলেন। শাক্যরাজ্যের প্রাণপুরুষ রাজা শুদ্ধোধনের রাজমহিষী তিনি। একি দেখলাম! পরদিন রাণী রাজা শুদ্ধোধনের কাছে স্বপ্নের কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলেন। রাজা কালবিলম্ব না করে জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠালেন এবং জ্যোতিষীদের কাছ থেকে রাণীর স্বপ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাইলেন।
জ্যোতিষীরা বললেন- মহারাজ, রাণী মায়াদেবীর পুত্রসন্তান হবে। এই পুত্র মহাতেজস্বী ও যশস্বী মহাপুরুষ হবেন। শান্ত, গভীর, জগতে দুর্লভ, জীবের দুঃখহারী ও মহাজ্ঞানী পুত্রের জনক হবেন আপনি। তবে এখানে নৈরাশ্য এবং বেদনার সংবাদও জড়িয়ে রয়েছে। আছে কিছু বিয়োগ-বিচ্ছেদের অশনিসঙ্কেত।
রাজা শুদ্ধোধন অতলায়িত বিস্ময়ে তাকিয়ে জ্যোতিষীদের নির্দেশ করলেন ঘটনা খুলে বলার জন্য। তারা বললেন, পুত্রসন্তান লাভের সাতদিন পর মায়াদেবীর অকালমৃত্যু ঘটবে। এ মৃত্যু অমোঘ, অনিবার্য। একদিকে রাজপ্রাসাদে মহাপুরুষের আগমন সংবাদ, অপরদিকে মায়াদেবীর আসন্ন মৃত্যু সংবাদে রাজা শুদ্ধোধন বিচলিত। যথাসময়ে মায়াদেবী পিত্রালয় দেবদহনগরে যাওয়ার জন্য রাজার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। মায়াদেবী দেবদহনগরের রাজা সুত্রবুদ্ধের জ্যেষ্ঠ কন্যা। এলো বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। ইতোপূর্বে রাজা রাণীর বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য সব ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে রেখেছিলেন। নির্দিষ্ট দিনে সন্তানসম্ভাবা মায়াদেবী সখীদলসহ রথে চড়ে বাপের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করলেন। মুখে তাঁর অপরূপ লাবণ্য, বেদনা, করুণা আর ধৃতির স্নিগ্ধতা। তিনি হবেন আলোকসুন্দর দিব্য পুরুষের জন্মদাত্রী। সৃষ্টির পূর্ণতা ও অনুপম সৌন্দর্যে সমুজ্জ্বল। বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনী কাননে পৌঁছামাত্রই মায়াদেবীর প্রসববেদনা শুরু হলো।
এক পদ্ম-পলাশ-লোচন ব্রহ্মযোগযুক্ত আত্মভোলা শিশু জগতের ভাবী বুদ্ধের জন্ম হলো। লুম্বিনী উদ্যান হয়ে উঠল সৃষ্টির উৎসারিত আলোক সমুদ্র। পূর্ণতার পরমতম আকর্ষণ। মায়াদেবী উদাসীন অথচ আনন্দময়ী, জগজ্জননী জ্যোর্তিময়ী। মহাসমারোহে শোভাযাত্রাসহকারে মাতা ও তেজস্বী নবজাতককে লুম্বিনীকাকন থেকে কপিলাবস্তু নগরের রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনা হলো। এই দিনে গয়ার বোধিগাছ, রাহুলমাতা গোপাদেবী, চার নিধিকুম্ভ, চার মঙ্গল হস্তী, সারথি ছন্দক এবং অমাত্যপুত্র উদায়ীও জন্মগ্রহণ করেন। মহাপুরুষ গৌতমের সঙ্গে তারা প্রত্যেকে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেই দিনটি ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। দিব্যজ্ঞানস্বরূপ সাধনা সম্ভুত জ্যোতির্ময় পুরুষের জন্মের সাতদিন পর মায়াদেবীর অকালমৃত্যু হয়। মায়াদেবীর মৃত্যুতে রাজ্যময় শোক নেমে এলো। রাজপ্রাসাদের অঙ্গন-প্রাঙ্গণের সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হলো।
প্রাচীনকালে রাজাদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা চালু ছিল বিধায় রাজা শুদ্ধোধনেরও একাধিক মহিষী ছিলেন। এর মধ্যে মনোমাধুরী মায়াদেবীই ছিলেন রাজার প্রধান পত্নী। রাজা তাঁর অপর স্ত্রী গৌতমীকে সিদ্ধার্থের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানালেন। গৌতমীও বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে সিদ্ধার্থের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। ফলে বিমাতা গৌতমীর অশেষ স্নেহপরশে সিদ্ধার্থের শৈশব কাটতে লাগল।
রাজকুমার সিদ্ধার্থ এখন পূর্ণ কিশোর, শান্ত মূর্তি। রাজা শুদ্ধোধন পুত্রের শিক্ষার কথা ভাবতে লাগলেন। সর্বোচ্চ এবং সর্বপ্রকার শিক্ষার জন্য শাক্যরাজের পণ্ডিতপ্রধান বিশ্বামিত্রকে নিযুক্ত করলেন। পরে এক শুভদিনে পণ্ডিতপ্রধান বিশ্বামিত্র রাজকুমারকে রাজা শুদ্ধোধনের কাছে এনে বললেনÑ রাজমহাশয়, রাজকুমারের শিক্ষা শেষ। আমার কাছে তাঁকে দেওয়ার মতো কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। রাজকুমার দৈনিক শিক্ষায়তনেও মেধার বিকাশ ঘটালেন খুব অল্প সময়ে। তাঁর আর কোনো শিক্ষা বাকি নেই। সব বিদ্যায় পারদর্শী রাজকুমার।
এত কিছু রপ্ত করার পরও রাজকুমার চিন্তিত, নিঃসঙ্গ কিন্তু নিঃশঙ্ক। এ খবর খুব অল্প সময়ে চারদিকে প্রচার হয়ে গেল। রাজা শুদ্ধোধনও পুত্রের চিন্তায় বিভোর। তিনি জানতেন এমন কিছু ঘটবে। এ তার ভবিতব্য, কপাল লিখন। রাজা দেখলেন সিদ্ধার্থের বয়স যতই বাড়ছে তাঁর শরীর ততই হয়ে উঠছে তেজস্বান। কোনো একটা বিষয়ে বিশ্বাস আর ব্যাকুলতা তাঁর বাড়ছে। কিসের বিশ্বাস, কিসের ব্যাকুলতা! রাজা শুদ্ধোধন কিছুই অনুমান করতে পারছেন না।
রাজপুত্রের উদাসীনতা কাটাতে নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও রাজা সফলকাম হতে পারলেন না। একদিন তিনি রাজ্যে রথ প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন শুধু সিদ্ধার্থকে ফেরাতে। প্রতিযোগীরা হলেন- নন্দ, আনন্দ, দেবদত্ত এবং রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। ঘোষণা করা হলো- প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে তাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হবে।

যথারীতি প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। রথে ঘোড়া সংযোজন করল চার প্রতিযোগী। তারপর শুরু হলো যাত্রা। প্রথমে ধীর-মন্দগতিতে, পরে দ্রুত, আরও দ্রুত, ক্ষিপ্রগতিতে এবং সর্বশেষ উল্কাগতি। পলকে পলকে দৃশ্য পাল্টে যেতে লাগল। রাজকুমার চোখের পলকে শাক্যরাজ্য অতিক্রম করে চলে গেলেন। পেছনে, অনেক পেছনে নন্দ, আনন্দ এবং দেবদত্ত।
প্রতিযোগিতায় রাজকুমার সিদ্ধার্থ প্রথম হলেন। তাঁকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হলো রাজার ঘোষণা অনুযায়ী। এতে রাজার আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হলো। রাজপ্রাসাদের কুল ললনারা ও সমবেত জনতা আনন্দ ধ্বনিতে সিদ্ধার্থকে জয়মাল্যে ভূষিত করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলো। সিদ্ধার্থ জয়ী, প্রতিযোগিতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এ প্রতিযোগিতায় তাঁর কোনো আগ্রহ নেই, নেই কোনো আনন্দ। তবু এ কাজ কর্তব্যবোধেই তিনি করলেন, এ তাঁর কর্তব্য, পিতৃ আজ্ঞা পালন।
অতি সংক্ষেপে লেখলাম ত্রি-স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা। কুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে কঠোর সাধনা এবং তপস্যার মাধ্যমে যেদিন বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন সেদিনও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। বুদ্ধত্ব লাভের পর বৌদ্ধধর্ম প্রচার করে যেদিন তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন সেদিনও আজকের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। আসুন, সকলে জাতি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক কাতারে শামিল হয়ে অশান্ত এই বিশ্বে মানবকল্যাণের শপথ নিই। সকলের জীবন অনাবিল আনন্দে ভরে উঠুক। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
লেখক : সাংবাদিক

×