ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

হযরত দাউদ নবীর (আ.) বীরত্বগাথা

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪০, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

হযরত দাউদ নবীর (আ.) বীরত্বগাথা

প্রসঙ্গ ইসলাম

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ৯টি সূরাতে হযরত দাউদ নবী (আ.)- এর বর্ণনা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ১৬টি স্থানে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। কোনো কোনো সূরায় সংক্ষিপ্ত আর কোনো কোনো সূরায় বিস্তারিতভাবে তাঁর অবস্থার বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত দাউদের (আ.) বীরত্ব, সাহসিকতা এবং যুদ্ধ কৌশলের এক হৃদয়গ্রাহী ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। তিনি দুর্ধর্ষ ফিলিস্তিনি নেতা জালুতকে হত্যা করে বনী ইসরাঈলদেরকে এক ভয়াবহ বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং তা দ্বারা তিনি ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন।
দাউদ (আ.) ছিলেন বনী ইসরাঈলের মহাপরাক্রান্ত সম্রাট ও আল্লাহ্ তায়ালার অনুগ্রহধন্য মহান পয়গম্বর। তাঁর আগমনের পূর্বে ইসরাঈল জাতির শাসন ক্ষমতা ছিল এক গোত্রের হাতে এবং ধর্ম কর্ম ছিল অন্য গোত্রের ওপর ন্যস্ত। আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদকে (আ.) উভয় দায়িত্ব প্রদানপূর্বক সে-জাতির কাছে প্রেরণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে নবী, রাসূল ও বনী ইসরাঈলদের বাদশাহ। সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে- ‘আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বাদশাহী ও নবুওয়াত প্রদান করেছেন এবং তাঁকে যা ইচ্ছা শিক্ষা দিয়েছেন।’
এ মহান পয়গম্বর ইয়াহুদা বিন হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর। তাঁর পূর্ব পুরুষ ছিলেন বিখ্যাত নবী ইবরাহীম (আ.)। পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মাত্র ৫ মাইল দক্ষিণে বায়তুল লাহামে তাঁর জন্ম।-(তাওরাত)। তাঁরা ছিলেন ৮ ভাই। দাউদ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। পিতার নাম ছিল ঈসাস।
তাওরাতে এও বলা হয়েছে যে, সামুয়েল নবী ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে, সম্রাট তালুতের পর দাউদ নামের একজন লোক বাদশাহ হবেন। সুতরাং তিনি বায়তুল লাহামে গেলেন। ঈসাসের সমস্ত পুত্রদেরকে তিনি দেখলেন। দাউদ (আ.) ওই সময় ভেড়া চরাতে গিয়েছিলেন। তাঁকে বিশেষভাবে ডাকা হলো। যেহেতু আল্লাহর দেয়া খোশখবরী মতে তিনি হবেন একজন মহান বাদশাহ। সহীফায়ে সামুয়েলে লিপিবদ্ধ আছে যে, হযরত দাউদের শরীরের রং লালাভ এবং তিনি ছিলেন অত্যধিক সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী। (১৬/১-১৩)
ভাগ্যক্রমে এক সময় সম্রাট তালুতের এমন একজন লোকের প্রয়োজন হলো যিনি বাঁশি বাজাতে খুব পটু। তার কর্মচারীরা বহু খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে এ ক্ষেত্রে একজন বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে বায়তুল লাহামের ঈসাসের পুত্র দাউদের সন্ধান দিল। এ সঙ্গে তারা তাঁর অন্যান্য গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ ও বীরত্বেরও সংবাদ দেয়।
দাউদ (আ.) এবার তালুতের ¯েœহভাজন হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন। রাজদরবারেই তিনি থাকতেন। শুধু মাঝে মধ্যে এসে পিতাকে ভেড়া চরানোর কাজে সহযোগিতা করতেন। সম্ভবত ওই সময়েই হযরত দাউদ (আ.) স্বীয় ভেড়ার পালকে হিংস্র প্রাণী থেকে হিফাজতের জন্য তীর ধনুক চালনা শিক্ষা করেন এবং তাতে খুবই পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি একটি বাঘ ও চিতাকে মেরে ফেলেছিলাম।
একপর্যায়ে বনী ইসরাঈল ও পলেস্টীয়দের মধ্যে যুদ্ধ বাধল। এ এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বাদশাহ তালুত সৈন্যদল নিয়ে পলেস্টীয়দের মোকাবিলায় বের হলেন। পথিমধ্যে একটি গভীর নদী। প্রখর রোদের সময় ক্ষুধাতৃষ্ণা কাতর সৈন্যদলকে তালুত বাধ্যতা ও কষ্টসহিষ্ণুতার পরীক্ষা করার জন্য বললেন, যারা এ নদীর পানি পান করবে তারা আমাদের সঙ্গী হতে পারবে না, কিন্তু যারা পান না করবে তারাই আমার সঙ্গে জিহাদে যোগদানের সুযোগ পাবে।

এটা তিনি এ জন্য করেছিলেন যে, জালুতের ছিল বিশাল সৈন্যবাহিনী। আর এ বাহিনীকে পরাজিত করতে হলে প্রয়োজন ছিল ঈমানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সৈন্যদল। অবশ্য, ফলাফল তাই হয়েছিল। জালুত ও তার বিশাল বাহিনী পরাজিত হয়। (দ্র. আল কুরআন- বাকারা ২৫০,২৫১)।
সে সময় দাউদের তিন ভাই ছিলেন ইসরাঈলী সেনাদলে। দাউদের পিতা ঈসাস তাঁকে যুদ্ধের ময়দানে ভাইদের কুশলাদি জানার জন্য প্রেরণ করেন। এখানে তিনি প্রসঙ্গক্রমে ভাইদের কাছে জানতে পারেন যে, দুর্ধর্ষ জালুত এখন স্বয়ং মাঠে তার মোকাবিলার জন্য ইসরাঈলীদের উদ্দেশে হুংকার ছাড়ছে। কিন্তু কেউ তার সামনে এগোবার সাহস পাচ্ছে না। হযরত দাউদ আরও জানতে পারেন যে, জালুতরা সম্মানিত ইসরাঈল জাতিকে অপমানিত ও অপছন্দ করার জন্য এ যুদ্ধের আয়োজন করেছে। সুতরাং এ অবস্থায় কেউ যদি সাহসিকতার সঙ্গে তাকে হত্যা করতে সমর্থ হয়, তাকে বাদশাহ তালুতের পক্ষ থেকে অঢেল সম্পত্তি, ধন-রত্ন দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে। বাদশাহ আরও অঙ্গীকার করেন যে, তিনি স্বীয় কন্যাকে তার সঙ্গে বিবাহ দেবেন।
সুতরাং হযরত দাউদ (আ.) হকের ইজ্জত রক্ষার্থে জালিমদের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সংবাদ বাদশাহ তালুতের কাছে পৌঁছল। তিনি দাউদকে বললেন- তুমি জালুতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সক্ষম নও। তুমি তো একজন বালক মাত্র। আর জালুত কৈশোর থেকে যুদ্ধবাজ। উত্তরে দাউদ আরজ করলেন- আমি এক সময় একাই বাঘ মেরেছি। যে আল্লাহ আমাকে বাঘের পাঞ্জা থেকে রক্ষা করেছেন সে আল্লাহই এ পলেস্টীয়দের হাত থেকে রক্ষা করবেন।
হযরত দাউদ (আ.) তাঁর সংকল্পে অটল রইলেন। অগত্যা তালুত তাঁকে তলোয়ার, বল্লম ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র প্রদান করলেন। দাউদ কিন্তু এসব অস্ত্র পরিচালনায় অভ্যস্ত ছিলেন না বিধায় সব খুলে রেখে দিলেন। একজন সাধারণ মেষ পালকের ন্যায় তিনি একটি লাঠি ও ঝুলি তুলে নেন এবং জালুতের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। জালুত নিয়মমাফিক যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের ময়দানে এসেছে। সামনে রয়েছে দেহরক্ষী বাহিনী।

দাউদের প্রতি তার দৃষ্টি গেলে সে উপহাসের হাসি হাসল এবং দাউদ নবীর লাঠির দিকে ইঙ্গিত করে বলল- আমি কি কুকুর যে, লাঠি নিয়ে আমার কাছে এসেছ? জালুত আরও বিভিন্ন ভাষায় দাউদকে ভর্ৎসনা করল।
দাউদ (আ.) বললেন, তুমি তো তলোয়ার ও বল্লম নিয়ে আমার কাছে এসেছ এ খেয়াল করে যে, এ শক্তি দ্বারা আমাকে শেষ করবে। তোমার স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, আলাহ তায়ালা শুধু তলোয়ার, বল্লম, নেজা অথবা অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের মাধ্যমে জয়যুক্ত করেন না, বরং সদাসর্বদা তাঁর অসীম রহমত ও দয়া দ্বারা সত্যকে সাহায্য করে থাকেন।      (চলবে)

লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]

×