ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আঞ্চলিক ও পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:২৪, ২৯ নভেম্বর ২০২২

আঞ্চলিক ও পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন

বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা যায় না

বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা যায় না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক যে প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বাস্তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ থেকে দূরে রয়েছে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী  দেশগুলো নিয়ে ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করা বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি- সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন বা বিমসটেক আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। কেবল নামেই এই সংগঠন নয়, বরং একটি কার্যকর আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠছে। এই সাত জাতি সংস্থার স্থায়ী সচিবালয় ঢাকায় হওয়ার কারণে এই সংস্থা নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ বেশি।

অন্যদিকে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস উদীয়মান জাতীয় অর্থনীতির একটি সংস্থা। অন্তর্ভুক্ত সব রাষ্ট্র উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত। কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব। পাঁচটি রাষ্ট্রই আবার জি-২০ এর সদস্য। ব্রিকসের পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ। সম্মিলিত জিডিপি ষোলো দশমিক শূন্য ঊনচল্লিশ ট্রিলিয়ন। যা মোট বিশ্বপণ্যের প্রায় ২০ শতাংশের সমতুল্য এবং মার্কিন মিলিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের আনুমানিক চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভুটান ও নেপালের সমন্বয়ে গঠিত বিমসটেক অঞ্চলে দেড় শ’ কোটি মানুষের বসবাস, যা বিশ্ব জনসংখ্যার কুড়ি শতাংশ। অথচ বিশ্বের সম্পদ  ভোগের ক্ষেত্রে এরা অনেক পিছিয়ে। কাজেই এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে নিজেদেরই সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে সদস্য দেশগুলো। এমনিতে সহযোগিতার জন্য  চৌদ্দটি ক্ষেত্রে চিহ্নিত রয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার  ক্ষেত্রে দেশগুলোর বর্তমান আগ্রহ অব্যাহত থাকলে বিমসটেকের বাস্তব অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে বলে ধারণা করা যায়।
ব্রিকস-বিমসটেক যুগলবন্দীর প্রকাশ্য ও ঘোষিত লক্ষ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সার্বিক সহযোগিতা। পাশাপাশি জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার অঙ্গীকারও রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এ দুটি সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা জরুরি। জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাও সামনে এসেছে। তাই এই দেশগুলোর মেলবন্ধন জরুরি। আরব সাগরের তীরে ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত দুটি সংস্থার সম্মেলনে  টেকসই উন্নয়নে শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দুটি সংস্থারই সদস্য ভারত ও চীন।

এ জন্য কানেক্টিভিটি, আঞ্চলিক-উপআঞ্চলিক সহযোগিতা এবং তার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করার জন্য দুটি সংস্থা একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। ফলে এসব দেশের মধ্যে সংযোগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তেমনি অর্থনৈতিক, কারিগরি ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, এটা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। দুটি সংস্থার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হলে লাভবান হবে বাংলাদেশও।

তাই তিনি সহযোগিতার জন্য পারস্পরিক সম্ভাব্যতা ও যৌথ কর্মপন্থা নির্ধারণের কথা বলেছেন এবং পরামর্শও দিয়েছেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নে এ দুটি সংস্থা আরও সক্রিয় হলে এ অঞ্চলের জনগণ অগ্রগতির  সোপানে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সংস্থাদুটোর  নেতৃবৃন্দ জনগণের সেই আকাক্সক্ষা পূরণে এগিয়ে আসবেন বলে প্রত্যাশা।
 উনিশ শ’ বিরানব্বই সালে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ‘দ্য এন্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বইয়ে হেগেলের ভবিষ্যদ্বাণীকে বিজয়ী ঘোষণা করে বলেছিলেন, পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রই হচ্ছে সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ। বর্তমান সভ্যতা সেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষের এখন সুখের দিন শুরু হলো। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়ার জোর প্রচারে ফুকুয়ামার তত্ত্ব যতই ঝড় তুলুক, বাস্তবে  দেখা গেল ‘উদার নৈতিক গণতন্ত্রের’ স্বর্গরাজ্যে বেশিরভাগ মানুষের জীবনে সুখের নহর বইছে না।

একটা বিকল্প ব্যবস্থা অনুসন্ধান তারা করেই চলল। এবং দু’হাজার আট থেকে চৌদ্দর অর্থনৈতিক মন্দা সেই বিকল্প হিসেবে যে কোনো ফর্মে বৈষম্যহীন সমাজকেই বার বার তাদের মননে ও মগজে মূর্ত করেছে। একে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজির পক্ষে। তাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্করা থেকে  থেকে তাই এমন সব ‘তত্ত্ব’ হাজির করে যা শুনলে হঠাৎ মনে হয় এরা বুঝি পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলছে। তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছে। কিন্তু বিভ্রান্তি কাটিয়ে স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে তাকালে দেখা যাবে এর পুরোটাই অন্তঃসারশূন্য। ধূর্ততায় ভরা কিছু অর্থহীন কথামালার সমষ্টি।
বিভিন্ন সময় এসব তত্ত্ব আসে, বিভিন্ন ফর্মে। ধাপে ধাপে। কখনো সমান্তরালভাবে। সহস্রাব্দের প্রথমদিকে ‘ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম’ নামে একটি প্ল্যাটফরম আন্তর্জাতিকভাবে গলা চড়িয়ে ‘বিকল্প নতুন বিশ্ব’ গড়ার আওয়াজ তুলে তৃতীয় ধারা বা বিকল্প পৃথিবী গড়ার কথা বলেছিল। নয়া উদারনীতিবাদী বিশ্বায়নের বিপরীতে সংহতির অখ- বিশ্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো সংস্থাগুলোর শান্তিপূর্ণ বিরোধিতা করে সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য সমালোচনা ও সুপরামর্শ দেওয়া এদের লক্ষ্য। উল্লিখিত সংস্থাগুলোর শান্তিপূর্ণ বিরোধিতা করে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রতিপক্ষ এরা কিভাবে হবে তা সহজে বোধগম্য নয়।
বড় পুঁজির আক্রমণ থেকে ছোট পুঁজিকে রক্ষা করতে রাষ্ট্র যে ভূমিকা নিত ফিন্যান্স পুঁজিকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে রাষ্ট্র তা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এতে হস্তশিল্পী, মৎসজীবী, কারিগরদের মতো ছোট উৎপাদকেরা বড় পুঁজির গ্রাসে চলে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিকরা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ‘শ্রমবাজারের নমনীয়তা’ কেড়ে নেওয়া শ্রমিকদের দুর্বল হয়ে পড়ার আরেক কারণ। এ ব্যবস্থায় শ্রমিকরা ন্যূনতম যে সুরক্ষা পেত শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে তা কেড়ে নেওয়া হয়। এতে শ্রমিকদের গঠনগত পরিবর্তনসহ শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা কমে গেছে।

একদিকে করপোরেট ফিন্যান্সিয়াল অভিজাতদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়েছে, অন্যদিকে শ্রমিক কৃষকরা উৎপাদন থেকে ক্রমশ সরতে সরতে ব্যাপক দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগে পারস্পরিক সম্পর্কের ভারসাম্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার রাজনৈতিক দলও দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ শূন্যস্থানে পপুলিস্ট নামের ভেকধারীরা অনায়াসে জায়গা করে নেয়।
পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশগুলোতেও চাকরি হারাচ্ছে অনেক মানুষ। সম্পদের বৃহত্তর অংশ করপোরেশন আর ধনীদের দখলে। ‘আমরাই নিরানব্বই’ শতাংশের জীবনমান অব্যাহত খারাপের দিকে। নেতারা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ দেখতে পারছেন না।

×