প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদের বেশিরভাগের জীবন আবর্তিত হয় প্রচণ্ড অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায়
শোনা যায়, একবার নাকি পাশ্চাত্যের এক পশু মনস্তত্ত্ববিদ এসেছিলেন এদেশের মানব শিশুদের ওপর শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা করতে। এখন অবশ্য দেশেই প্রচুর বিশেষজ্ঞ আছেন। যারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে নতুন নতুন নিরীক্ষা করছেন। নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন। এক পদ্ধতি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চালু করলেন- কয়েক বছর চলল। তারপর আরেক দল আরেক পদ্ধতি আবিষ্কার করে চালালেন আরও কয়েক বছর। দেখা গেল এ পদ্ধতি তেমন ফল দিচ্ছে না সুতরাং আবার বদল। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। বলার অপেক্ষা রাখে না এর সঙ্গে রাজনৈতিক ওঠানামা বা ক্ষমতা বদলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এত গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এত অর্থব্যয়ের পরও ঝরে পড়া বন্ধ হয়নি।
তার কারণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা পড়ে তাদের বেশিরভাগের জীবন আবর্তিত হয় প্রচ- অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায়। ঝরে পড়া এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এদের জীবনের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার স্থায়ী সমাধানের কথা দেশী-বিদেশী কোনো গবেষকই বলেন না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর না করে ঝরে পড়া সম্পর্কে যত সদুপদেশ দেওয়া হোক, কাজের কাজ কিছুই হবে না।
ঝরে পড়াকে সেøাগান করে বছর কয়েক আগে শুরু হয়েছিল জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ। সেই দিন একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন জানিয়েছিল, প্রাথমিক স্তরে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ শিক্ষার্থী ভালোভাবে শিখছে না। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বাংলাই ভালোভাবে পড়তে পারে না, গণিত ও ইংরেজির অবস্থা আরও খারাপ। পঞ্চম শ্রেণির শতকরা মাত্র পঁচিশ ভাগ শিশু বাংলায় এবং তেত্রিশ ভাগ গণিতে আশানুরূপ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে।
যার অর্থ শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ও সাতষট্টি ভাগ শিশু আশানুরূপ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। এর চেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো এরপরও এসব শিশুর অনেকে ওপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের শিক্ষাবিষয়ক পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, যেসব শিক্ষার্থীর শেখার মাত্রা খারাপ, তাদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করেই ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি। ঝরে পড়ার পর এক পর্যায়ে তারা অনানুষ্ঠানিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে।
কেন তারা ঝরে পড়ে অনানুষ্ঠানিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে? সেøাগানটি ছিল ‘শিক্ষাই জীবনের মূল, ঝরে পড়া বিরাট ভুল।’ কার ভুল? বক্তব্যের ধরনে মনে হয়েছে শিক্ষার্থীর। বিদ্যাশিক্ষার গুরুত্ব না বুঝে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় ছেড়ে মাঠে গিয়ে কৃষক বাবা, রাস্তায় গিয়ে দিনমজুর বা শ্রমিক বাবার সঙ্গে কাজ করছে। ঝরে পড়া বা ড্রপআউট নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান গবেষণা ইত্যাদি হয়েছে। সে সবের জন্য বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকাও এসেছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য উনিশ শতকে সেই যে ব্যাবিংটন মেকলে বাঙালি শিক্ষিত ভদ্রলোকের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন, হুবহু সে অনুযায়ী আজও চলছে শিক্ষিত ভদ্রলোকের সমাজ। যারা গণমানুষ থেকে নিজেদের সব সময় বিচ্ছিন্ন মনে করে। ঔপনিবেশিক কূটবুদ্ধি খাটিয়ে এই শিক্ষিত এলিট শ্রেণির হাতে নিম্নবিত্তের শিক্ষার ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন মেকলে। কিন্তু শিক্ষায় জ্ঞান গরিমায় বিকশিত হয়ে নিজেদের যারা দেশের ব্যাপক অধিকাংশ মানুষ থেকে উন্নত জাতের মানুষ ভাবে, তারা তাচ্ছিল্য ভরে সে দায়িত্ব প্রত্যাখ্যান করে। যাদের দেখে নাক সিটকে দশ হাত দূরে থাকে, তাদের শিক্ষিত করা এদের পক্ষে সম্ভব নয় জেনেই মেকলে এ দায়িত্ব ওই শিক্ষিত এলিটদের ওপর দিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকিত হয়ে সাহিত্য দর্শন ইতিহাস ইত্যাদি চর্চায় উৎসাহিত হয়ে সমাজে আলোড়ন তুললেও যারা জাতীয় বুর্জোয়ার চরিত্র অর্জন করতে পারেনি, চরিত্রের এ রূপান্তর ঘটলে তারা নিজেদের উন্নয়নকে গোটা জাতির উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত করে ভাবতে পারত। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর সেখানকার বুর্জোয়ারা যেমন পেরেছিল। আমাদের এখানকার এলিট শ্রেণির জন্ম সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। ঔপনিবেশিক প্রভুর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় হয়েছিল। চিরকাল তারা প্রভুভক্ত থেকেছে। সেই যে ব্রেনওয়াশ হয়েছিল তা থেকে বেরোনো সম্ভব হয়নি আজও। বিচ্ছিন্নতার সেই ধারাটি এখনো সমান বহমান।
একটি বুর্জোয়া সমাজ কাঠামো গঠনের জন্য যতটুকু দক্ষতা, প্রজ্ঞা, শিক্ষা ও উদারতার প্রয়োজন তা আজও অর্জিত হলো না। ভিন্ন ফর্মে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাই চলছে। একদিকে উচ্চ শিক্ষার লাভজনক ব্যবসার রোশনাইয়ে চোখ ঝলসে যায়, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থার ভিত তলিয়ে আছে গভীর অন্ধকারে। বদ্ধ ডোবার মতো অবস্থা তার। মাঝে মাঝে নিরীক্ষার ঢিল পড়ে সামান্য ঢেউ ওঠে। দ্রুতই তা মিলিয়ে যায়। তারপর আবার ঘোর অন্ধকার। এমন অদ্ভুত এক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি দেশের পক্ষে কতটুকু এগুনো সম্ভব? অল্প মানুষ যাদের হাতে প্রচুর টাকা, তারা তা দিয়ে সন্তানের জন্য শিক্ষা কিনছেন। তারা জনসংখ্যার কতভাগ? হয়ত দশভাগ কিংবা আরেকটু বেশি। কিন্তু বাকি বিশাল জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ কি।
শুরুতে যে প্রতিবেদনের উল্লেখ করেছি সেখানে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, কী করে শিখছে এবং সামগ্রিকভাবে কতটুকু বুঝতে পারছে, তা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন শিক্ষকরা। এ শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। তারা বাঁধা ধরা পদ্ধতিকে মুখস্থ পড়ান। পড়ানোর বিষয়ে তাদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা শিক্ষার্থীদের শেখার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ধরনের গবেষণা অতীতে অনেক হয়েছে। সত্যি বলতে এতে নতুন কোনো তথ্য উঠে আসে না।
সমাজে বৈষম্য যে কত প্রকট প্রাথমিক অবস্থার চিত্র তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। শুধু এখন নয়। সমাজের নিচুতলার মানুষদের জন্য শিক্ষা সব সময়ই কষ্টকল্পিত ছিল। এক সময় বর্ণ প্রথার কঠিন অনুশাসনে সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ শূদ্ররা শিক্ষা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ভারতীয় গুরুমুখী বিদ্যার বৈশিষ্ট্য হলো শুনে শেখা। গুরুর কাছে শুনে শিষ্য বেদ মুখস্থ করত। গুরু পরম্পরায় এ বিদ্যা টিকে থাকত। গুরুমুখী বিদ্যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল শিক্ষার অধিকার সীমাবদ্ধ রাখা। পাঠদানের লিখিত পদ্ধতি বা বই না থাকায় শূদ্ররা লুকিয়েও এ শিক্ষা নিতে পারত না।
প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থা এ চাতুরী করেছিল শোষণ প্রক্রিয়াকে সুসংহত রাখার জন্য। কিন্তু বেদ পাঠে অধিকার না পেলেও শূদ্রদের শিক্ষালাভের অধিকার শেষ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে এখন বর্ণবৈষম্য না থাকলেও সব বৈষম্যের সেরা শ্রেণি বৈষম্য প্রকটই আছে। একে ভেঙে ফেলা চটজলদির কাজ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন সযত্নে টিকিয়ে রাখে যে সমাজব্যবস্থা, সে সমাজের নিচের তলার মানুষদের জীবন আলোকিত করা সম্ভব কেবল ওই বৈষম্য দূর করার মধ্য দিয়েই। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে পারলে অন্যান্য অনিশ্চয়তাও দূর হবে। অন্ন সংস্থানের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারলে মনোযোগের পুরোটাই শিক্ষা অর্জনের পিছনে ব্যয় হবে। ঝরে পড়া তখন নিজ থেকেই বন্ধ হবে। সমস্যার আসল কারণ দূর না করে যত গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হোক কাজ কিছুই হয় না।
রাষ্ট্র এবং সমাজের বৈষম্য রাতারাতি দূর করতে না পারলেও একে অন্তত সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। সে চেষ্টা আন্তরিকভাবে করলেই কেবল ওই বঞ্চিতদের জীবনমানের খানিক উন্নতি আশা করা যায়। নইলে যত সুন্দর বাক্য বিন্যাসই করা হোক, এদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না।