ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আমার মা

শাহদাব আকবর

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৩ অক্টোবর ২০২২

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আমার মা

বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী

বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন। ১৯৫৬ সালে তার রাজনীতির শুরু চট্টগ্রামে। ষাট বছরের অধিক সময় রাজনীতির মাঠে সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শবান রাজনীতিক হিসেবে তিনি সকলের কাছে পরিচিত। রাজনীতি ছিল তার রক্তে বহমান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় আমার মার দাদা সৈয়দ সাজ্জাদ মোজাফ্ফর এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসকে একই সঙ্গে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে বরিশাল শহরে ঘোরানো হয় এবং প্রবল গণদাবির মুখে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।

একেবারে ছোট বেলা নানির কাছে কেটে যায় তার। পড়াশোনায় হাতেখড়ি মামা বাড়িতেই হয়। পরবর্তী সময়ে বাবা-মার সঙ্গে চার ভাইবোন কলকাতা চলে যান এবং সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়া অবস্থায় মাত্র আট বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মা’র মৃত্যুর পর কলকাতায় বড় ফুফুর বাসায় চলে যান। বড় ফুফু কবি সৈয়দা মোতাহেরা বানু স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত প্রথম মুসলিম মহিলা কবি। তার মেজো আপার আপন ফুফাত বোন তাহমিনা বানু ¯েœহ-ভালবাসা দিয়ে মাকে লালনপালন করেন। স্কুলে যাওয়ার সময় চুল বেঁধে দিতেন।

মেজো আপা পাস করেছিলেন শান্তি-নিকেতন থেকে। তার কাছ থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি মা অনুপ্রাণিত হন। স্কুলজীবন কাটে কলকাতায়। মা বলতেন, গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ ঘাটে স্টিমারে চড়ে আসতেন। মায়ের মুখে শুনেছি, ছোট্টবেলায় তিনি খুব ডানপিটে ছিলেন। সবিশেষ উল্লেখ্য, তার দাদি ও ফুফুরা সংস্কৃতিমনা ছিলেন।
বাবা-মায়ের সংসার ছিল অত্যন্ত সুখের। আমাদের বাসায় রাজনীতির ফাঁকে প্রায়ই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান-কবিতা-গল্প ছিল তার অন্তরজুড়ে। তিনি নিজেও গান গাইতেন এবং আমার ভাই সাজেদ আকবর ও বোন শামা রহমান মায়ের অনুপ্রেরণায় আজ প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী।
দেশ বিভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে মা ফিরে আসেন। পঞ্চাশ দশকের দিকে তিনি তার ছোট ফুফুর কাছে চট্টগ্রামে চলে যান। চট্টগ্রামে থাকাকালীন অবস্থায় ১৯৫৪ সালে ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্ল্যানিং সেলের অবৈতনিক সদস্য মরহুম গোলাম আকবর চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম লায়ন্স ক্লাব গঠন করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মা চট্টগ্রামে বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকা-ে যুক্ত ছিলেন। সে সময় অল পাকিস্তান ওমেন্স এ্যাসোসিয়েশনের চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। যা বর্তমানে মহিলা সমিতি হিসেবে পরিচিত।
তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ১৯৬৬ সালে ঢাকা চলে আসেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৭০ সালে জাতীয় সংসদে এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের অধীনে কলকাতায় গোবরা নার্সিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেনিংপ্রাপ্ত নার্সরা যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৬ এ তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেন। সে সময় তিনি জাতীয় মহিলা লীগের দায়িত্ব পান। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করার পর সিনিয়র আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকেই খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। অনেকে গ্রেফতার বরণ করেন। আওয়ামী লীগের সেই ক্রান্তিকালে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দলের হাল ধরেন। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান যখন ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেয়, তখন আমার মা আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনৈতিক দল পরিচালনার জন্য আবেদন করেন এবং অনুমোদন পান। আওয়ামী লীগের রাজনীতি অব্যাহত রাখতে সফল হন তিনি।

১৯৭৬-এর নবেম্বর মাসে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ এক বছর কারাবরণ করেন। কোন রক্তচক্ষু তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্টের নির্দেশে তাকে তৎকালীন সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী যখন আওয়ামী লীগ দখল নেয়ার অপচেষ্টা চালান, তখন সাজেদা চৌধুরীর বাধার মুখে তা ব্যর্থ হয়। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কা-ারি হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করার ক্ষেত্রে আমার মা এবং বাবা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই মানুষটি এক মুহূর্তের জন্যও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। দেশরতœ শেখ হাসিনার প্রতি তার আনুগত্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল অটল। ছায়ার মতো সকল বাধা বিপদ থেকে আমার মা দেশরতœ শেখ হাসিনাকে আগলে রেখেছিলেন। ১৯৯০ এ এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে ছিলেন রাজপথজুড়ে। ২০১৭ সালে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্ভীক সাজেদা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। তার স্লোগান ছিল- ‘ঘঙ ঐঅঝওঘঅ ঘঙ ঊখঊঈঞওঙঘ’
তিনি ১৯৭৩, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একটানা তিনবার সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ এর সম্মেলন পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় তিনি নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালক, মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও বাংলাদেশ গার্লস গাইডের ন্যাশনাল কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তার নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার জন্য ১৯৭৪ সালে সিলভার এলিফ্যান্ট এওয়ার্ড, ইউনেস্কো ফেলোশিপ এবং ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউটের বর্ষসেরা মহিলা-২০০০ এওয়ার্ড এবং ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১নং প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন।
মা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রশ্নে ইস্পাতদৃঢ় কঠিন, ঠিক তেমনি তুষারের মতো কোমল মনের মানুষ। মা-বাবার স্নেহ ভালবাসার মধ্য দিয়েই আমরা বড় হয়েছি। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নেই। কিন্তু হাজারো নেতাকর্মী, আত্মীয়-স্বজন ও বাংলাদেশের জনগণের মাঝে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তিনি রেখে গেছেন তার আদর্শ, মানুষের প্রতি তার ভালবাসা। আমরা হারিয়েছি আমাদের মাকে আর বাংলাদেশের মানুষ হারিয়েছে অনন্য সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা এই মানুষটিকে।
লেখক : সদ্যপ্রয়াত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

×