ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শারদোৎসব

সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২ অক্টোবর ২০২২

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শারদোৎসব

,

বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র আবহমান কাল ধরে শারদ উৎসবের প্রভাবমুক্ত নয়। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা থেকে বর্তমানে রাজ চক্রবর্তীর সিনেমা পর্যন্ত দুর্গাপূজা একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। যে কোন সময় ঢাকের আওয়াজ শুনলেই বাঙালীর মন আকুল-ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মহালয়াতে মায়ের আগমন ঘটে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মন্ত্রোচ্চারণ দিয়ে। এই অনুভূতি ধর্মনিরপেক্ষ আপামর বাঙালীর চেতনা সত্তায় বিলীন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দুর্গাপূজা চিত্রায়িত হয়েছে খুব কম। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে সদ্য মা হারানো ছেলের কাছে দেবী দুর্গা হয়ে এসেছেন তার মা। বাদল খন্দকারের বিদ্রোহী পদ্মা, গাজী জাহাঙ্গীরের জীবন সীমান্তে, মহিউদ্দিন ফারুকের বিরাজ বউ চলচ্চিত্রে দৃশ্যের প্রয়োজনে এসেছে দুর্গাপূজা। গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝি ছবিতে দেখা যায় ঝড়ের বিধ্বংসী রূপ। মাঝিপাড়ার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে। সেইসব ভাঙা ঘরবাড়ি সম্মিলিত উদ্যোগে ঠিক করতে যখন ব্যস্ত জেলেপাড়ার বাসিন্দারা, ঠিক তখনই মহোৎসবের স্নান এক ছায়া হয়ে আসে দুর্গাপূজা। তানভীর মোকাম্মেলের চিত্রা নদীর পাড়ে চলচ্চিত্রে দুর্গাপূজা এসেছে একটি প্রতীকী দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। যেখানে নদীতে ভেসে থাকা ধর্ষিতা বাসন্তী যেন অসুর শক্তির জয় আর সত্য সুন্দরের পরাজয়ের প্রতীক। বাবুল চৌধুরীর মা ছবিতে গল্পের প্রয়োজনে এসেছে পূজা।
কলকাতার বাংলা ছবিতে দুর্গাপূজার চিত্রায়ণ প্রথম করেন সত্যজিৎ রায়। পথের পাঁচালী ছবিতে দেখা যায় ঢাকের তালে অপু, দুর্গাসহ শিশুর দল মন্দিরের দিকে যাচ্ছে প্রসাদের আশায়, আর তা চেয়ে দেখছেন মা সর্বজয়া। গল্পের প্রয়োজনে ‘দেবী’ চলচ্চিত্রেও এসেছিল পূজা। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ এর শুরুর দৃশ্যায়ন দুর্গাপূজা নিয়েই। শিশু রুকু প্রতিমার কারিগরের কাছে শুনছে অসুরবধের কাহিনী। এ যেন সব শিশু-কিশোরের কাছে পরম রোমাঞ্চকর। একটি ক্ষয়িষ্ণু বনেদী পরিবারের দুর্গাপূজার উৎসবের মাঝে পরিবারের গল্প তুলে ধরেছিলেন চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষ। পুরো ছবিটি জুড়েই ছিল পূজার আবহ। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণা, মমতা শংকরসহ আরও অনেকে। ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম সিনেমা হীরের আংটি, অন্দরমহল ছবিতেও দুর্গাপূজা এসেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে তরুণ মজুমদারের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘আলো’তে দুর্গাপূজা এসেছে অভাবতাড়িত গ্রামে আলোকবর্তিকা হয়ে। এই পরিচালকের পলাতক, বালিকা বধূ, দাদার কীর্তি, ভালবাসা ভালবাসা চলচ্চিত্রেও দুর্গাপূজার বিষয়টি এসেছে। রাজা সেনের ‘দেবীপক্ষ’ ছবিতে দুর্গাপূজা এসেছে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। শিবু-নন্দিতার ‘বেলাশেষে’ ছবিতে পূজা এসেছে পারিবারিক সম্প্রীতি হয়ে। বিজয়া দশমীর সাদা থান লাল শাড়ি পরে বাঙালী নারীর সিঁদুরখেলা চিরাচরিত ঐতিহ্য। অপর্ণা সেনের ‘পরমা’ ছবিতে রাখী গুলজারের দেবী দুর্গাকে সিঁদুর পড়ানোর এমন দৃশ্য আইকনিক হয়ে আছে।
শরতকালে দুর্গাপূজা অকালবোধন নামে পরিচিত। তবে শরত ঋতু বাদেও অন্য সময়ে দুর্গাপূজা এসেছে সৃজিত মুখার্জীর বিকল্প ধারা ছবি উমাতে। বিদেশে থাকা অসুস্থ মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে কলকাতায় নকল দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন বাবা। বিভিন্ন উৎসবে ছবিটি বেশ প্রশংসিত হয়। ‘জাতিস্মর’ ছবিতে দুর্গাপূজা করেছিলেন কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গি। অরিন্দম শীলের ‘দুর্গাসহায়’ ছবিটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে, খুশিতে নাচে মন’- এমন গান ছাড়া যেন দুর্গাপূজা আজকাল জমে উঠে না। রবি কিনাগী পরিচালিত দেব অভিনীত ‘পরান যায় জ্বলিয়া রে’ ছবিতে দুর্গাপূজা উপলক্ষে এই গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এর পরে দেবের পূজায় মুক্তি পাওয়া সিনেমায় পূজার গান থাকতই। সাড়া জাগানো ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’ এ এসেছে এক বনেদী বাড়ির দুর্গাপূজার সঙ্গে গুপ্তধনের খোঁজ দুই মিলিয়ে ছবি হয়ে উঠেছিল জমজমাট। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বিসর্জন’ ছবিতেও আছে দুর্গাপূজার গল্প, আছে বিসর্জনের আবহ। আর এই ছবিতে পদ্মা চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন অভিনেত্রী জয়া আহসান। ‘শরতে নয়, শীতে’ এই শিরোনাম নিয়ে হয়েছে জিত অভিনীত ‘অসুর’।

গল্পের প্রয়োজনে অনেক ছবিতেই দুর্গাপূজার চিত্রায়ণ দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যেও দুর্গাপূজা উঠে এসেছে বিভিন্ন রচনায়। দেবী দুর্গা সেখানে কখনও মাতৃরূপে, কখনও শক্তি রূপে, আবার কখনও বা দেখা হয়েছে কেবল আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ‘পুতুল পূজা কর না হিন্দু, কাঠ মাটির দিয়ে গড়া। মৃণ্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, যাই আত্মহারা’ রবীন্দ্রনাথ দেবী দুর্গাকে আনন্দময়ী হিসেবে অভিহিত করে আরাধনা করেছেন মুক্তি ও ভক্তির সঙ্গে। রবীন্দ্র কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটকে এমনকি চিঠিপত্রে উজ্জ্বল আনন্দময় দুর্গোৎসবের অপরূপ বর্ণনা ফুটে উঠেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে বিমলা, সন্দ্বীপ ও নিখিলেশ চরিত্রগুলো দেবী দুর্গার সর্বজনীন সমন্বিতা রূপবৈচিত্র্যপূর্ণ করে সাজিয়েছেন। অন্যদিকে অপূর্ণতা, বিচ্ছিন্নতা, অখ-তাকে মুক্তির পরিপূর্ণ তাৎপর্যে নিপুণভাবে সাহিত্যে প্রবেশ করিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেবী দুর্গাকে নজরুল দেখেছেন, ‘রক্তাম্বরধারিণী রূপে’। গান, কবিতা, উপন্যাস, ছায়াবাণী ছাড়াও প্রীতি, সৌহার্দ্য, সম্ভাষণে শাক্ত পদাবলি রচনা করে মহাকালজয়ী হয়েছেন কবিরা।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মাইকেল মধুসূদনের কালজয়ী সৃষ্টি। এখানে তিনি দেবী দুর্গাকে কল্পনা করেছেন ‘শশাঙ্কধারিণী রূপে’। বক্ষ বিদীর্ণ করা কিছু ‘সনেট’ রামায়ণ মহাকাব্যকে দুর্গোৎসবের পরিপূর্ণ প্রয়োজন রূপে রূপায়িত করেছেন মধুসূদন। দেবী বিসর্জন ট্র্যাজেডির এক অসাধারণ বর্ণনা দিয়ে মেঘনাদবধ কাব্যকে সমাপ্ত করেছেন তিনি। ‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে, সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।’ বাংলা সাহিত্যের আরেক নবরূপকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জ্যোতির্ময়ী দেবী দুর্গার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারেননি তিনি। পার্বতী এবং দুর্গা নামে কোমল, কঠিন ও মমতাময়ী আবেগপ্রবণ হৃদয়স্পর্শী চরিত্রায়ণ করে আরাধনায় রূপান্তরিত করেছেন সাহিত্য সৃষ্টিকে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার সাহিত্য সৃষ্টিকর্মে দেবী দুর্গার মাতৃমুখী সংস্কৃতি লাবণ্যে অপূর্ব বর্ণনায় আশ্চর্যজনক অভিব্যক্তি সৃষ্টিতে দেখিয়েছেন পারদর্শিতা। দেবী দুর্গাশক্তির সর্বজয়া উত্থানে কৌতূহল ও উৎসাহ সৃষ্টির অনুভূতি প্রভাব বৈরিতার অবসান ঘটিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার চিরায়ত সাহিত্যকর্মে। অপু-দুর্গা, সতু, মালতী, হরিহর, ইন্দির ঠাকুরণ চরিত্রগুলোর শরতের শুভ্র শীতল কোমল ব্রহ্মশক্তির পরিপূর্ণ আরাধনাকে দারিদ্র্য মুক্তির অবলম্বন হিসেবে প্রকাশ করেছেন বিভূতিভূষণ।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী

 

×