ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনের চিঠি

শীতরাত্রির ভাবনা

সাগর রহমান

প্রকাশিত: ২১:০৭, ১ অক্টোবর ২০২২

শীতরাত্রির ভাবনা

লন্ডনের চিঠি

প্রকৃতিতে শীতের আগমনকে বর্ণনা করতে বাংলা ভাষায় ‘গুটি গুটি পায়ে চলা’র উপমাটি বহুল ব্যবহৃত। যেন বাংলাদেশে শীত আসা মানে নীরবে, সন্তর্পণে, লাজুক পা ফেলে, দ্বিধায় থরো থরো হতে হতে, ধীরে ধীরে আসা। কিন্তু লন্ডনের শীতের পায়ে অত জড়তা নেই। লন্ডনের শীত মানে যেন ঘাড়ের ওপর ঝুলতে থাকা খড়গ, যেন সারাবছর ওঁৎ পেতেই থাকে কখন লাফিয়ে নামা যায় জনজীবনে।

সকালে হয়ত উদীয়মান রাঙা সূর্যকে দেখে বেশ আয়েশ করে সামার-সাজে ঘর থেকে বেরুলেন, খুব সম্ভাবনা আছে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরবেন থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে যুক্তরাজ্যের আবহাওয়ার অনিশ্চয়তাকে বকাবকি করতে করতে। যদিও কাগজে-কলমে এখানে এখন অটাম, মানে শরত, গায়ের চামড়া বলছে প্রায় শীতকাল। অর্থাৎ আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার ব্যাপার-স্যাপার নেই আর এখন। মোবাইল এ্যাপ কিংবা টিভির সংবাদ না শুনেই অনুভব করা যায় আকাশে-বাতাসে শীতের রাজত্ব শুরু হচ্ছে আবার। ঐ যে বললাম, এখানকার শীতের গুটি গুটি চলা বলে কোন ব্যাপার নেই।

কয়েক সপ্তাহ আগের গ্রীষ্মের স্মৃতি তরতাজা থাকতে না থাকতেই আমাদের দিব্যি গরম কাপড়ের ভার সয়ে দিনাতিপাত শুরু করতে হয়েছে। হাতের পাশে সারাক্ষণ মজুদ রাখতে হচ্ছে রেইনকোট। কেননা, বড় আজব শোনালেও যুক্তরাজ্যের শীতকাল মানে বর্ষাকালও। যখন-তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরবে, আকাশের স্বাভাবিক রং থাকবে স্যাঁতা পড়া দেয়ালের মতো বিবর্ণ, রাস্তার পাশের গাছগুলো পাতা ঝরিয়ে দিয়ে একেকজন ভূতের হাত-পা পরে ফেলবে নিজের শরীরে ক্রমশ, আধো অন্ধকারে মহাশূন্যের দিকে কাঠিকাঠি শরীরটাকে উন্মুখ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সারাদিন, যেন ভিন গ্রহের উদ্ভিদ সকল।

আর দিনভর ঐ পত্রঝরা শোকসভার প্রস্তুতি।রাস্তায় হাঁটতে গেলে ঐ সবুজহীন নানারঙা ঝরাপাতা পায়ের তলায় মাড়াতে মাড়াতে নিজের অজান্তেই যেন মনে হতে থাকে- বসন্ত ফুরিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ফুল ফোটার দিন।
শীতের প্রকোপ শুরু হতে না হতেই আমাদের এখানে যারা ঘরের পেছনের বাগানে শাক-সবজির চাষ করেছিলেন তাদের হাতের কাজ ফুরিয়ে গেছে আপাতত। চোখের সামনে তরতাজা হয়ে বেড়ে ওঠা লাউ-কুমড়োর ডাঁটা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে অতি দ্রুত; মুলা, লালশাক, পুঁইশাক রং হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এসব জীবনোচ্ছ্বাসে মেতে থাকা লকলকে ডগাগুলোকে এমন অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখে কেমন যেন উদাস হয়ে ওঠে মন, নানাবিধ হতচ্ছাড়া হতাশার বাণী মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়। ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য ঘরের পেছনের বাগানে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল জীবনানন্দের শীতরাত কবিতার কটি লাইন: ‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে/ বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা/ কিংবা প্যাঁচার গান, সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো...’। মনে মনে তাই আওড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখ গেল বাগানের মৃতপ্রায় শাক-বজির ফাঁকে ফাঁকে সবলে জেগে ওঠা আগাছাগুলোর প্রতি। এই আগাছাগুলোকে ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করার জন্য গত তিন মাসে অন্তত পাঁচবার আমরা নির্মম হাতে কোদাল চালিয়েছি, এক ধরনের আগাছা নির্মূলকারক ওষুধ পাওয়া যায়, সেগুলোও প্রয়োগ করা হয়েছে। আমাদের এই প্রতিহিংসাপরাèআচরণের কারণেই হয়ত বেচারারা বেশ মাথা নিচু করে ছিল এতদিন। এখন যেই শীতের প্রকোপ বাড়ছে দিন দিন, আমরাও শাক-সবজি চাষের থেকে খুব একটা ফিরতি পাওয়ার নিরাশায় নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি, ঠিক তখনই ঐ আগাছাগুলো দিব্যি নিজেদের রাজত্ব দাবি করতে শুরু করেছে। যে হারে ওরা বাড়ছে প্রতিদিন দেখে মনে হতেই পারে কেউ যেন উর্বরতর মাটি আর সারের সমন্বয়ে ওদেরকে অতি যতেœ বাড়িয়ে তুলছে। চারপাশের সবুজগুলো যখন মরে যাচ্ছে তখন নবোদ্যমে জেগে ওঠা আগাছার সবুজ দেখতে দেখতে ঘরে ফেরার আগে সযতেœ ঐ আগাছার ডগাগুলোকেই ছুঁয়ে দিতে দিতে মনে মনে বললাম, নাহ্, শীত মানে হয়ত সবটাই প্রাণহীন পত্রঝরার শোকসভা নয়। শীত মানে নবজন্মও তো, নবজন্মের জন্য প্রার্থনার সময়ও। বুদ্ধদেব বসুকে মনে পড়ল: ‘এসো শান্ত হও, এই হিমরাতে, যখন বাইরে-ভিতরে/ কোথাও আলো নেই/ তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য/ প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও...’ (কবিতা: শীতরাত্রির প্রার্থনা/ বুদ্ধদেব বসু)
‘হোমলেস’ মানে গৃহহীন। একজন মানুষকে তখনই হোমলেস হিসেবে ধরা হয় যখন তার থাকার মতো কোন ব্যবস্থা না থাকায় রাস্তায় রাত কাটাতে বাধ্য হয়। আবার মাথার ওপর ছাদ থাকা সত্ত্বেও কাউকে ‘হোমলেস’ ধরা হয় যদি যেখানে সে থাকছে সেখানে থাকার মতো তার অনুমতি না থাকে বা থাকার ব্যবস্থা নাজুক হয় কোন কারণে। গ্রেট ব্রিটেনের ভাড়াটেদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়-আশয় নিয়ে কাজ করে এমন একটি দাতব্য সংস্থা হলো শেল্টার। শেল্টারের গত বছরের ডিসেম্বরের নয় তারিখে প্রকাশিত তথ্যমতে ব্রিটেনের মোট ২ লাখ ৭৪ হাজার মানুষ হোমলেস, যাদের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ২৬ হাজার শিশু। অফিসিয়ালি যত্রতত্র ঘুমাতে বাধ্য হওয়া কিংবা কোন অস্থায়ী নিবাসে কোনরকমে রাত কাটানো মানুষের সংখ্যা ইংল্যান্ডে প্রতি ২০৬ জনের একজন! এদের মধ্যে অন্তত ২৭০০ জন রাতের বেলায় যত্রতত্র ঘুমাতে (এমনকি খোলা রাস্তায়ও) বাধ্য হচ্ছে, ১৫,০০০ জন অবিবাহিত মানুষ (সিংগেল) কোন অস্থায়ী হোটেল বা এ জাতীয় নিবাসে বাস করছে এবং প্রায় ২৫০,০০০ মানুষ- যাদের বেশিরভাগই পরিবার, কোন অস্থায়ী বাসস্থানে বসবাস করছে।
স্ট্রিট অব লন্ডনের তথ্যমতে প্রতিবছর আট হাজারেরও বেশি মানুষ লন্ডনের রাস্তায় রাত্রিবাস করে, খোলা রাস্তায় ঘুমাতে বাধ্য হয়। সরকারী হিসাবে প্রতিদিন অন্তত ৬৪০ জন লন্ডনের রাস্তায় ঘুমায়। এই ধরনের মানুষের হোমলেস হবার নানাবিধ কারণ আছে। তবে যে চারটি কারণকে প্রধান হিসেবে ধরা হয়েছে কোন ব্যক্তির হোমলেস হবার পেছনে সেগুলো হলো: ১) সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের অভাব, ২) বেকারত্ব, ৩) দারিদ্র্য এবং ৪) নিম্ন মজুরি। কিন্তু এছাড়াও আরও এক ধরনের হোমলেস মানুষের দেখা পাবেন আপনি লন্ডনে। এখানকার যে কোন রাস্তায় আপনি যদি একটু সকালের দিকে বের হন দেখবেন বিভিন্ন অফিস কিংবা দোকানের সামনে, টেলিফোন বক্সের ভেতরে, স্টেশনের বার-বারান্দায়, সুপার মার্কেটের চাতালের নিচে, কার পার্কের কোনায় প্রচুর মোটা জামা-কাপড়-জ্যাকেট-কম্বলে মোড়ানো দুয়েকজন শুয়ে আছে, কিংবা উদাস নয়নে বসে আছে, বসে বসে পথচারীদের দেখছে। বেচারাদের দেখলেই যে কারও মায়া লাগবে। এদের নোংরা কাপড়-চোপড়র দেখে একই সঙ্গে বিবমিষাও জাগতে পারে, কিন্তু ওদের সামনে মাটিতে বাড়িয়ে রাখা ডোনেশন কাপে দুয়েকটা কড়ি ফেলার ইচ্ছেও হয় মানুষের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক মমতার কারণে। সাধারণত এ ধরনের সবার ভিক্ষাপাত্রের পাশেই ছোট্ট এক টুকরো কার্ড/সাইন (কোন কার্ডবোর্ড বক্স থেকে ছিঁড়ে নেয়া মোটা কাগজের টুকরো) কায়দা করে দাঁড় করানো থাকে, কিংবা তারাই দুহাতে সাইনটাকে ধরে রেখে চুপচাপ বসে থাকে। এসব সাইনবোর্ডের ভাষা মোটামুটি একই: হোমলেস এ্যান্ড হাংরি, প্লিজ হেল্প। আমি একবার এক হোমলেস মানুষের কার্ডে লেখা দেখেছি: ‘প্ল্যান এ: নিড বিয়ার মানি। প্ল্যান বি: উইল ওয়ার্ক ফর ফুড।’ আরেকটি মজার কার্ড চোখে পড়েছে পত্রিকায়: ‘নিড মানি ফর এলকোহল রিসার্চ।’ আরও একটা: ‘ব্লা ব্লা ব্লা- মানি/ ব্লা ব্লা ব্লা - ফুড/ ব্লা ব্লা ব্লা - হু রিড দ্য সাইন এনিওয়ে।/ এনিথিং হেল্পস, থ্যাংকস।’ এ জাতীয় হোমলেস মানুষের বেশিরভাগই ড্রাগ জাতীয় নেশা বা এ জাতীয় বদভ্যাসের সঙ্গে জড়িত। মাঝে মাঝে পুলিশ এদেরকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায়, হয়ত কোন শেল্টারে রাখার ব্যবস্থা করে। কিন্তু আমি শুনেছি এদের বেশিরভাগই নাকি ওসব জায়গায় থাকতে চায় না, সুযোগ পেলেই রাস্তায় ফিরে আসে।
জ্যাকব ফোল্গার জীবনের একটা সময় হোমলেস হতে বাধ্য হয়েছিলেন। সর্বনাশা নেশার পাল্লায় পড়ে জীবনের সবকিছু খুইয়ে দীর্ঘ ১৩ বছর রাস্তায় কাটিয়েছেন। পরবর্তীতে যখন সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন, ফ্রেন্ড-টু-দ্য-হোমলেস নামক একটি চ্যারিটি ওয়েবসাইট খুলে হোমলেস মানুষকে সাহায্য করার মিশনে নেমে পড়েন। নিজের হোমলেস জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা তার কবিতা ‘Although I wish...ও রিংয...’ এর কয়েকটি লাইন: ‘অষষ ও I got is this bag/ Tatterd and so frayed/ One pair of socks to call my own/ No place for my head to lay/... The sun is setting it is night/ ¸ fight has just begun/ I pray I wonÕt freeye before itÕs through/ Although ও রিংয সু ষরভব ধিং ফড়হব.’ আহা কী করুণ! কী নিদারুণ জীবন!
জ্যাকব ফোল্গারের ওয়েবসাইট ভিজিট করে হোমলেস মানুষের অনেক অনুভূতি পড়ে আমার মনে হতে লাগল, ঐ যে শোনা কথাটা- ড্রাগ-এডিক্ট হোমলেসরা রাস্তাতেই থাকতে পছন্দ করে বেশি কথাটি কেবল মিথ্যে না, ডাহা মিথ্যে। সব মানুষই আসলে দিনশেষে ঘরে ফিরতে চায়, যেমন ফিরতে চায় প্রকৃতির সব প্রাণী। মানুষ মূলত ঘরেরই জীব। পুলিশের ঐ রাস্তা থেকে তুলে নেয়ার মধ্যে হয়ত দায়িত্ববোধ আছে, মমতাবোধের ঘাটতিও হয়ত নেই, কিন্তু খুব সম্ভবত যার অভাব তা হলো ঐ হোমলেস লোকটার দৃষ্টিকোণ থেকে তার জীবনটাকে দেখা, পর্যবেক্ষণ করা, তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে মনোবাসনা জাগ্রত করা।
প্রতিবছর লন্ডনের শীতকাল ঘনিয়ে আসতে শুরু করলেই সবচেয়ে বেশি করে আমার এ মানুষগুলোর কথা মনে পড়তে থাকে। অতিরিক্ত এনার্জি বিলের চোখ রাঙানি সত্ত্বেও আমরা যারা ঘরের আরামদায়ক উষ্ণতায় হিটার জ্বালিয়ে গরম খাবার সুযোগ পাচ্ছি, ঘুমানোর জন্য লেপ-কম্বলের যোগান পাচ্ছি, তার বিপরীতে খোদ লন্ডনের মতো জায়গাতেই বহু মানুষ খোলা রাস্তায় শীতের কামড় খেতে খেতে রাত পার করছে। ব্যাপারটা কেমন জানি সব সময়ই অবিশ্বাস্য মনে হয়।
লন্ডন
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২
লেখক : কথাসাহিত্যিক
[email protected]

×